৩২ বছর পায়ে হেঁটে পত্রিকা বিক্রি করছেন আব্দুল আলীম

সাপাহার প্রতিনিধি

“আজকের তাজা খবর” হাঁক দিয়ে এক সময়ের দাপুটে পত্রিকা বিক্রেতা আব্দুল আলীম। সাপাহার উপজেলা সদরের চৌধুরী পাড়া গ্রামের মৃত বইমদ্দীন ও খাতিরন বিবির ছেলে তিনি। তবে পেপার বিক্রেতা বা হকার আলীম নামেই সর্বমহলে পরিচিত। আব্দুল আলীম জন্ম গ্রহন করেন ১৯৮৩ সালের ৫ই ডিসেম্বরে। পারিবারিক অস্বচ্ছলতার কারনে লেখা-পড়ার তেমন সুযোগ হয়তি তার। তারপরেও লেখাপড়া করেছেন অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত। আব্দুল আলীম ৫ম শ্রেণী পড়ুয়া ১ ছেলে সন্তানের পিতা। অত্যন্ত ভদ্র প্রকৃতির আব্দুল আলীম কখনো সাইকেল কখনো হেঁটে ৩২ বছর ধরে পত্রিকা বিক্রি করে চালাচ্ছেন তার সংসার ও সন্তানের লেখা পড়ার খরচ। মাত্র ৭বছর বয়স থেকেই পত্রিকা বিক্রি করা শুরু করেন। আজ পর্যন্ত ছাড়তে পারেননি তার জীবনের প্রথম উত্থান পত্রিকা বিক্রি। তিনি গর্ব করে বলতে পছন্দ করেন “আমি একজন হকার”।

 

একান্ত আলাপচারিতায় আব্দুল আলীম বলেন, “আমি যখন ছোট, তখন মাঝে মাঝে স্কুলে যেতাম। পড়াশোনার প্রতি একটা অন্য রকম টান ছিলো আমার। সেই সুবাদে আমি সাপাহার সরকারী মডেল স্কুলে লেখা পড়া করতাম। কিন্তু বাড়ীর অভাব অনটন আমায় খুব পীড়া দিতো। সে কারনে আমি বাড়ীর কাওকে কিছু না বলে ১৯৯০ সালে আমি স্থানীয় ইসলামিয়া লাইব্রেরীতে যাই কাজের সন্ধানে। উদ্দ্যেশ্য ছিলো দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করবো। সেসময় ওই লাইব্রেরীর মালিক আব্দুস সালাম ছিলেন পত্রিকার এজেন্ট। সপ্তাহে রাজধানী থেকে পত্রিকা আসতো তিন থেকে চারদিন। তিনি আমার কাজের প্রতি আগ্রহ দেখে বিভিন্ন দোকানে পেপার পৌঁছে দেওয়ার দ্বায়িত্ব দিলেন। পরে প্রতিদিন পত্রিকা বাজারে আসায় বাড়তে লাগলো পত্রিকার কদর।

 

বড়লো পত্রিকা ক্রেতার সংখ্যা। এমনও দিন গেছে চাহিদা মতো পত্রিকা দিতে পারিনি কাষ্টমারের হাতে। সেই থেকে পেশা হিসেবে নিয়ে নিলাম হকারের দ্বায়িত্ব। যা আজ পর্যন্ত চলছে। এরই ফাঁকে অনিয়মিত ভাবে লেখাপড়াটাও বজায় রাখার চেষ্টা করতে থাকলাম। কিš‘ পত্রিকার পাঠক দিনের পর দিন বাড়তে থাকায় পড়াশোনা বেশি হয়ে উঠলোনা। সাপাহার সরফতুল্লাহ মাদ্রাসায় ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার সুযোগ হয়েছে আমার। পরে আমি নিজেই শুরু করি পত্রিকার ব্যবসা। জেলা সদর থেকে পত্রিকা কিনে এলাকায় রোদ-বৃষ্টি-ঝড় সকল প্রতিকূলতাকে ছাপিয়ে হেঁটে হেঁটে পত্রিকা বিক্রি করতাম।”

 

পত্রিকা বিক্রয়ের একাল ও সেকাল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, “সেকালে পত্রিকার এতোটাই চাহিদা ছিলো যে, ১৯৯৫ সালের তীব্র বন্যায় নৌকা নিয়ে পত্রিকা পৌঁছাতে হয়েছে পাঠকের কাছে। পরে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। সেসময় গাড়ী–ঘোড়া, ভ্যান-রিক্সা সব বন্ধ ছিলো। পাঠকের চাহিদা ও আমার সংসার চালানোর তাগিদে ৬০ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে জেলা সদর থেকে পত্রিকা এনে বিক্রি করেছি। শুধু সাপাহারে নয়, পত্নীতলা ও ধামইরহাট উপজেলার বেশ কিছু এলাকার পাঠকের নিকট পত্রিকা পৌঁছাতাম।

 

তখন একটা পত্রিকা বিক্রি করলে অর্ধেক লাভ হতো। সেসময় ৮০/৯০ টা পত্রিকা বিক্রি করলে সারাদিনের সংসারের খরচ চালিয়েও কিছু জমা থাকতো। বর্তমান সময়ের পত্রিকা বিক্রয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, ২০০৭সাল পর্যন্ত পত্রিকা বিক্রি করে আগের মতোই ঠিকঠাক ছিলো। কিš‘ তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় পত্রিকা বিক্রি অনেকটা কমেছে। তবে এখনো পত্রিকার কদর তেমন কমেনি। যার ফলে প্রতিদিন ২শ’ থেকে আড়াইশ’ কপি পত্রিকা বিক্রি করি। যা লাভ হয় তা দিয়ে সংসার চালানো সত্যিই কঠিন।” আর এই অবস্থার জন্য দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতিকে দ্বায়ী করেন আব্দুল আলীম।

 

তিনি আরো বলেন,“ বর্তমানে পত্রিকা বিক্রির পাশাপাশি পার্ট টাইম সাপাহার আল হেলাল ইসলামী একাডেমী এন্ড কলেজে অফিস সহায়কের কাজ করি। যাতে এই বাজারে কোনরকম ভাবে সংসার চালানো সম্ভব হয়। কিন্তু বাচ্চার লেখা-পড়ার খরচ যোগান দিতে গিয়ে আমি অনেকটাই অসহায়ত্বের মধ্যে পড়ে যাই।”

 

পত্রিকা বিক্রি ছেড়ে অন্য কোন পেশায় কেন যাচ্ছেন না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “৩০/৩২ বছর যাবৎ পত্রিকা বিক্রি করছি। কখনো রোদ, কখনো বৃষ্টি কোন প্রতিকূলতায় আমার পত্রিকা বিক্রি বন্ধ করতে পারেনি। পত্রিকা বিক্রি আমার রক্তে গেঁথে গেছে। ইচ্ছে  করলেও ছাড়ার উপায় নেই। এছাড়াও আমার কাছে যারা পত্রিকা ক্রয় করেন তিনারা আমাকে এতাটাই ভালোবাসা দিয়েছেন যে, পত্রিকা বিক্রি ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবতেই গা শিউরে উঠে। যতদিন বেঁচে থকবো, শরীরে চলার মতো শক্তি থাকবে ততদনি পত্রিকা বিক্রি করবো ইনশাআল্লাহ।”

 

স্থানীয়রা বলছেন, হকার আব্দুল আলীম যদি পেপার বিক্রি ছেড়ে দেয় তাহলে সাপাহার সদরে পেপার আর হয়তো পড়া হবে না। সেজন্য তার ৩২ বছরের পত্রিকা বিক্রির ঐতিহ্য ধরে রাখার প্রয়াসকে সাধুবাদ জানান সাংবাদিক ও পাঠকরা।

সানশাইন / শাহ্জাদা মিলন

 


প্রকাশিত: আগস্ট ১০, ২০২২ | সময়: ১০:০৭ অপরাহ্ণ | Daily Sunshine