এক বেলা না খাওয়ানোর অজুহাতে সমাজচ্যুত!

স্টাফ রিপোর্টার, বাগমারা: সমাজভূক্ত কেউ বিয়ে করলে সমাজের লোকজনকে এক সপ্তাহের মধ্যে একবেলা খাওয়াতে হবে। এমন নিয়ম রয়েছে রাজশাহীর বাগমারার বাজেকোলা গ্রামে। সেই গ্রামে বিয়ে হয় রুবেল হোসেনের। কিন্তু সংসারের টানপোড়নে ছেলেকে বিয়ে দেয়ার পরেই সমাজের লোকজনকে খাওয়াতে পারেননি সাখাওয়াত হোসেন। এজন্য তাকে সমাজচ্যুত করা হয়েছে। তার সঙ্গে মেলামেশার অপরাধে অন্য ভাইদেরও একই অবস্থা করা হয়েছে।
দীর্ঘ দুই বছর ধরে সমাজচ্যুত অবস্থায় রয়েছে রাজশাহীর বাগমারার গণিপুর ইউনিয়নের বাজেকোলা গ্রামের আটটি পরিবার। সামাজিক অনুষ্ঠানেও যোগ দিতে পারেন না তারা। সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হওয়াসহ নানাবিধ সমস্যায় পড়ছে পরিবারগুলো।
নিজেদের মুক্তির দাবি জানিয়ে থানায় মাতব্বরদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এতে ক্ষুদ্ধ হয়ে উল্টো মারধরের শিকার হতে হয়েছে। পরে পুলিশ ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ নিলে সমাজে ফিরে নেয়ার আশ্বাসের এক মাস পার হলেও তা করা হয়নি। তবে মাতব্বরদের দাবি তারা সমাজের নিয়ম মানে না, তাই এই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সমাজচ্যুত হওয়া আটটি পরিবারগুলো হলো মোজাম্মেল হক, জোনাব আলী, সাজ্জাদ হোসেন, সেলিম হোসেন, আইনুল ইসলাম, কিরন, আবদুল জব্বার ও সাখাওয়াত হোসেন। তারা একই পাড়ার বাসিন্দা ও পরস্পরের আত্মীয়।
ভূক্তভোগী সালাউদ্দিন জানান, দুই বছর আগে তার বড়ভাইয়ের ছেলে পোশাক শ্রমিক রুবেল হোসেনের বিয়ে হয়। বিয়ের পর সমাজের লোকজনদের একবেলা খাওয়ানোর নিয়ম থাকলেও টাকার অভাবে তিনি তা ওই সময়ে করতে পারেননি। এজন্য সমাজের লোকজনের কাছে সময় চাওয়া হয়। তবে তারা সময় না দিয়ে উল্টো সাখাওয়াতকে সমাজচ্যুত করা হয়। তার সঙ্গে মেলামেশার না করার জন্য সমাজের লোকজনদের নির্দেশ দেয়া হয়। তবে সমাজের নির্দেশ না মেনে বড়ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক রাখার অভিযোগে তাকে এবং চাচাতো ভাইদেরও একই অবস্থা করা হয়। সে থেকে আটটি পরিবার সমাজচ্যুত অবস্থায় রয়েছে। তাদের সঙ্গে সমাজের অন্য লোকেরা ভয়ে মেলামেশাও করতে পারছেন না।
নিজেদের সমাজের সুবিধা বঞ্চিত উল্লেখ করে ঘটনার সুরাহার দাবি জানিয়ে চার মাতব্বরের বিরুদ্ধে রবিবার রাতে থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। গ্রামের চার মাতব্বর রাকিব তালুকদার, আবদুল জলিল, আকবর আলী ও আবদুল জব্বারের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
সাখাওয়াত হোসেন অভিযোগ করে বলেন, দীর্ঘ দুই বছর ধরে তাদের সামাজিক কোনো কাজে রাখা হচ্ছে না। শুরুতে একসঙ্গে নামাজ আদায় ও গ্রামের মাঠে গবাদি পশু চরানোর বাধা থাকলেও পরে তা তুলে নেয়া হয়েছে। তবে সামাজিক অন্য কাজে তাদের সম্পক্ত করা হয় না। ফিতরা সামাজিকভাবে গ্রহণ করে পরে তা বন্টনের নিয়ম থাকলেও দুই বছর ধরে তারা ফিতরা দিতে পারছেন না। সমাজচ্যুতের অজুহাতে তাদের কাছ থেকে ফিতরা গ্রহণ করা হচ্ছে না।
ভূক্তভোগী অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক আবদুল জব্বার মোল্লাহ কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আটটি পরিবারকে সমাজচ্যুত করার কারণে সামাজিক ভাবে হেয় হচ্ছেন। আত্মীয়-স্বজনেরাও যেমন খারাপ দৃষ্টিতে দেখছেন, এবং গ্রামের লোকজন সমাজচ্যুত হওয়ার ভয়ে তাদের সঙ্গে প্রকাশ্যে মেলামেশা করতে পারছেন না। তাদের নাতি ও স্বজনদেরও নানা কথা শুনতে হচ্ছে।
এদিকে এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আটটি পরিবারের সদস্যরা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক গৃহবধূ বলেন, তারাও মিশতে চান তবে সমাজের ভয়ে মিশতে পারেন না।
পাশের রঘুপাড়া গ্রামের স্কুলশিক্ষক রহিদুল ইসলাম বলেন, সমাজের মাতব্বরেরা কাজটি ঠিক করেননি। তিনি সমাজপতিদের বিষয়টি সুরাহার জন্য বলেছেন একাধিকবার।
এসব বিষয়ে মাতব্বরদের পক্ষে রাকিব তালুকদার বলেন, দুই বছর আগ থেকে তাদের সমাজচ্যুত করা হয়েছে।
তিনি অভিযোগ করেন, তারা সমাজের নিয়ম মানেন না, সমাজে বিশৃংখলা তৈরি করে। তবে তাদের একসঙ্গে নামাজ আদায়সহ অন্যান্য কাজ করতে কোনো বাধা দেওয়া হয় না।
বাগমারা থানার ওসি অরবিন্দ সরকার এ সংক্রান্ত দুইটি আলাদা লিখিত অভিযোগ পাওয়ার কথা স্বীকার করে জানান, অভিযোগটি তদন্ত করার জন্য একজন উপপরিদর্শককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তারা স্থানীয় ভাবে বসে সুরাহার আশ্বাস দিয়েছিলেন। তবে এখনো তা কেন করা হয়নি তা দেখা হচ্ছে।


প্রকাশিত: মে ৬, ২০২৪ | সময়: ৫:৩১ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ