সর্বশেষ সংবাদ :

রাবি ভর্তি পরিক্ষা ঘিরে অটো চালক ও ব্যবসায়ীদের লাভের ঈদ

জুল ইকরাম ইবতিদা: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) সাম্প্রতিক পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে শহরের বিভিন্ন সেক্টরে ব্যবসার জোয়ার দেখা দিয়েছে। গত ক’দিন ধরে চলা এই পরীক্ষার আয়োজন শহরের অর্থনীতিতে এক চাঙ্গা স্রোত এনে দিয়েছে। যার প্রধান উপকারভোগী হলেন অটো চালক ও হোটেল মেসের মালিকরা।
রাবির পরীক্ষা চলাকালীন রাজশাহীর বিভিন্ন হোটেল ও মেস পূর্ণ হয়ে উঠেছে শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের সাথে। অন্যদিকে, অটো চালক ও বাস সেবাগুলো এই সুযোগে ভাড়া আদায়ের ক্ষেত্রে কোনো রাখঢাক রাখছে না। সাধারণ হারের চেয়ে এক থেকে দশ গুণ পর্যন্ত বেশি ভাড়া নিচ্ছে তারা, যা অনেক শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের জন্য এক বিশাল অর্থনৈতিক চাপের কারণ হয়ে উঠেছে।
পরীক্ষার সময় রাজশাহীতে আসা অতিথিদের কাছ থেকে বেশি ভাড়া নেওয়া হয়, কিন্তু এবার ভাড়ার হার সত্যিই অবিশ্বাস্য, এমনটাই বলছেন এক অভিভাবকরা। এই পরিস্থিতি নিয়ে রাজশাহীর স্থানীয় প্রশাসন ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নজর রয়েছে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। অনেকে মনে করছেন, এই ধরনের অসাধু প্রবণতা রোধে কঠোর নিয়ম নীতি এবং নজরদারির প্রয়োজন।
যদিও এই ঘটনা শহরের অর্থনীতিকে একটি অস্থায়ী চাঙ্গা ভাব দিয়েছে, তবুও এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব নিয়ে চিন্তিত অনেকে। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের উপর এই আর্থিক চাপ সৃষ্টির প্রতি সচেতনতা বাড়ানো এবং সম্মিলিতভাবে এর প্রতিকারের পথ খুঁজে বের করার দাবি উঠেছে সকল মহল থেকে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত তিনদিন ধরে চলছে রাবির পরীক্ষা। রাবির পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে হোটেল মেসগুলোর পাশাপাশি ধুমধামে ব্যবসা করছেন অটো চালকরা। পিছিয়ে নেই বাস মালিকরাও।
অভিযোগ রয়েছে, পরীক্ষার এই তিনদিনে রাজশাহীর অর্থনীতি অনেক চাঙ্গা হয়েছে, যা বেশিরভাগই শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের জিম্মি করে। সাধারণ মানুষও বাদ যায় না এই অটো চালকদের হাত থেকে। অটো চালকরা যার থেকে যেমন ভাড়া পাওয়া যায়, আদায় করে নেন। এমনকি ১০ গুণেরও বেশি নিয়ে থাকেন অটো চালকরা। সুযোগ বুঝে রিকশা চালকরাও করেন একই কাজ। যদিও অটোর ভাড়ার তালিকা নির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে, তবুও কেউ তোয়াক্কা করছেন না কেউই।
রাবি ভর্তি পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে শহরে একদিনে প্রায় ৪ লক্ষ মানুষের সমাগম হয়। যাদের বেশিরভাগই প্রথমবার রাজশাহীতে আসেন। তারা ভাড়া সম্পর্কে কিছুই জানেন না। তাই অটো চালকরা যে ভাড়া দাবি করেন, তাদেরকে সেটিই মেনে নিতে হয়।
রংপুর শহর থেকে রাবি ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে এসেছেন মিনহাজ সিজন নামের এক শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, অটো চালকরা বেশি ভাড়া নিচ্ছেন অন্যদিনের তুলনায়। এর আগেও একবার এসেছি তখন এতো ভাড়া ছিল না। স্টেশন থেকে কাজলা গেট পর্যন্ত ভাড়া ১০ টাকা দিয়ে গেছি। অথচ এখন ৫০ টাকার নিচে কোনো অটো চালকই যেতে রাজি হয় না। এতে বলা যায় ৫ গুণ বাড়িয়েছে তাদের ভাড়া।
এ অভিযোগ শুধু মিনহাজের নয়; এমন হাজারো শিক্ষার্থীর এমন অভিযোগ রয়েছে। প্রতি বছরেই বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষার সময় এই রকম হয়রানির মধ্যে পড়তে হয় সকল শিক্ষার্থীদের ও অভিভাবকদের। এই অবস্থার পরিবর্তন হওয়া উচিত বলে মনে করেন পরীক্ষার্থী ও অবিভাবকরা।
এই বিষয়ে এক অটো রিকশা চালক জালাল উদ্দিনের সাথে কথা হয়। তিনি জানান, পরীক্ষার দিন রাস্তায় অনেক জ্যাম থাকে, বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে আসতে দুই ঘণ্টার বেশি সময় লাগে। এই অতিরিক্ত সময়ের কারণে সকল অটো রিকশা চালকরা বেশি টাকা নিয়ে থাকেন।
অটো মালিক সমিতির সভাপতি সাগর বলেন, ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে সিটি করপোরেশনের সাথে মিটিং হয়েছিল সেই সময় অটো ভাড়া নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে, ভাড়ার তালিকাটি অনলাইনেও রয়েছে। এবং সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে সকল অটো চালক এই ভাড়া সম্পর্কে অবগত। কিন্তু রিকশা ভাড়া ঠিক করে দেওয়া নেই। রিকশা চালকরা এই জিনিসটির সুযোগ নিচ্ছে। তারা নতুন মানুষ দেখলেই অনেক গুণ ভাড়া বেশি নিয়ে থাকে। কিন্তু অটোর ভাড়ার তালিকা দেওয়ার পরও যদি এইরকম ঘটনা ঘটে তবে সেটি খুবই দুঃখজনক। তিনি আরও জানান ভর্তি পরীক্ষার সময় যাতে কোনো সমস্যা না হয় সে জন্য দুই শিফটের অটোগুলোকে এক শিফটে করছি। এত কিছু করার পরও যে যে অটো চালক এই রকম অনৈতিক কাজ করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রাজশাহীর বাহিরের কিছু অটো চালক এসে রাজশাহী শহরের সুনাম নষ্ট করার চেষ্টা করছে, এদেরকে চিহ্নিত করে কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তি দেওয়ার আশ্বাস দেন তিনি।
এদিকে, রাজশাহীর সুনামধন্য হোটেলগুলো শিক্ষার্থীদের নিয়ে ব্যবসা করছে। পরীক্ষার কয়েক দিনে হোটেলগুলোতে চাপ বেশি থাকে। এরই সুযোগ নিচ্ছেন হোটেল ব্যবসায়ীরা। হোটেল হক ইন্টারন্যাশনালের সাধারণ সব রুম বুক থাকায়, এসি রুম ফাঁকা ছিল, যার অনলাইনে ভাড়া দেখানো হয় ২০০০ টাকা। সাধারণ মানুষ সেজে তাদের সাথে কথা বলার সময় তারা জানায় ওই রুমের ভাড়া লাগবে ৫০০০ টাকা, নতুবা রুম পাওয়া যাবে না। একই অবস্থা আরেক হোটেল আনজুম ইন্টারন্যাশনালের, যেখানে রুমের ভাড়া ১১০০ টাকা দেখানো হলেও তারা চাইছে ২৫০০ টাকা। পরে সাংবাদিকদের পরিচয় দিয়ে ভাড়া বেশি নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে তারা কল কেটে দেয়। এই যদি হয় রাজশাহী শহরের হোটেলগুলোর অবস্থা, তাহলে দূর থেকে আসা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা কী রকম হয়রানির শিকার হচ্ছেন, তা অনুমান করা কঠিন নয়।
মেয়েকে নিয়ে পরীক্ষা দিতে এসে হোটেলে দ্বিগুণ ভাড়ার কথা জানালেন খালেদা পারভিন নামের এক অভিভাবক। তিনি জানান, হোটেলের মেনুতে লিখা আছে ৮০০ টাকা কিন্তু তারা ভাড়া নিয়েছে ২০০০ টাকা। শুধু তার সাথেই নয়, আরো অনেকের সাথে একই ঘটনা ঘটার দাবি করেন তিনি।
রাজশাহী আবাসিক হোটেল মালিক সমিতির সভাপতি ও হোটেল নাইস ইন্টারন্যাশনালের মালিক খন্দকার হাসান কবির বলেন, তিনি এ বিষয়ে কোনো কিছু জানেন না। এই হোটেলগুলোতে এই রকম চাপ থাকলে অন্য শহরের হোটেল মালিকরা ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত দাবি করত। এদিক দিয়ে রাজশাহীর হোটেল ব্যবসায়ীরা অনেক ভালো। অনেক হোটেল লসের মধ্যে রয়েছে। তবে হোটেল ভাড়া বেশি নেওয়ার বিষয়ে প্রমাণ থাকলে তারা ব্যবস্থা নেবেন।
রাজশাহী মেস মালিক সমিতির সভাপতি ও এবেলা ছাত্রাবাসের মালিক এনায়েতুর রহমান বলেন, ভর্তি পরীক্ষার এক মাস আগে থেকেই হোটেল এবং মেসগুলো বুক হয়ে থাকে। তিনি জানান, যে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিতে আসে তাদের জন্য এক রাত ফ্রী থাকার নির্দেশনা রয়েছে। পরবর্তিতে কেউ থাকতে চাইলে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা ভাড়া দিয়ে থাকতে হয়। তিনি অভিযোগ করে বলেন, যেসব মেস মেস মালিক সমিতির বাইরে তারা এই নির্দেশনাগুলোকে অমান্য করার চেষ্টা করে। বিশেষ করে বিনোদপুরের দিকে যে সব মেস রয়েছে তারা এই কাজগুলো করে থাকে। তিনি কিছু অসাধু শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, কিছু শিক্ষার্থী নিজেদের আত্মীয়র কথা বলে অনেক ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের থাকতে দেয় এবং তাদের থেকে ইচ্ছে মত টাকা আদায় করে থাকে। এতে করে ওই মেসের নামও খারাপ হয়। এই বিষয়গুলো খতিয়ে দেখার আশ্বাস দেন তিনি। কোনো মেসের বিরুদ্ধে অনৈতিক কোনো কিছুর উপযুক্ত প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানান তিনি।


প্রকাশিত: মার্চ ৭, ২০২৪ | সময়: ৬:১৬ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ