বিদ্যালয়ে নিয়োগের উপর্যুপরি চাপে সভাপতির পদত্যাগ

গোদাগাড়ী প্রতিনিধি: রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠনগুলোতে শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগ বাণিজ্য রমরমা হয়ে উঠেছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা নিয়োগ নিয়ে বিভিন্ন কায়দায় স্থানীয় মাধ্যমিক ও উচ্চ বিদ্যালয়গুলোর সভাপতি ও প্রধান শিক্ষককে চাপ প্রয়োগ করছেন। তাদের চাপের মুখে বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করারও ঘটনা ঘটেছে। প্রধান শিক্ষক পদে ২৫-৩০ লাখ টাকা এবং চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা লেন-দেনের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে উপজেলার হুজরাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারি শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে প্রায় সাড়ে ৩৪ লাখ টাকা নিয়ে পরিচ্ছন্নতা, নিরাপত্তা কর্মী ও আয়া পদে নিয়োগ পরীক্ষা সম্পন্ন করছেন। তবে নিয়োগ প্রক্রিয়া বৈধ না হওয়ায় ওই স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মোজাহার আলী তিন কর্মচারীকে যোগদান করাননি। ফলে শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ স্কুলের শিক্ষকদের প্রাণনাশের হুমকি সহ নানান ভাবে ভয়ভীতি দেখার অভিযোগ উঠেছে। ওই নিয়োগকে কেন্দ্র করে স্থানীয়রা ফুঁসে উঠেছে শিক্ষক আবুল কালাম আজাদের উপর।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, উপজেলা যেসকল মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও মাদ্রাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে। সেইসব প্রতিষ্ঠান গুলোতে তিনজন করে কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হবে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আওয়ামী লীগের নেতারা স্কুল প্রধান ও সভাপতিদেরকে নিয়োগ দিতে চাপ প্রয়োগ করছেন। তবে নিয়ম অনুযায়ী নেতারা এসব নিয়োগে কোন ধরনের হস্তক্ষেপ করতে পারে না বা কমিটির কেউ না।
এসব নেতাদের কথা না শুনলে দেওয়া হচ্ছে বরখাস্ত বা চাকুরিচুত্য করার হুমকি। এতে করে কোন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান বা সভাপতি নিজেদের সম্মান বাঁচাতে না হেনস্থা থেকে রক্ষা পেতে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন। তবে কোন কোন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও সভাপতিরা তাদের এই অবৈধ চাপে নত না হয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া এখনো শুরু করেননি। ফলে ওইসব শিক্ষকরা রাজনৈতিক ভাবে হেনস্থা ও চাকুরিচুত্যু হবার ভয়ে দিন পার করছেন।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা দুলাল আলমকে কজ্বায় নিয়ে উপজেলার বিভিন্ন পর্যায়ের আওয়ামী লীগের নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা এই কাজে নেমে পড়েছেন। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই প্রতিটি স্কুলে কর্মচারী নিয়োগ এবং যেসব স্কুলে প্রধান শিক্ষক ও সহকারি প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য আছে তাদের দ্রুত নিয়োগ দিতে চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে। কর্মচারী পদে ১০-১৫ লাখ এবং প্রধান ও সহকারি প্রধান শিক্ষক পদে ২০-৩০ লাখ টাকা নিয়ে নিয়োগ করা হবে। এই নিয়োগ বাণিজ্যে করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হবে বলে জানা গেছে।
গত ১৩ জুলাই রাজাবাড়ীহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা শাহ্ মোহাম্মদ যুবলীগের এক নেতার চাপে পড়ে সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধা ওই স্কুল প্রতিষ্ঠাতা দাতাদের মধ্যে অন্যতম। স্কুলটির প্রতিষ্ঠিত করার পেছনে তাঁর অবদান রয়েছে অনেক।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ও রাজবাড়ীহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের সদ্য পদত্যাগকৃত সভাপতি শাহ্ মোহাম্মদ বলেন, উপজেলা যুবলীগে অর্থ বিষয়ক সম্পাদক ও দেওপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বেলাল উদ্দিন সোহেল গত তিনমাস আগে থেকেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক পদ শূন্য থাকায় নিয়োগ দিতে চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। আমি শারিরীক ভাবে অসুস্থ থাকায় সময় চাই। তবুও তিনি নিজেও মঝে মধ্যে তার ঘনিষ্ঠদের দিয়ে শিক্ষক নিয়োগ দিতে চাপ প্রয়োগ করে আসছিলেন। একুটু সুস্থ হলেই আমি সকল নিয়ম কানুন মেনে বৈধ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ দিবো এমন বলা হলেও নিয়োগ দিতে প্রচন্ড চাপ থাকায় তাদের এই অবৈধ চাপের প্রতিবাদ জানিয়ে সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেছি। এই চাপ সহ্যের বাহিরে চলে গিয়েছিলো।
শূন্য পদে কাকে নিয়োগ দেওয়া হতে পারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, শুনেছি পিরিজপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের এক মহিলা শিক্ষককে নিয়োগ দেওয়া হতে পারে। তবে তিনি তার নামটি প্রকাশ করতে চাননি।
এ বিষয়ে দেওয়াড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবলীগের অর্থ বিষয়ক সম্পাদক বেলাল উদ্দিন বলেন, ওই স্কুলের নিয়োগ সম্পর্কে আমি কিছুই জানিনা বা শুনিনি। আমি ও বিদ্যালয়ের কমিটিরও কেউ না। কাউকে চাপ দিয়েছি এটিও ঠিক না। শুনেছি তিনি ওই স্কুলের সভাপতি ৬মাস আগেই পদত্যাগ করছিলো। আমাকে একবার ডেকেছিলো পদত্যাগ করবেন বলে। আমি তখন বলেছিলাম আপনি সম্মানিত ব্যাক্তি পদত্যাগ করবেন কেন। তবে কোন শিক্ষককে নিয়োগ দেওয়া হবে তাও জানা নেই বলে জানান।
বিশ্বস্তসূত্র জানায়, গোগ্রাম ইউনিয়নের বলিয়া ডাইং উচ্চ বিদ্যালয় ও গোগ্রাম আদর্শ বালিকা বিদ্যালয়েও কর্মচারী নিয়োগ দেওয়ার চাপ প্রয়োগ করছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা। তবে সেই চাপের মুখে নিয়োগ না দিতে অনড় রয়েছে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকরা।
বলিয়া ডাইং উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গীর কবির বলেন, উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মচারী নিয়োগ দিতে চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে এটা সবারই জানা। তাদের অবৈধ কর্মকান্ডে ও কথায় নিয়োগ প্রক্রিয়া না শুরু করায় বরখাস্ত ও চাকুরিচত্যু করারও হুমকি পাইছি। তাতে আমি ভয় পাইনি।
তিনি আরো বলেন, অন্যায় কাজ না করার জন্য যদি আমার চাকুরি চলে যায়তো যাক, কিন্তু আমি জাহাঙ্গীর কবির বলছি এসব কাজে আমি রাজি হবো না। আমাকে তারা আমার প্রাপ্য টাকা দিবেও বলে লোভ দেখিয়েছেন বলেন মন্তব্য করেন। তবে কোন নেতা চাপ প্রয়োগ করছেন সেটা বলেননি।
উপজেলার প্রেমতলী সুকবাসিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক ও কম্পিউটার ল্যাব এসিস্ট্যান্ট ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী পদে নিয়োগের জন্য গত ২৪ জুলাই পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। ওই স্কুলে প্রধান শিক্ষকপদে গ্রোগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আব্দুল বারিকে নিয়োগ দেওয়া হবে বলে গুঞ্জন আছে।
উপজেলার নলত্রি উচ্চ বিদ্যালয় ৫৬ লাখ টাকার বিনিময়ে চারজন কর্মচারীকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও অভয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকে ১০ লাখ এবং তিনজন কর্মচারী পদে ৩৬ লাখ। চয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ে তিনকর্মচারী নিয়োগে ৩৯ লাখ এবং কদমশহর উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকে ১২ লাখ, সহকারি প্রধান শিক্ষকে ১৫ লাখ ও ৩জন কর্মচারী নিয়োগে ১১-১২ লাখ টাকা নেওয়ার অভিযোগ আছে।
শহিদুন্নেসা উচ্চ বিদ্যালয়, চয়ন উচ্চ বিদ্যালয়, মোন কাশিমালা উচ্চ বিদ্যালয়ে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া সম্পন্ন হয়েছে। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করছে ব্রাহ্মগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয়, কাকনহাট উচ্চ বিদ্যালয়, মান্ডইল উচ্চ বিদ্যালয়, বিড়ইল উচ্চ বিদ্যালয়, রাজাবাড়ীহাট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়।
এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের চাপে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে পূর্ব নির্ধারিত তাদের প্রার্থীদেরকে নিয়োগ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলমান আছে বলে জানা গেছে।


প্রকাশিত: জুলাই ৩১, ২০২৩ | সময়: ৬:২৮ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ

আরও খবর