সর্বশেষ সংবাদ :

পানিশূণ্য চলনবিল, হুমকিতে কৃষি

আনোয়ার হোসেন আলীরাজ, সিংড়া: বর্ষা মৌসুমে দেশের বৃহত্তম বিল চলনবিলসহ নিচু অঞ্চল তলিয়ে যায়। নদী-নালা, খাল-বিল থৈ থৈ করে পানিতে। তবে এবার চলনবিলে ভরা বর্ষাতেও পানি নেই। অপরিকল্পিত উন্নয়নের কারণেই বৃহৎ এই বিল এখন পানিশূন্য।
এতে একদিকে মৎস্য সম্পদ নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষি আবাদ। এর প্রভাব পড়েছে তিন জেলার ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া এই বিলের ওপর নির্ভরশীল মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর। জলবায়ু পরিবর্তনের নির্মম উদাহরণ হতে চলেছে এই চলনবিল।
পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জ জেলা মৎস্য অফিসের তথ্যমতে, চলনবিলে ১৯৮২ সালে মাছের উৎপাদন ছিল ২৬ হাজার ৯৯০ মেট্রিক টন। এরপর ১৯৮৭ সালে ২৪ হাজার ৩৩৬ মেট্রিক টন, ১৯৯২ সালে ১৮ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন, ১৯৯৭ সালে ১৫ হাজার ৪২১ মেট্রিক টন, ২০০২ সালে ১২ হাজার ৪৬০ মেট্রিক টন এবং ২০০৬ সালে উৎপাদন হয়েছে ১২ হাজার ১১৭ মেট্রিক টন। এই হিসাবে ২৫ বছরে চলনবিলে মাছের উৎপাদন কমেছে ৭২ দশমিক ৫ শতাংশ। গড় উৎপাদন কমেছে ১২ দশমিক ১ শতাংশ।
প্রতিবছর উৎপাদন কমেছে ৩শতাংশ। চলনবিল অঞ্চলের প্রবীণ ব্যক্তিরা জানান, এক সময়ে চলনবিলের কই মাছ, বাচা মাছ, ধোদা মাছ, বড় বড় বোয়াল, শিং, টেংরা পাতাশি মাছ পাওয় যেত। সৌঁতিজাল, খোরাজাল, বয়াজাল দিয়ে এসব মাছ ধরে পরিবার-পরিজন নিয়ে আনন্দের সাথে খেয়ে পড়ে জীবন-যাপন করত এই অঞ্চলের মানুষ। মাছে-ভাতে বাঙ্গালী এ প্রবাদ বাক্যটি বর্তমানে হারিয়ে যেতে বসেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুই-তিন দশক আগেও আষাঢ় মাসে চলনবিল থাকত পানিতে টইটম্বুর। এখন গোটা বিল পানিশূন্য। জলবায়ু পরিবর্তনের নির্মম উদাহরণ হতে চলেছে এই চলনবিল। এক সময় ধান ও মাছের প্রাচুর্য ছিল চলনবিলে। বিল ঘেঁষে থাকা শত শত দ্বীপসদৃশ গ্রাম অনেক পর্যটককে আকর্ষণ করত। বর্ষাকালে দূর-দূরান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ চলনবিলে বেড়াতে আসতেন। নৌভ্রমণের মাধ্যমে চলনবিলের নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতেন তারা। সে সময় নির্মল আবহাওয়ায় স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করতেন চলনবিল পাড়ের মানুষ। অথচ বর্তমানে চলনবিলে দিন দিন তাপমাত্রা বাড়ছে।
১৯৬৭ সালে প্রকাশিত ‘চলন বিলের ইতিকথা’ বইয়ে লেখক এম এ হামিদের বর্ণনা ধরে এখন চলনবিলে গেলে হতাশই হতে হয়। দখল-দূষণে মরা খালে পরিণত হয়েছে দেশের বৃহত্তম চলনবিলের নদ-নদী। পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে বিলের বিভিন্ন খাল। ভূ-উপরিস্থ পানি না থাকায় নেমে গেছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। ফলে বিলুপ্ত হতে বসেছে বিলের জীববৈচিত্র্য ও মৎস্য সম্পদ। ব্যাহত হচ্ছে কৃষি আবাদ।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, রাজশাহী বিভাগের ৬ জেলার ১ হাজার ৮৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে ছিল চলনবিল। বর্তমানে পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জ এই তিন জেলার ১০টি উপজেলার, ৬২টি ইউনিয়নের ১ হাজার ৬০০ গ্রাম নিয়ে বৃহত্তর চলনবিল। বিলে রয়েছে ২১টি নদ-নদী, ৭১টি নালা-খাল ও ৯৩টি ছোট বিল।
চলনবিলের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, আঁকাবাঁকা রাস্তায় ছেয়ে আছে পুরো বিল। মাঝেমধ্যেই ছোট-বড় ব্রিজ। বর্ষা মৌসুমে চলনবিলে যে পরিমাণ পানি থাকার কথা, বর্তমানে তা নেই। বিল এলাকার বাসিন্দারা বলেন, চলনবিলে একসময় সারা বছর পানি থাকত। উঁচু জমিতে ফসল আবাদ, নদী-খালে মাছ শিকার চলত। অপরিকল্পিত উন্নয়নের কারণেই বৃহৎ এই বিল এখন পানিশূন্য। এতে একদিকে মৎস্য সম্পদ নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষি আবাদ। চলনবিল থেকে ধরা ছোট মাছ থেকে তৈরি করা হয় শুঁটকি।
তবে দিন দিন মাছ কমে যাওয়ায় আগের মত আর বসে না শুঁটকির চাতাল। চলনবিল থেকে ধরা ছোট মাছ থেকে তৈরি করা হয় শুঁটকি। তবে দিন দিন মাছ কমে যাওয়ায় আগের মত আর বসে না শুঁটকির চাতাল।
চলতি বর্ষা মৌসুমে পানিশূন্যতায় ধুঁকছে দেশের বৃহত্তম বিল খ্যাত চলনবিলের জলাশয়গুলো। নেই তেমন বৃষ্টি। বিলে নেই মাছ। তাই অলস সময় পার করছেন এ অঞ্চলের জেলেরা। কেউ কেউ অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন। মহাসংকটে চলছে তাদের সংসার। নেই কোনো সরকারি-বেসরকারি অনুদানও।
সিংড়া পৌর এলাকার চকসিংড়া ও শোলাকুড়া গ্রামের মৎস্যজীবি আব্দুল্লাহ, শাহাদত হোসেন, করিম মৃধা বলেন, মাছ ধরেই চলে আমাদের জীবন জীবিকা। তাই বর্ষা শুরুর আগেই মাছ ধরার জন্য খেয়াজাল, জাকই জাল, ধুন্দি, চাঁই, পলোসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম তৈরি করে রেখেছি। অথচ বর্ষা মৌসুমেও বিলে পানি আসেনি।
শালমারা গ্রামের মৎস্যজীবি মাহাবুর শেখ বলেন, ভরা বর্ষায় বিলে পানি না থাকায় আমাদের উপার্জনের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। পরিবেশ ও প্রকৃতি আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক আবু জাফর সিদ্দিকী বলেন, দাদা-দাদীসহ গ্রামের বয়োবৃদ্ধদের কাছে চলনবিলের অনেক গল্প শুনেছি। এগুলো এখন শুধুই ইতিহাস। অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও অবৈধ দখলে চলনবিল এখন বর্ষা মৌসুমেও পানিশূন্য।


প্রকাশিত: আগস্ট ৭, ২০২২ | সময়: ৬:০৪ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ