ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় হিমশিম খাচ্ছে ঢাকা মেডিকেল

সানশাইন ডেস্ক: দিন কয়েক আগে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে (ভিক্টোরিয়া) ডেঙ্গু ধরা পড়ে গার্মেন্টকর্মী আশরাফুল ইসলামের। সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসে মেঝেতেও জায়গা মেলেনি, শেষমেষ ঠাঁই নিয়েছেন সিঁড়ির পাশে চিকিৎসকদের বিশ্রাম কক্ষের সামনের ফাঁকা জায়গায়।
হাতে ক্যানুলা পরানো ৩০ বছর বয়সী আশরাফুলের স্যালাইন ঝোলানো হয়েছে মাথার কাছে থাকা সিঁড়ির রেলিংয়ে। সঙ্গে থাকা বড় ভাই আনোয়ার হোসেন বললেন, ‘‘নারায়ণগঞ্জ ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে দুই দিন ছিলাম। ডেঙ্গু ধরা পড়ার পর হাসপাতাল থেকে ঢাকায় যেতে বলে। এরপর গত তিন দিন হলো ঢাকা মেডিকেলে আছি।
‘‘ঢাকা মেডিকেলে আসার পর আশরাফুল অনেক ভালো আছে। এখানকার ডাক্তাররা ভালো ট্রিটমেন্ট দিছেন।’’ডেঙ্গুর প্রকোপের মধ্যে রাজধানীর পাশাপাশি আশপাশের জেলার রোগীর চাপও সামলাতে হচ্ছে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালকে। ডেঙ্গু রোগীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হলেই জেলা সদর ও উপজেলা পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালগুলো রোগী পাঠিয়ে দিচ্ছে দেশের সবচেয়ে বেশি রোগী সামলে আসা সরকারি হাসপাতালটিতে।
তাতে মেঝে, বারান্দা, সিঁড়ির পাশে, দুই ফ্লোরের মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থানসহ সবখানেই ঠাসা থাকছে রোগীতে। কেবল চাটাই বিছিয়েও থাকছেন রোগী ও স্বজন। ঝোলানোর স্ট্যান্ড না পেয়ে কোনোমতে উুঁচ স্থানে ঝুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে স্যালাইন।
তারপরও রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলছে ঢাকার ব্যস্ত এ হাসপাতালে। কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেল, ঢাকার অন্যান্য সরকারি হাসপাতালে জ্বর ও ডেঙ্গুর উপসর্গ নিয়ে যাওয়া রোগীকে ফেরত দেওয়ার ঘটনা থাকলেও ঢাকা মেডিকেলে তেমনটা হয় না। তাছাড়া এ হাসপাতালে সাধারণ থেকে জটিল অবস্থায় পৌঁছানো রোগীর চিকিৎসায় ব্যবহৃত সব ধরনের পরীক্ষা সুবিধা, প্লাটিলেট দেওয়ার সুবিধাসহ আইসিইউ শয্যা সংখ্যা বেশি হওয়ায় রোগীদের সেখানে নিয়ে যাচ্ছেন স্বজনরা।
আবার সাধারণ জ্বরকে ডেঙ্গু মনে করে অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন, তাতেও ঢাকা মেডিকেলে রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। ঢাকা মেডিকেলে রোগীর চাপ এত বেশি যে পা রাখার মতোও ফাঁকা জায়গাও থাকছে না। ঢাকায় রোগী পাঠানোর সুপারিশের বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা সিভিল সার্জন ডা. এ এফএম মুশিউর রহমান বলেন, ‘‘ডেঙ্গু জ্বর হলে জেলা সদরসহ উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা দিয়ে থাকি। রক্তে প্লাটিলেটের অনেক পরিমাণে কমে গেলে বা গর্ভবতী ডেঙ্গু রোগীর অন্যান্য জটিলতা দেখা দিলে আমরা রেফার করে থাকি। কারণ আমাদের এখানে প্লাটিলেট দেওয়া বা আইসিইউর ব্যবস্থা নেই।”
ঢাকা কাছে হওয়ায় অনেক সময় রোগী যেতে চাইলে হাসপাতাল ছাড়পত্র দিয়ে দেয় বলে জানান তিনি। ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গ নিয়ে ভর্তি হওয়াদের ঢাকা মেডিকেলের ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম তলার মেডিসিন বিভাগে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এসব ওয়ার্ডে ভর্তি হওয়াদের বেশিরভাগই ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত। দশম শ্রেণি পড়ুয়া সাব্বির রহমান মোল্লা ঘরে থাকা অবস্থায় জ্বরে পড়লে ভর্তি হয়েছিলেন গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলা হাসপাতালে।
সাব্বির জানান, ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়ার পর ঢাকায় পাঠিয়ে দেন চিকিৎসকরা। গত কয়েকদিন ধরে ভর্তি আছেন ৭০২ নম্বর ওয়ার্ডে। পদ্মা সেতুর কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থার যেমন উন্নতি হয়েছে, সেই সঙ্গে উন্নত চিকিৎসার আশায় অনেকেই রাজধানীমুখী হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন গোপালগঞ্জ জেলার সিভিল সার্জন ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ। তিনি বলেন, ‘‘গোপালগঞ্জ জেলায় ডেঙ্গু জ্বরের ব্যবস্থাপনা ভালো রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। শুধু একজনের মৃত্যুর রেকর্ড আছে, বাকিরা সুস্থ হয়ে ফিরেছেন। সদরসহ উপজেলা পর্যায়ে নিয়মিত তদারকি করা হচ্ছে, যাতে কোনো রোগী মুমূর্ষু না হলে হাসপাতাল থেকে অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়ার সুপারিশ না করা হয়।
‘‘উপজেলা পর্যায় থেকে দু-একটি ঘটনা হয়ে থাকতে পারে। ঢাকায় যাওয়ার মতো ঘটনা এড়াতে ফের নির্দেশনা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। আমরাও চাই চিকিৎসক ও রোগীর মধ্যে যেন বোঝাপড়া ভালো থাকে।’’ ঢাকা মেডিকেলের ৭০২ নম্বর ওয়ার্ডে বেলা সাড়ে ১১টায় কথা হয় শরীয়তপুরের গোসাইর হাট এলাকার শাকিল আহমেদের (১৭) সঙ্গে। সদ্য এসএসসি উত্তীর্ণ এই কিশোর বলে, ‘‘উপজেলায় কী ট্রিটমেন্ট দেয়, ভালা হয় না। তাই বাবায় ঢাকায় নিয়ে আইছে ছয়দিন হইলো। এহন আগের চেয়ে ভালা আছি। খালি পেট ব্যথা ঠিক হয় নাই। খাইতে তেমন পারি না।”
বেলা ১২টায় ঢাকা মেডিকেলের নতুন ভবনের ৭০২ নম্বর ওয়ার্ডে কথা হয় জ্বর, পেট ব্যথার উপসর্গ নিয়ে ভর্তি হওয়া মোছাম্মত তানিয়ার স্বামী আলাউদ্দিনের সঙ্গে। রাজধানীর মিরপুর-৬ নম্বর এলাকার বাসিন্দা তানিয়ার জ্বর কয়েকদিন ধরেই। বুধবার ঢাকার সরকারি একটি হাসপাতালে (সোহরাওয়ার্দী) নিয়ে গেলে সেখানে ভর্তি নেয়নি বলে জানান স্বামী। কেবল ব্যবস্থাপত্র দিয়ে বাসায় ফেরত দিয়েছে। রাতে অবস্থার অবনতি হলে দ্রুত তাকে নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেলে।
অসহনীয় পেট ব্যাথায় তানিয়া চিৎকার করে কান্নাকাটি শুরু করলে তাকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয় জানিয়ে আলাউদ্দিন বলেন, ‘‘আমি ছোডো একটা চাকরি করি। সরকারি সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল তো ভর্তি নিল না। সেহানে নাকি রোগী বেশি। ঢাকা মেডিকেল তো রোগী ফেরত দেয় না। তাই এহানে নিয়া আসছি।” রাতে ভর্তি করলে প্রয়োজনীয় পরীক্ষার স্লিপ দেন চিকিৎসকরা। রক্তের ওই পরীক্ষার পরই চিকিৎসকরা সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়ার।
কিন্তু সকাল ১০টায় যে রিপোর্ট দেওয়ার কথা ছিল, ঢাকা মেডিকেলের ল্যাবের মেশিন নষ্ট হওয়ায় তা পাননি আলাউদ্দিন। দুপুর ১টার দিকে দ্বিতীয়বার গিয়েও রিপোর্ট পাননি। বিকাল ৪টায় রিপোর্ট মিলবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। এর মধ্যে দুপুরে পেট ব্যাথায় ছটফট করতে দেখা গেছে তানিয়াকে। পাশে থাকা তানিয়ার শাশুড়ি জানালেন, পুত্রবধূ ব্যথায় যেমন কুকড়ে উঠছে, তেমনই পেটও ফুলে গেছে।
বাড়তি রোগীর চাপ হলেও আগের সক্ষমতা নিয়েই চলছে ঢাকা মেডিকেলের টাকা সংগ্রহের বুথ ও ল্যাব। ছুটির দিনে এই ল্যাব ও বুথের কাউন্টার সংখ্যা যেমন কমে যায়, তেমনি বিভিন্ন ওয়ার্ডে থাকা সাহায্যকারীও কমে যায় বলে জানালেন ৭০২ নম্বর ওয়ার্ডে সেবাদাতা চিকিৎসক রাকিব আল ইমরান।
তিনি বলেন, ‘‘ডেঙ্গুর উপসর্গ নিয়ে যারা আসেন, তাদের রক্তের পরীক্ষার ফলাফল আমরা অন্যান্য দিন ৩-৪ ঘণ্টার মধ্যে পেয়ে যাই। কিন্তু শুক্রবার সকালে দেওয়া রক্তের রিপোর্ট পেতে বিকাল হয়ে যায়। ততক্ষণ রোগ অনুযায়ী পুরো চিকিৎসা ব্যবস্থায় যাওয়া সম্ভব হয় না।” মেডিসিন ওয়ার্ডে দৈনিক গড়ে যেখানে ১০০ রোগী ডেঙ্গু ও জ্বর নিয়ে আসত, এখন তা বেড়ে দুইশ থেকে আড়াইশ হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
আল ইমরান বলেন, ‘‘এখন মানুষ জ্বর হলেই ডেঙ্গু আতঙ্কে ভুগছেন। এই সমস্যা ঢাকা ও বাইরের রোগীদের বেলায়ও। আবার এই সপ্তাহে ঢাকার আশপাশের জেলা থেকে সাধারণ ডেঙ্গু রোগী আসতে শুরু করেছে বেশি। এই দুই কারণে রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি হয়ে গেছে।” একজন ব্যক্তির চারবারও ডেঙ্গু হতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, “বিভিন্ন ধরনের ডেঙ্গুর মধ্যে ঢাকার মানুষের প্রথম দফার হয়েছে। দ্বিতীয় ফেজ চলছে। তাই যাদের প্লাটিলেট ও রক্তের চাপ সেভাবে কমেনি, তাদের বাসায় থাকতে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। যাদের ঝুঁকি মনে করছি তাদের ভর্তি নেওয়া হচ্ছে।”
পরীক্ষা-নিরীক্ষায় জটিলতা হচ্ছে স্বীকার করে তিনি জানালেন, চিকিৎসা সরঞ্জাম যেমন- স্যালাইন, ওষুধ হাসপাতাল থেকেই সরবরাহ করা হচ্ছে। ডেঙ্গুর চিকিৎসায় হাসপাতালে চিকিৎসা উপকরণ যথেষ্ট রয়েছে। রোগীর বাড়তি সংখ্যা চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্য সেবায় নিয়োজিত সহকারীদের উপর বাড়তি চাপ তৈরি করছে।
ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের নতুন ভবনের তৃতীয় তলায় অবস্থিত পূবালী ব্যাংকের বুথে রোগ নির্ণয়ের ফি জমা নেওয়া হয়। একটি বুথের পাঁচটি কাউন্টারে ফি নেওয়া হয়। রোগীর চাপে স্বজনদের দুই থেকে তিন ঘণ্টা পর্যন্ত দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় কেবল টাকা জমা দিতে। বেলা পৌনে ১টায় লম্বা লাইনে দাঁড়ানো গিয়াস উদ্দিন আড়াইটায় গিয়েছেন অর্ধেকটা। আরো ঘণ্টাখানেক পরে হয়ত কাউন্টারের কাছে যেতে পারবেন।
তিনি বলেন, ‘‘ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি ছিলাম ডেঙ্গু নিয়ে। এহন ডেঙ্গু নাই। ডাক্তার কইছে নিয়মিত সিবিসি পরীক্ষা করতে। ট্যাকা জমা দিমু-লাইনেই গেল দুই ঘণ্টার বেশি।’’ ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মচারী স্বপন কুমার দাস এসেছেন ভর্তি হওয়া মেয়ের রোগ নির্ণয়ের টাকা জমা দিতে। তিনি বলেন, ‘‘চারটা পরীক্ষা করতে বলেছে ডাক্তার। এখন লাইনে দাঁড়ায়া আছি দুই ঘণ্টার বেশি হইব। লাইন আর আগায় না। বারন্দায় লাইনে যোগ দিছিলাম, এহন কেবল কাউন্টার দেখা যায়।”
টাকা জমা হওয়ার স্লিপ নিয়ে ফের যেতে হয় রোগী ভর্তি হওয়া ওয়ার্ডে। সেখান থেকে নমুনা নিয়ে যেতে হয় ল্যাবরেটরিতে। মেঝেতে থাকা রোগীদের বিছানাপত্র দেওয়া সম্ভব না জানিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক বলেন, “বিছানা দিলে জায়গা কমে যায়। রোগী বেশি হলে আমরা বিছানা দেই না।”
ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ায় রোগীর চাপ বেড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষার নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা করতে প্যাথলজির বুথ বাড়ানো হয়েছে, আরো বাড়াব। কিন্তু জায়গা নেই, আমি পিডব্লিউডিকে (গণপূর্ত বিভাগ) বলেছি, তাদের কাছে ফান্ড নেই। টাকা আসলে তারা কাজ করবে।” অন্যদিকে টাকা জমা নেওয়ার জন্য আরো দুটি বুথ বাড়ানো হবে উল্লেখ করে তিনি জানান, একটি হবে জরুরি বিভাগের সামনে। অন্যটি বসানো হবে বহির্বিভাগে।


প্রকাশিত: আগস্ট ৫, ২০২৩ | সময়: ৬:২৯ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ