বস্তির অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগই কেড়ে নিল চার প্রাণ

সানশাইন ডেস্ক: রাজধানীতে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টা থেকে শুরু করে রাত ১২টা পর্যন্ত মুষলধারে বৃষ্টি হয়। এ দিন ছয় ঘণ্টায় ১১৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে ঢাকায়। মুষলধারে বৃষ্টির ফলে রাজধানীর বহু জায়গায় সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। মিরপুরের হাজি রোডের ঝিলপাড় বস্তির পাশের সড়কে প্রবল বর্ষণের কারণে জমে থাকা পানিতে হেঁটে যাওয়ার সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে একই পরিবারের তিনজনের মৃত্যু হয়। পরে তাদের বাঁচাতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে আরও এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়।
নিহতরা হলেন মো. মিজান (৩০), তার স্ত্রী মুক্তা (২৫), তাদের মেয়ে লিমা (৭) ও অপরজন হলেন অটোরিকশা চালক অনিক নামের এক ব্যক্তি। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে চারজন নিহত হওয়ার ঘটনাস্থল থেকে ৮ মাস বয়সী হোসাইন নামের এক শিশুকে উদ্ধার করা হয়। শুক্রবার দুপুরে ঘটনাস্থলের পাশেই নিহত অটোরিকশা চালক অনিকের বন্ধু আব্দুর রহমানের কথা হয়।
তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার রাত দশটার দিকে আমরা একসঙ্গে বন্ধুরা মিলে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ছিলাম। এ সময় এই রাস্তা দিয়ে একটা আপু ও ভাইয়া দুটো বাচ্চা নিয়ে আসছিলেন। আপুটা হঠাৎ রাস্তায় পড়ে যায়। আমরা মনে করেছিলাম, পা পিছলে রাস্তায় পড়ে যায়। আমার বন্ধু অনিক দৌড়ে যায় তাদের বাঁচাতে। ওখানে শট খায় অনিক। পরে আমাদের আরেক বন্ধু জুয়েলও যায়। সে দেখে পানিতে আর্থিং (বিদ্যুতায়িত) হয়েছে। পরেও ওখান থেকে আমরা সবাই দূরে চলে আসি। মহিলাটি বাচ্চাটাকে দূরে ছুড়ে মারে। পরের বাচ্চাটিকে উদ্ধার করে এলাকাবাসীরা হাসপাতালে নিয়ে যায়। অন্যদিকে, আমরা আমাদের বন্ধু অনিককে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে যাই।
কিভাবে বিদ্যুতের তার লিক করল জানতে চাইলে রহমান বলেন, ঝিলপাড় বস্তির অবৈধ বিদ্যুৎ লাইন টানা হয়েছে। বৃষ্টিতে এই বিদ্যুতের লাইন লিক করেছে। এ কারণেই রাস্তার পানি কারেন্ট হয়ে গিয়ে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে ঝিলপাড় বস্তির সামনে বসে কাঁদছিলেন নিহত মুক্তার মা কুলসুম। তিনি বলেন, এই বৃষ্টি ও কাঁদার মধ্যে নাতি-নাতনিদের নিয়ে বাসায় যেতে না করেছিলাম মুক্তাকে। বৃহস্পতিবার দিনটা বাসায় থাকতে বলেছিলাম। বৃষ্টি কমায় বাসা থেকে বের হয়। রিকশায় যেতে বলেছিলাম। রিকশায় না পাওয়া হেঁটে যাওয়া এই ঘটনা ঘটে।
তিনি আরও বলেন, আমার মেয়ের শ্বশুরবাড়ি বরিশালের ঝালকাঠিতে। তারা আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। চিড়িয়াখানা রোড মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের বাসায় যেতে গিয়ে সব শেষ হয়ে গেল। আমি সব হারালাম। মুক্তার বাবা রিকশা চালক সানোয়ার জানান, শিশুটিকে প্রথমে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে ডাক্তার হোসাইনকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন। রাতে তাকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসার পর সকালে তাকে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে।
সানোয়ার শেখ বলেন, আমার মাইয়া শ্বশুর বাড়ি ঝালকাঠি থেকে আসছে গতকাল সকালে। দুপুরে এইখানেই ভাত খেয়েছে। রাতে ভাত খাবে। সবাই মিলে বের হইছে রাস্তায়। সেখানেই এই অবস্থা। মানুষের হুড়াহুড়ি, চিৎকার শুনে দেখি এই অবস্থা। তখন পাগল হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা। মাথা ঠিক নাই। কেউ কয় শিশু হাসপাতালে যাইতে, কেউ কয় ঢাকা মেডিকেল নিতে। পরে বাচ্চার বাড়িতে লোক এসে সোহরাওয়ার্দীতে নিয়েছে। ওদের কি কারেন্টে মারলো না, বজ্রপাতে মারলো জানি না। কার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিব?
এলাকাবাসীরা অভিযোগ করে বলেন, এখানে বৃষ্টি হলেই পানি জমে। পানি জমার দুইটি কারণ। এক ঝিলপাড়ের খাল দখল হয়ে যাওয়া ও এই সড়কের মধ্যে আইল্যান্ডে একটি গর্ত আছে। এই গর্তটি বন্ধ করে দিলে রাস্তায় হাঁটু পানি জমে। গত কালকের বৃষ্টির সময় এই গর্তটি বন্ধ ছিল। গর্তটা খুলে দেওয়ার ১০ মিনিটের মধ্যে পানি সরে যায়।
তারা আরও বলেন, এখানকার খাল দখল করে দারুল আমান সোসাইটি একটি মসজিদ তৈরি করেছে। খালটি দখল করেছে ক্ষমতাধর লোকেরা। আইল্যান্ডের ওই গর্তটি তারাই বন্ধ করে রাখে। এই দখল করে যে স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে, ওই স্থাপনাগুলো সরিয়ে দিলেই জলাবদ্ধতার সমস্যা দূর হবে। এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর তোফাজ্জল হোসেন টেনু বলেন, আমান হাউজিংয়ের একটি অফিস ও মসজিদ যে জায়গা দখল করছে এটি খালের জায়গা নয়। এটি হাউজিংয়ের জায়গা। বস্তিবাসীই খালের জায়গা দখল করেছে। এজন্যই এখানে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে।
এ বিষয়ে মিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন বলেন, অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের বিষয়টি আমরা জানতে পেরেছি। এ বিষয়ে আমাদের তদন্ত চলমান। এ ছাড়া নিহতের স্বজনরা আমাদের কাছে একটি অভিযোগ করেছে। অবহেলিতজনিত মৃত্যুর বিষয়ে। অভিযুক্ত মামলা আকারের দায়েরের প্রক্রিয়াও চলমান। অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ থেকে শুরু করে এই মৃত্যুর পেছনে কারও কোনো দায় আছে কি না সেটি আমরা তদন্ত করে দেখব।
এর আগে, বৃষ্টির মধ্যে রাজধানীর মিরপুরে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে শিশুসহ চারজনের মৃত্যু হয়েছে। নিহতদের মধ্যে তিনজন একই পরিবারের সদস্য ছিল। পরে তাদের বাঁচাতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে আরও এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়। বৃহস্পতিবার এ তথ্য নিশ্চিত করেন মিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসিন। পরে তাদের উদ্ধার করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিলে চিকিৎসক চারজনকেই মৃত ঘোষণা করেন।


প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২৩ | সময়: ৫:০৫ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ

আরও খবর