রাবি ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে এসে চরম ভোগান্তিতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবক

জুল ইকরাম ইবতিদা: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষা শুরু হচ্ছে মঙ্গলবার। তবে এই ভর্তি পরিক্ষা দিতে আসা পরিক্ষার্থী ও সঙ্গে আসা অভিভাবকরা এই শহরে এসে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। হোটেল ভাড়া থেকে শুরু করে খাবার এমন কি রিকশাভাড়াতেও গুণতে হচ্ছে দ্বিগুণের বেশি টাকা।
মঙ্গলবার ‘সি’ ইউনিটের (বিজ্ঞান) ভর্তি পরীক্ষার মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া এই পরীক্ষা চলবে ৭ মার্চ পর্যন্ত। এবার তিনটি ইউনিটে কোটা বাদে ৩ হাজার ৯০৪টি আসনের বিপরীতে মোট ১ লাখ ৭৩ হাজার ১১৭টি আবেদন জমা পড়েছে। এ হিসাবে প্রতিটি আসনের বিপরীতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন ৪৪ জন ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থী।
এদিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবারো দেশের সব বিভাগীয় শহরে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগের শিক্ষার্থীদের ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ করেনি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন রাবির পরীক্ষা রবিতেই নেয়ায় তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন অভিভাবকেরা। তাদের অভিযোগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সব বিভাগীয় শহরে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগের ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ করতে পারলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তা কেন পারবেন না, সেটি বোধগম্য নয়।
মঙ্গলবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৩-২০২৪ শিক্ষাবর্ষের সি ইউনিটের (বিজ্ঞান) ভর্তি পরীক্ষার মধ্য দিয়ে এবারের ভর্তি পরীক্ষা শুরু হয়। এরপর ৬ মার্চ এ ইউনিট (মানবিক) ও ৭ মার্চ বি ইউনিটের (বাণিজ্য) ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। ভর্তি পরীক্ষা সকাল ৯টা থেকে ১০টা, বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১২টা, বেলা ১টা থেকে ২টা এবং বেলা সাড়ে ৩টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত মোট চার শিফটে অনুষ্ঠিত হবে।
প্রতি বছর ৫৯ টি বিভাগ এবং ৫ টি ইনস্টিটিউট এ কোটা সহ সর্বমোট ৪ হাজার ১৩৭ টি আসনে ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করে থাকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি)। রাবিতে তে প্রতি বছর ৩ টি ইউনিটে প্রায় ২ লক্ষ্য শিক্ষার্থী আবেদন করে থাকে। এই দের দুই লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রায় এক লক্ষ শিক্ষার্থীদের সাথে আসে দুই চার জন অভিভাবক। মোটের উপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার সময় রাজশাহী শহরে অতিরিক্ত তিন চার লক্ষ মানুষ এক দিনে বেড়ে যায়। এইবার ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং রুয়েটের পরীক্ষা হয় লাগাতার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা হয় ১ তারিখে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হয় ২ তারিখে, ইঞ্জিনিয়ারিং গুচ্ছের পরীক্ষা রুয়েটে অনুষ্ঠিত হয় ৩ তারিখে আবার ৫ তারিখ থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা। রাবির পরীক্ষা শেষ হলে ৮ তারিখে ডেন্টালের পরীক্ষা হবে বিভাগীয় শহর গুলোতে। অনেক গুলো পরীক্ষা পর পর একসাথে হওয়ায় অনেক শিক্ষার্থী একবারে রাজশাহী এসে থাকছে কয়েক দিনের জন্যে, সব পরীক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে। সে জন্যে এইবার রাজশাহী শহরে মানুষের চাপ ও বেশি।
এইদিকে রাজশাহীর সুনামধন্য হোটেল গুলো শিক্ষার্থীদের নিয়ে করছে ব্যাবসা । এই কয়েক দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার জন্য হোটেল গুলোতে চাপ বেশি । এরই সুযোগ নিচ্ছে হোটেল ব্যাবসায়ীরা।
হোটেল হক ইন্টারন্যাশনাল, তাদের সাধারণ সব রুম বুক। এসি রুম ফাঁকা ছিল যার অনলাইনে ভাড়া ২০০০ টাকা, সাধারণ মানুষ সেজে তাদের সাথে কথা বলার সময় তারা জানায় ওই রুমের ভাড়া লাগবে ৫০০০ টাকা, নতুবা রুম পাওয়া যাবে না। একই অবস্থা আরেক হোটেল আনজুম ইন্টারন্যাশনাল এর তাদের যে রুমের ভাড়া ১১০০টাকা সেখানে তারা চায় ২৫০০ টাকা। পরে সাংবাদিকদের পরিচয় দিয়ে ভাড়া বেশি নেওয়ার কারণ জানতে চাওয়া হলে তারা কল কেটে দেয়। এই যদি হয় রাজশাহী শহরের হোটেল গুলোর অবস্থা তাহলে দুর থেকে আসা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা কি রকম হয়রানির শিকার হচ্ছে সেটা অনুমান করা কঠিন না।
সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছে মেয়ে ও নারী অভিভাবকরা। তাদের জন্য সৃষ্টি হয়েছে অত্যাধিক সমস্যা। তাদের উপায়োন্তর না দেখে হোটেল গুলোর মুখে জিম্মি হয়ে এই ভাড়া দিয়েই রুম নিয়ে থাকতে হয়।
মেয়েকে নিয়ে পরীক্ষা দিতে এসে হোটেলে দ্বিগুণ ভাড়ার কথা জানালেন আঞ্জুমান আরা নামের এক অভিভাবক। তিনি জানান, হোটেল ভাড়ার মেমোতে লেখা আছে ১৫০০ টাকা। কিন্তু ভাড়া নিয়েছে ৩৫০০ টাকা। ‘এক রাতেই যদি ৪ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়, তাহলে মেয়েকে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে কিভাবে ভর্তি পরীক্ষা দিতে নিয়ে যাব।’
হোটেল গুলোর অনৈতিক কার্যকলাপের বিষয়ে রাজশাহী আবাসিক হোটেল মালিক সমিতির সভাপতি ও হোটেল নাইস ইন্টারন্যাশনালের মালিক খন্দকার হাসান কবিরের সাথে কথা হয়। তিনি এ বিষয়ে কোনো কিছু জানেন না বলে দাবি করেছে। তিনি বলেন যদি কেউ এ ধরনের কার্য কলাপের সাথে জড়িত থাকে তাহলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ঢাকা শহরের চাকুরীজীবী আইনুল হক সেলিম বলেন, ‘১৫ দিন ধরে হোটেলে চেষ্টা করেও সিট পাইনি। তাই রাতের গাড়িতে রাজশাহী এসেছি। ভোর থেকেই ক্যাম্পাসে আছি। কারণ থাকার তো জায়গা নাই। এজন্য কষ্ট করে আছি। পরীক্ষা হলেই মেয়েকে নিয়ে আজকেই ঢাকায় ফিরব।’
কি আর করবে অসহায় এর মত যাদের থাকার জায়গা নাই তাদের জায়গা হয় রেলের প্লাটফর্মে বা মসজিদে। যারা অভিভাবক ছাড়া পরীক্ষা দিতে এসেছে তাদের বেশিরভাগই উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল গুলোতে বড় ভাইদের আশ্রয়ে। যাদের কোনো বড় ভাই নাই তাদের ঠিকানা হয়েছে হল গুলোর গণরুম বা হলগুলোর মসজিদে।
খুলনা থেকে এসেছেন আবু সাইফ আহমেদ। রাত কাটিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জিয়া হলের মসজিদে। বিভাগীয় শহরে পরীক্ষা নেয়ার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, যাতায়াতে আমাদের অনেক সমস্যা হয়। ৩ তারিখে ইঞ্জিনিয়ারিং গুচ্ছের পরীক্ষা দিয়ে রাজশাহী এসেছি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা দিতে। রাবির পরীক্ষা যদি বিভাগীয় শহরে হতো তাহলে আমাদের আর এত কষ্ট করে রাজশাহী আসার দরকার ছিল না। থাকার জায়গা পাইনি, রাতে ঘুম হয়নি। খাবার খেতে পারছি না, দামও বেশি নিচ্ছে। নিজেকে দুর্বল লাগছে। কোনরকম পরীক্ষাটা দিতে পারলেই হলো।
ভর্তি পরীক্ষা অটো রিকশা চালকদের জন্য যেনো ঈদের দিন। এই দিন বাহির থেকে অনেক শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা রাজশাহী আসে এবং সঠিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিত হতে হয় , সুযোগ বুঝে অটো রিকশা চালকরা তাদের কাছ থেকে কয়েকগুণ বেশি ভাড়া নিয়ে থাকে। যদিও অটো রিকশার ভাড়া নির্দিষ্ট করা থাকে তবুও নতুন মানুষদের কাছ থেকে এক প্রকার জিম্মি করে ভাড়া নেয়া হয়। প্রত্যেকটা অটো চালকরা একই কাজ করে।
রাজশাীতে ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসা আরেক শিক্ষার্থী নকশী বলেন , আমি গত তিন মাস থেকে রাজশাহীতে আছি আজকে (মঙ্গলবার ) পরীক্ষার আগে অটো চালকরা অন্য দিনের তুলনায় অতিরিক্ত ভাড়া দাবি করে। সাহেব বাজার থেকে কাজলা পর্যন্ত ভাড়া দশ টাকা, সেখানে তারা পঞ্চাশ টাকা চায়। অনেকক্ষন ধরে দাড়িয়ে থেকেও লাভ হয়নি। আমাদের সঠিক সময়ে কেন্দ্রে উপস্থিত হতে হবে তাই ভাড়া বেশি দিয়েই পরীক্ষার কেন্দ্রে উপস্থিত হয়েছি। রিক্সা গুলোতো একটু বেশি টাকা দাবি করে কেউ চায় দুইশ টাকা কেউবা চায় দেড়শো। এত টাকা ভাড়া দিয়ে আসা যায়? এমনই প্রশ্ন অসংখ্য শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের। পরীক্ষার আগে অটো রিক্সা চালকদের কাছে জিম্মি থাকে বাহির থেকে আসা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।
এবিষয়ে এক রিকশা চালক জালাল উদ্দিনের সাথে কথা হয়। তিনি জানান পরীক্ষার দিন রাস্তায় অনেক জ্যাম থাকে , বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে আসতে দুই ঘণ্টার বেশি সময় লাগে এই অতিরিক্ত সময়ের কারণে সকল অটো রিকশা চালকরা বেশি টাকা নিয়ে থাকে। তিনি স্টেশন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত যেতে ১৫০টাকা নেন।
মঙ্গলবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে দাড়িয়ে আছে প্রায় একশ বাস। দেখে যেন মনে হচ্ছে কোনো শহরের বাস টার্মিনাল। কিছু বাস চালকদের সাথে কথা বলে জানা গেল, বেশিরভাগ বাস এসেছে রাজশাহী বিভাগের বাহির থেকে। চট্টগ্রাম, ময়মনসিং, কুমিল্লা, সিলেট প্রায় সব জায়গা থেকেই শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা এসেছে রাবির ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার জন্য। বাসগুলো চুক্তিভিত্তিক ভাড়া নেয়া হয়েছে। বেশি বিপাকে পড়েছেন স্বল্প আয়ের পরিবার থেকে আসা ছাত্র-ছাত্রীরা।
মোস্তাদিক ফেরদৌস নামে একজন ছাত্র জানিয়েছেন, তারা কুমিল্লা সদর থেকে ৪২ জন ছাত্র-ছাত্রী তাদের অভিভাবকের সঙ্গে একটি বাস রিজার্ভ করে রাজশাহীতে এসেছেন। তারা সন্ধ্যা ৭ টার সময় রওনা দিয়ে ভোর ৪ টায় পৌঁছেন। দিনের আলো ফোটা পর্যন্ত তারা বাসেই অবস্থান করেন। পরে তারা ফুটপাতে অবস্থান নেন, অনেকে বাসেই থেকে যান।
চট্রগ্রাম থেকে নজরুল ইসলাম তার একমাত্র মেয়েকে নিয়ে এসেছেন। ঘাসের উপর বসে একহাতে পানি এবং অন্য হাতে পাখা দিয়ে মেয়ে আসা আক্তারকে বাতাস করছিলেন। তিনি বলেন, বিভাগীয় শহরে পরীক্ষা হলে আমার মেয়ে চট্টগ্রামে পরীক্ষা দিতে পারত। এতদূর আসতে হতো না। আমার মেয়ে কখনোই এতো লম্বা জার্নি করেনি। ইতিমধ্যে কয়েকবার অসুস্থ হয়েছে। আমার মতো আরও অনেকেই আছেন। বিভাগীয় শহরে পরীক্ষা হলে এমন ভোগান্তি হতো না।
সকল শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের একটাই দাবি যদি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের পরীক্ষা নিজেদের ক্যাম্পাসে না নিয়ে বিভাগীয় শহর গুলোতে নেয় তাহলে প্রায় সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। শিক্ষার্থীরা সকল ভর্তি পরীক্ষা গুলো যদি বিভাগীয় শহরে দিতে পারে তাহলে রাজশাহীতে এই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।


প্রকাশিত: মার্চ ৬, ২০২৪ | সময়: ৫:২৭ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ