ক্রমেই অস্তিত্ব হারাচ্ছে মৃৎশিল্প

ইসমত আরা: এক সময়ে কুমারপাড়ার বাতাসে কাঁচা মাটির গন্ধে ছড়িয়ে থাকাতো। সে এক অন্যরকম ভালোলাগা। মাটির আসবাবপত্র তৈরিতে ব্যবহৃত চাকের ঘূর্ণির ছন্দে ব্যস্ত থাকতো কুমাররা। বাঙালির শত বছরের পুরোনো ঐতিহ্য মৃৎশিল্প। প্লাস্টিক ও ধাতুর যুগে দেশের সবচেয়ে প্রাচীন এ শিল্পটি এখন মৃত প্রায়। আয় কমেছে কামারদের। তাই পেশা ছেড়ে অন্য পেশা খুজতে শুরু করেছে তারা।
সারা দেশের মতো রাজশাহী অঞ্চলের প্রায় এলাকায় কুমারপাড়া থাকতো। এক সময় কুমারপাড়ায় কাঁচা মাটির গন্ধে মন মাতোয়ারা থাকতো। প্রাচীনকাল থেকে বংশানুক্রমে গড়ে ওঠা গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প আজ বিলুপ্তির পথে। আগে দেশের প্রতিটি গ্রামে যারা মাটি নিয়ে কাজ করেন পেশায় তাদের কুমার বলে। দিন দিন যেভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে তাতে তারা পেশা নিয়ে বেশ চিন্তিত। বিশেষ করে প্লাস্টিকের যুগে এ শিল্প টিকিয়ে রাখা দায় হয়ে পড়েছে।
তারপরও দেশে কিছু এলাকা বা গ্রাম আছে যেখানে এখনো বাংলার ঐতিহ্য তারা ধরে রেখেছেন। এমনি একটি গ্রাম হচ্ছে গোদাগাড়ী উপজেলার প্রেমতলী কুমারপাড়া।
ওই পাড়ায় প্রায় হিন্দু ধর্মাবলম্বী পনেরো থেকে ষোলো ঘর। তারা সবাই মৃৎশিল্পের কাজ করেন। প্রতিটি বাড়ির সামনে ছোট্ট উঠান। উঠানজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে কাদামাটির তৈরি হাঁড়ি, পাতিল, খোলা, কলস, ঘর সাজানোর জিনিস, কাপ-পিরিজ, কয়েল রাখার বক্স, রুটি বানানো খোলা, ছোট-বড় নানা রকমের পাত্র। মৃৎশিল্পের কাজের প্রতি আগ্রহ কুমারদের মন থেকে উঠে যাচ্ছে দিন দিন।
ওই গ্রামের মৃৎশিল্পের কারিগর বিনয় কুমার পাল(৪২) বলেন, বাপ-দাদার আমলের এই ব্যবসা আমাদের। সংসারে আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায় খুব ছোটোতেই আমি এই কাজ শুরু করি। খেয়ে পড়ে কোনোমতে দিন চলে যাচ্ছে আমাদের। আমার সংসারে সদস্য সংখ্যা ৬ জন। যেমন একটা ফুলের টব তৈরি করতে খরচ পড়ে পনেরো থেকে ষোলো টাকা, আর বিক্রি করি আঠারো থেকে বিশ টাকায়। খুব একটা লাভ করতে পারি না।
বিনয় কুমার পালের স্ত্রী শিল্পীরানী (৩৮) বলেন, ক্রেতা এসে বলে মাটির খোলার দাম কতো তখন যদি বলি ৭০ টাকা, তখন তারা বলেন, ৪০ টাকা দিব দিলে দেন না দিলে গেলাম। তখন আমাদের এক প্রকার বাধ্য হয়েই জিনিসপত্র দিতে হয়। দেখা যাচ্ছে যে, তৈজসপত্রের বিকল্প ব্যবস্থা থাকায় মাটির তৈজসপত্রের প্রতি ক্রেতা চাহিদা কমে গেছে।
বিনয় কুমার পাল আরো বলেন, আগে অনেকেই এ পেশা করতো। বেশিরভাগ কুমার তাদের পেশা বদলিয়েছে। আমি পারিনি। অন্য কাজ পারিনা বলে এ কাজ ছাড়া হয়নি। আমার ছেলেমেয়েদেরকে পড়ালেখা শিখিয়ে অন্য কাজ করাবো। এই কাজে পরিশ্রমের তুলনায় উপার্জন কম। তাই কষ্ট হচ্ছে তবুও তাদের পড়ালেখা শিখাচ্ছি। জীবনে সবাই চায় উন্নতি করতে, আমি ও চাই আমার ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ ভালো হোক।
মৃৎশিল্পের ইতিহাস: নব্যপ্রস্তরযুগের চেক প্রজাতন্ত্রে গ্রাভেতিয়ান সভ্যতার ডলনে ভোসনিসের খ্রিস্টপূর্ব ২৯,০০০ – ২৫,০০০ অব্দের ভেনাসের প্রস্তরমূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। এবং চীনের জিয়াংঝিতে মাটির পাত্র আবিষ্কৃত হয়েছে যা প্রায় খ্রীস্টপূর্ব ১৮,০০০ অব্দের। এ থেকে ধারনা করা যায় যে এ শিল্পটি কতো পুরানো।
মাটির শিল্প প্রথম চীনের থাংশান শহরে প্রচলিত ছিল। এই শহরটিকে মৃৎশিল্পের শহর বলা হয়। মিং রাজবংশের ইয়ং লে-এর সময়কালে থাংশান শহরে মৃৎশিল্পের উৎপত্তি ও বিকাশের সূত্রপাত হয়। চীনে ৫০০টির বেশি মৃৎশিল্পের সামগ্রী বর্তমানে দেখা যায়। চীনে এই মাটির তৈরি জিনিসপত্রকে বলা হয় ‘সেলাডন’। চীনারাই এশিয়া, ইউরোপে মৃৎশিল্প ছড়িয়ে যায়।
এই শিল্পটি হলো বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও অন্যতম একটি শিল্প। শিল্পায়নের যুগে ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে মৃৎশিল্প।


প্রকাশিত: আগস্ট ৬, ২০২২ | সময়: ৫:৪৩ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ

আরও খবর