গরমে মারা যাচ্ছে মুরগি, বড় লোকসানে খামারিরা

সানশাইন ডেস্ক: দেশে চলমান তীব্র তাপপ্রবাহে বিপর্যস্ত জনজীবন। প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে চলা এ দাবদাহে হিট স্ট্রোকে মানুষের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। তীব্র তাপপ্রবাহের মাশুল দিতে হচ্ছে দেশের পোল্ট্রি খাতকেও।
অতিরিক্ত গরমের কারণে হিট স্ট্রোক করে প্রতিদিনই মারা যাচ্ছে মাংসের চাহিদা পূরণে বড় ভূমিকা পালন করা ব্রয়লার মুরগি। আবার অত্যধিক তাপমাত্রায় ডিমের উৎপাদনও কমেছে প্রায় ১০ শতাংশ। এ অবস্থায় সাম্প্রতিক সময়ে খুচরা বাজারে ডিম এবং আগামী আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত তিন মাস ব্রয়লার মুরগির সংকটের আশঙ্কা করছেন খামারিরা।
অন্যদিকে, হঠাৎ অধিকসংখ্যক মুরগি মারা যাওয়ায় এবং ডিমের উৎপাদন কমে যাওয়ায় চরম আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে খামারিদের। বর্তমান অবস্থায় পরিচর্যার ব্যয়ও বেড়েছে দ্বিগুণ। এমন পরিস্থিতি দীর্ঘসময় চললে ছোট খামারিদের ভয়াবহ আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হবে– বলছেন সংশ্লিষ্টরা। তাই ঘুরে দাঁড়াতে খামারিদের সরকারের প্রণোদনার আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তাপপ্রবাহের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন নরসিংদী, রাজশাহী, দিনাজপুর, নওগাঁ, চুয়াডাঙ্গা, যশোর, মেহেরপুর, খুলনা, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, কক্সবাজার ও বরিশাল অঞ্চলের খামারিরা।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ) বলছে, রোজার ঈদের (ঈদুল ফিতর) পর থেকে অতিরিক্ত গরমের কারণে পোল্ট্রি খাতে সংকট দেখা দিয়েছে। যা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে তাপপ্রবাহ শুরু হওয়ার পর। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ব্রয়লার মুরগি লালনপালন করা খামারিরা। কারণ ব্রয়লার মুরগি গরম সহ্য করতে পারে না। ফলে তাপপ্রবাহের শুরু থেকে হিট স্ট্রোকে সারা দেশে প্রতিদিন গড়ে এক লাখের মতো মুরগি মারা গেছে। যার আনুমানিক বাজার মূল্য ২০ কোটি টাকা। এর প্রভাব পড়েছে ডিম উৎপাদনেও। সাম্প্রতিক সময়ে মুরগির উৎপাদন ৪-৮ শতাংশ এবং ডিমের উৎপাদন প্রায় ১০ পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছে।
গরমে হিট স্ট্রোকে কত মুরগি মারা গেছে, সেই সংখ্যা নির্ণয় করতে সারা দেশের তথ্য সংগ্রহ করছে পোল্ট্রি খামারিদের সংগঠন বিপিএ। তাদের তথ্য বলছে, চলমান তাপপ্রবাহে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন নরসিংদী এলাকার খামারিরা। এ অঞ্চলে গত ১৫ এপ্রিল থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত ১০ দিনে তিন লাখ মুরগির মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া গাজীপুর অঞ্চলে দুই লাখ, চট্টগ্রাম অঞ্চলে এক লাখ ৭৫ হাজার, সিলেট অঞ্চলে ৫০ হাজার, যশোর অঞ্চলে এক লাখ ৫০ হাজার, পাবনা অঞ্চলে ৫০ হাজার এবং চুয়াডাঙ্গায় এক লাখ মুরগি মারা গেছে।
২৬ এপ্রিলের পর থেকে ১ মে পর্যন্ত ছয় দিনে এসব এলাকায় আট লাখ ব্রয়লার মুরগি এবং দুই লাখ সোনালি মুরগির মৃত্যু হয়েছে। এতে ডিমের উৎপাদন কমেছে ১০ শতাংশ। অন্যদিকে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে ১০ শতাংশ। বিপিএ বলছে, তাপপ্রবাহের কারণে যত মুরগি মারা গেছে তার মধ্যে ব্রয়লার মুরগির সংখ্যাই বেশি।
বৈরী আবহাওয়ায় খামারিদের করণীয় সম্পর্কে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এবং এই মৌসুমে খামারিদের করণীয় ঠিক না করলে সামনে পোল্ট্রি খাতে ভয়াবহ সংকট তৈরি হতে পারে— মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে এমনিতেই খামারিদের লোকসানে পড়তে হয়েছে। এর মধ্যে আবহাওয়া দ্রুত স্বাভাবিক না হলে শিগগিরই ব্রয়লার মুরগি ও ডিম সরবরাহে সংকট দেখা দিতে পারে।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের মতে, দেশের বাজারে প্রতিদিন ব্রয়লার মুরগির চাহিদা তিন হাজার ৫০০ টন, সোনালী ও লেয়ার মুরগির চাহিদা এক হাজার ২০০ টন। এর বিপরীতে স্বাভাবিক সময়ে ব্রয়লার, সোনালী, লেয়ার মুরগি মিলে মাংস উৎপাদন হয়েছে পাঁচ হাজার ২০০ টনের বেশি।
সংগঠনটির শঙ্কা, তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে অনেক খামার বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে মুরগির উৎপাদন নেমে আসতে পারে চার হাজার টনে। আবার যেসব খামারে মুরগি মারা গেছে, সেখানে লোকসানের শঙ্কায় নতুন করে মুরগির বাচ্চা আনা হয়নি। কেউ কেউ লোকসান এড়াতে এই মৌসুমে কম পরিমাণে বাচ্চা পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অনেকে খামার বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তও নিয়েছেন। ফলে মাংসের বাজারে বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে।
তীব্র গরমে খামারিরা বিপাকে পড়লেও সরকারের প্রাণিসম্পদ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তাদের পাশে নেই বলে অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. সুমন হাওলাদার। তিনি বলেন, কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর সিন্ডিকেটের কাছে সাধারণ খামারিরা এমনিতেই অসহায়। আবার বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে দায়সারা বক্তব্য দেওয়া হয়েছে। যেখানে প্রান্তিক খামারিদের লাখ লাখ মুরগি মারা যাচ্ছে সেখানে তারা বলছেন, মাত্র চার হাজার মুরগির মৃত্যুর খবর পেয়েছেন। বিষয়টি স্পষ্ট যে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সঙ্গে প্রান্তিক খামারিদের কোনো সংযোগ নেই। ফলে সরকারের এই দপ্তরের কাছে মুরগির মৃত্যুর কোনো তথ্য নেই।
চলমান পরিস্থিতিতে খামারিদের সার্বিক বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ‘ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম’ গঠন করা হয়েছে। তারা খামারিদের করণীয় সম্পর্কে উঠান বৈঠক, আলোচনা সভার মাধ্যমে সচেতন করছেন বলে জানিয়েছেন ঢাকা জেলার বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ দপ্তরের উপপরিচালক (ভেটেরিনারি পাবলিক হেলথ) ডা. মো. মোস্তফা আশরাফ।
তিনি বলেন, মুরগির শরীরের তাপমাত্রা মানুষের তুলনায় বেশি। স্বাভাবিকভাবে মুরগির তাপমাত্রা ১০৩-১০৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট পাওয়া যায়। মুরগির জন্য ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাই বেশি। অথচ বর্তমানে তাপমাত্রা প্রায় ৩৭-৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দেশের কোনো কোনো এলাকায় তাপমাত্রা এর চেয়েও বেশি। সেজন্য মুরগির মৃত্যু হচ্ছে। ডিম উৎপাদনের ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়ছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে খামারিদের করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তা বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে যেকোনো ধরনের সেবা বা পরামর্শ চাইলে তারা পাবেন। একেবারে কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট সবাই একসঙ্গে কাজ করছেন। বিভিন্ন জায়গায় উঠান বৈঠক হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে মুরগির শেডের তাপমাত্রা যতটা সম্ভব কমিয়ে রাখার চেষ্টা করতে হবে। হিট স্ট্রোক প্রতিরোধে মুরগিকে গুড়ের শরবত পান করানো যেতে পারে। এ ছাড়া নিরাপদ খাবার পানি নিশ্চিত করা এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকেও বাড়তি নজর দেওয়া উচিত।


প্রকাশিত: মে ৫, ২০২৪ | সময়: ৫:০৭ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ