একদিন তিলোত্তমা ছিল না এই নগরী

সরকার দুলাল মাহবুব : কবি জীবনানন্দ দাশ একটি কবিতায় আশাবাদ ব্যক্ত করে লিখেছিলেন, ‘কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে।’ কিন্তু কবে হবে? সময়ের এই অনিশ্চয়তা গভীর সংশয়ে নিপতিত হয়ে পড়ে। সময় একটু লাগবে। অথবা অনেকটা সময়ও লাগতে পারে। কারণ সত্যদ্রষ্টা কবি স্পষ্ট বুঝেছিলেন, ‘সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ।’ ঠিক ‘বুদ্ধ’ কিংবা ‘কনফুসিয়াস’ এর মতো। অথবা আরো অনেক অনেক মনীষীদের কথা বলেছিলেন হয়তো।
কলকাতা নয়, আমরা আরেকটা নগরীকে ‘কল্লোলিনী তিলোত্তমা’ করে গড়ে তোলার কথায় প্রসঙ্গটার অবতারণা করেছি। নগরীটি বাংলার বরেন্দ্র জনপদের অন্যতম এক প্রাচীন নগরী রাজশাহী। এখানেও জন্ম নিয়েছেন ‘বুদ্ধ’ এবং ‘কনফুসিয়াস’ এর মতো মহোত্তম মনীষী। তিনি কবি জীবনানন্দ দাশের মতই সুন্দরের স্বপ্নদ্রষ্টা, সত্যদ্রষ্টা এক কবি। তিনি তিলে তিলে এই রাজশাহী নগরীটাকে গড়ে দিয়েছেন ‘কল্লোলিনী তিলোত্তমা’ করে। সকলেরই জানা এই মনীষীর নাম। তিনি হলেন এই নগরীর প্রিয় নগরপিতা এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। অনেকের কাছে তিনি শুধুই লিটন, কেউ আবার তাঁকে মেয়র লিটন বলে ডাকেন, অনেকে আরো আপন করে নিতে ডাকেন লিটন ভাই বলে।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ১৮৭৬ সাল থেকে ২০১৮ পর্যন্ত যাঁরা এই নগরীকে গড়ে তুলবার দায়িত্ব নিয়েছেন তাদের সবাইকে ছাপিয়ে উন্নতশীরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন সদ্য সাবেক নগরপিতা এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। রাজশাহী নগরীকে এক তিলোত্তমা নগরী করে গড়ে দিয়েছেন তিনি।
উত্তর বঙ্গের প্রাচীন শহর রাজশাহী। এই শহরের আলো-বাতাসে বেড়ে উঠেছেন তিনি। জন্ম নিয়েছেন রাজনৈতিক পরিবারে। বাবা ছিলেন জাতীয় নেতার অন্যতম। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট সহচর, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এএইচএম কামারুজ্জামান। তাঁরই ছেলে এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। রাজশাহীর মাটি-মানুষের সঙ্গে লিটন পরিচয়ে মিশে আছেন তিনি। বাবার মত তিনিও জাতীয় রাজনীতিতে পৌছেছেন আজ সগৌরবে। নগরপিতা হিসেবে দলবল নির্বিশেষে তিনি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন।
তিলোত্তমা এই নগরীর রূপকার এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন ২০১৮ সালে ৩০ জুলাই রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হন। নগরীকে বদলে দেবার অঙ্গিকার নিয়ে নির্বাচনে জনগণের বিপুল ভোটে মেয়র নির্বাচিত হন তিনি। ওই বছরের ৫ সেপ্টেম্বর রাজশাহী মেয়রকে শপথ বাক্য পাঠ করান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শতকোটি টাকা ঋণের বোঝা নিয়ে তিনি দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন।
দায়িত্ব নিয়েই নগরপিতা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন ও রাজশাহীকে একটি পরিচ্ছন্ন, উন্নত ও বাসযোগ্য মডেল নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ শুরু করেন। শুরুতেই সিটি কর্পোরেশনে শৃঙ্খলা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন মাসের শুরুতে প্রদান করতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন লিটন। এরপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন নগরীর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও সবুজায়নের দিকে। সবুজ আর ফুলেল নগরী রাজশাহী। পরিবেশ রক্ষায় বিশেষ অবদানের জন্য রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন তৃতীয়বারের মতো অর্জন করে জাতীয় পরিবেশ পদক ২০২১। দেশের সবচেয়ে পরিবেশবান্ধব শহর হিসেবে ‘এনভায়রনমেন্ট ফ্রেন্ডলি সিটি অব দ্য ইয়ার সম্মাননা’ ২০২০ অর্জনের খ্যাতিও অর্জন করেছিলেন তিনি এই নগরী গড়ে।
মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের নিরলস প্রচেষ্টায় রাজশাহীর যোগাযোগ ও অবকাঠামো উন্নয়নে এসেছে আমূল পরিবর্তন। প্রধান সড়কগুলোকে চারলেনে উন্নীত করা হয়েছে। নগরীর বুধপাড়া এলাকায় রেলক্রসিং এ নির্মিত হয়েছে রাজশাহীর প্রথম ফ্লাইওভার। সেখানে অবশিষ্ট দুই লেনের আরেকটি ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। নগরবাসীর চলাচল নির্বিঘ্ন করতে আরো ৫টি ফ্লাইওভার নির্মাণ করার ব্যবস্থাও নিয়েছেন তিনি। ইতোমধ্যে প্রস্তাবিত এসব ফ্লাইওভারের নকশা চূড়ান্ত হয়েছে। দেশের সিটি কর্পোরেশনগুলোর মধ্যে রাজশাহীতে সর্বপ্রথম টানেল নির্মাণের উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়েছে।
নগরীর আলিফ লাম মীম ভাটার মোড় থেকে বিহাস পর্যন্ত প্রায় ১২ কিলোমিটারের ফোরলেন সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। বিলসিমলা রেলক্রসিং থেকে কাশিয়াডাঙ্গা মোড় পর্যন্ত বাইসাইকেল লেন সহ আধুনিক চারলেন সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। নির্মিত হয়েছে বহুল প্রতীক্ষিত আলুপট্টি হতে তালাইমারী পর্যন্ত ফোরলেন সড়ক। নগর ভবন থেকে রাণীবাজার, মণিচত্বর থেকে সদর হাসপাতাল মোড় পর্যন্ত অনেক রাস্তা নাগরিকদের সুবিধার্থে প্রশস্ত করা হয়েছে অনেক ত্যাগের বিনিময়ে। প্রতিটি সড়কের পাশে প্রশস্ত ড্রেন, ফুটপাত এবং সড়কের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে দৃষ্টিনন্দন আইল্যান্ড তৈরি করা হয়েছে। এখনো নগরীর বিভিন্ন ড্রেন, ফুটপাত ও সড়কের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে উন্নয়ন কাজ চলমান রয়েছে। ছাতিম গাছের ছাতার ছায়াও পাচ্ছেন নগরবাসী।
উপশহর থেকে নগরভবন ও রাণীবাজার থেকে সাগারপাড়া সড়ক প্রশস্তকরণ, রেলস্টশন থেকে ভদ্রা হয়ে তালাইমারি সহ মহানগরীর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও ৩০টি ওয়ার্ডে বিভিন্ন সড়কের কার্পেটিং কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া ওয়ার্ডপর্যায়ে রাস্তা, ড্রেনসহ অবকাঠামো উন্নয়ন চলমান রয়েছে। নগরীর তালাইমারি থেকে কাটাখালি সড়ক ছয়লেনে উন্নীতকরণ, বন্ধগেট থেকে সিটি হাট ও ভদ্রা রেলক্রসিং থেকে নওদাপাড়া বাস টার্মিনাল পর্যন্ত সড়ক অযান্ত্রিক লেন সহ চার লেনে উন্নীতকরণের কাজ চলছে। নগরীর ১৯নং ওয়ার্ডে নির্মাণ করা হচ্ছে শেখ রাসেল শিশুপার্ক।
সিটি কর্পোরেশনের আর্থিক ভিত্তি শক্তিশালীকরণ, শিল্পায়ন ও বাণিজ্যের মাধ্যমে আয় বৃদ্ধি, মহানগরীর আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) এর আওতায় অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে উদ্যোগী সংস্থার অর্থায়নে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের কার্যক্রম অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। সোনাদিঘী ঘিরে চলছে নান্দনিক কাজ। পাশে ১৬ তলা ‘সিটি সেন্টার’ চালু হয়েছে। আটতলা ‘স্বপ্নচূড়া প্লাজা’ অবকাঠামো সম্পন্ন হয়েছে ও আটতলা ‘দারুচিনি প্লাজা’ নির্মাণ কাজ চলছে। মুড়িপট্টিতে ১০তলা বৈশাখী মার্কেটের অবকাঠামোর কাজও সম্পন্ন হয়েছে। পাঁচতলা বিলসিমলা সুপার মার্কেটের অবকাঠামো সম্পন্ন হয়েছে। রেশমপল্লী মার্কেটের কাজ সম্পন্ন শেষে দোকান বরাদ্দ করা হয়েছে।
নগরীর বিনোদনকেন্দ্রগুলোর উন্নয়ন করা হয়েছে। পদ্মাপাড়ের বিনোদন কেন্দ্রকে ঢেলে সাজানো হয়েছে। পর্যটকদের আকর্ষণ করতে বিচ বাইক ও বিচ চেয়ার চালু করা হয়েছে। অচিরেই বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার বিনোদনে যুক্ত করবে নতুন মাত্রা।
নাগরিক সেবা জনগণের দৌরগোড়ায় পৌঁছে দিতে সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন কার্যক্রম ডিজিটালাইজড করা হয়েছে। নগর ভবনে স্থাপন করা হয়েছে কন্ট্রোল এন্ড কমান্ড সেন্টার থেকে নগরীকে মনিটরিং করা হয়। সিটি কর্পোরেশনের হট লাইনে কল করে নাগরিকরা নিতে পারবেন বিভিন্ন সেবা, জানাতে পারেন বিভিন্ন সমস্যার কথাও। এছাড়া ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজের মাধ্যমে সহজেই নাগরিকদের সঙ্গে যেকোনো প্রয়োজনে যোগাযোগ করতে পারেন।
তিলোত্তমা। মাইথলজি বা পুরাণে বর্ণিত অপ্সরা। তিলোত্তমা মানে শ্রেষ্ঠত্বের ক্ষুদ্রতম কণা বা যার শ্রেষ্ঠত্ব সর্বোচ্চ গুণাবলী স্থিরীকৃত হতে পারে। আর ‘তিলোত্তমা নগরী’ মানে তেমনই শ্রেষ্ঠ গুণাবলী সম্পন্ন নিখুঁত সুন্দর এক নগরী। একদিন তিলোত্তমা নগরী হিসেবে গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। কথা ও কাজে প্রমাণ এখন নগরবাসীর চোখের সামনে। রাস্তাঘাট, প্রশাসন, সুন্দর ও সুশৃঙ্খল পরিবেশ সবকিছুর সমন্বয়ে নিখুঁত এক নগরী।
তাঁর শিকড় স্বাধীনতার কথা বলে; তাঁর চেতনা ও মননে সবসময় জেগে থাকে দেশপ্রেম। এই নগরীকে বাসযোগ্য করে তুলতে, সুন্দর সুনির্মল করতে তঁাঁর চিন্তা-ভাবনা সুদুরপ্রসারী। নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম ও সঠিক পদক্ষেপ নিয়েছেন। নগরীকে চারটি জোনে বিভক্ত করে সেবার মান একেবারে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছেন তিনিই তো নগরপিতা হওয়ার দাবিদার।
এমনিতেই রাজশাহী মহানগরী এখন বদলে যাওয়া অন্যরকম এক শহর। প্রায় দেড়শো বছরের পুরাতন এই শহর উন্নয়নে সৌন্দর্যে তড়িৎ গতিতে ৫ বছরে বদলে গেছে। প্রশস্ত সড়ক, পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, নির্মল বায়ু, সবুজ আর ফুলে ফুলে সাজানো সড়ক বিভাজক, কারুকাজ, উন্নত নাগরিক সুযোগ-সুবিধা, দৃষ্টিনন্দন রাতের আলোকায়ন এই নগরীকে করে তুলেছে আকর্ষণীয়। এসবের নিপুণ কারিগর এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। তিনি রাজশাহীকে দিয়েছেন অনেক কিছু। রাজশাহীবাসী যা ভাবেন নি কোনো দিন তার আগেই রাজশাহীবাসীর মনের মত করে এই শহরকে সাজিয়েছেন লিটন।
বর্তমানে দেশে বিভিন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচন চলছে। সিটি করপোরেশন, পৌর ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন স্থানীয় সরকার নির্বাচন। এসব প্রতিষ্ঠানের জনপ্রতিনিধিরা স্থানীয় উন্নয়ন ও তৃণমুলের জনগণের সেবা দিয়ে থাকেন। এসব নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগে জনগণের দায় আছে বৈকি। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে একমাত্র নির্বাচনের মধ্যদিয়ে জনগণের প্রত্যেক্ষ ভোটের মাধ্যমে দক্ষ, যোগ্য ও ভাল নেতৃত্ব তৈরী হয়। জনপ্রতিনিধি ও নেতৃত্ব নির্বাচনে গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিই হচ্ছে ভোট। একমাত্র জনগণই পারে নেতা পরিবর্তন করতে। তাহলে প্রকৃতপক্ষে নেতা নির্বাচনের সকল দায় জনগণেরই বর্তায়।
আজ ২১ জুন রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচন। দেশের মধ্যে এই সিটি করপোরেশন এখন স্বীকৃত একটি পরিচ্ছন্ন নগরী। এই নগরী আমাদের নগরী। এই নগরীতে বাইরের কোন মানুষ এবং নগরী থেকে ঘুরে গেছেন এমন মানুষ যখন বলেন, রাজশাহী নগরী খুব সুন্দর ও পরিপাটি-তখন মনটা ভরে উঠে। এ ক্ষেত্রে এই সুন্দর পরিপাটি নগরীর রূপকার এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনকে ধন্যবাদ না জানালে কার্পণ্য করা হবে। নগরবাসীকে সুন্দর নগরী উপহার দেয়ার জন্য অবশ্য তাঁকে অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানাই।
আশাকরি জনগণ তাদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করে এবারও যোগ্য প্রার্থী বেছে নিবে। একজন নিষ্ঠাবান পরীক্ষিত ব্যক্তিকেই নির্বাচিত করা ভোটারদের পবিত্র দায়িত্ব। সেইক্ষেত্রে ভোটের সূচকে নৌকার প্রার্থী অনেক এগিয়ে।
আজ রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোট। এবারো নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রার্থী হয়েছেন এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। চলমান উন্নয়নের ধারা তরান্বিত করার পাশাপাশি এবার তিনি জোর দিয়েছেন কর্মসংস্থানে। তাই তাকে নিয়েই সবার আশা, নতুন স্বপ্নপুরনের। তিনি রাজশাহী নগরবাসীকে অনেক দিয়েছেন। এখন দেয়ার পালা নগরবাসীর। আমরা বিশ্বাস করি, লিটনকে ভোট দেবার অনেক অনেক দায় রয়েছে নগরবাসীর।
লেখক- সিনিয়র সাংবাদিক


প্রকাশিত: জুন ২১, ২০২৩ | সময়: ৪:১৬ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ

আরও খবর