ইভিএম থেকে সরে আসা ইসির নিজস্ব সিদ্ধান্ত

সানশাইন ডেস্ক: প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল জানিয়েছেন, ইভিএম নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত নির্বাচন কমিশন সংখ্যাধিক্েযর মতামতের ভিত্তিকে সংসদ নির্বাচনে ব্যালট পেপারে ভোট নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কোনও দলকে ভোটে আনতে বা কারও চাপে কমিশন এমন সিদ্ধান্ত নেয়নি বলেও দাবি করেন তিনি।
বৃহস্পতিবার নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান সিইসি। আগাম নির্বাচন সম্পর্কিত গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর এবং ইভিএমের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে তিনি এ সংবাদ সম্মেলন ডাকেন। নির্বাচন ভবনে এ ব্রিফিংয়ে চার নির্বাচন কমিশনারÍআহসান হাবিব খান, রাশেদা সুলতানা, মো. আলমগীর ও মো. আনিছুর রহমানও উপস্থিত ছিলেন।
বিএনপিসহ সংলাপ বর্জন করা দলগুলোকে বরাবরই ভোটে আসার আহ্বান জানানো অব্যাহত থাকবে জানিয়ে সিইসি বলেন, ‘এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোকে ভোটে আনতে নিজেদের মধ্েয আলোচনা করে সংকট নিরসন করা। বড় কোনও দল নির্বাচনে না এলে তা লিগ্যালি সিদ্ধ হলেও পুরো লেজিটিমেট হবে না।’
তিনি বলেন, ‘কাউকে জোর করে ভোটে আনার বিষয়টি কমিশনের নয়। দলগুলোকে ভোটে আসতে শেষ পর্যন্ত আহ্বান অব্যাহত থাকবে। আগাম নির্বাচনের কোনও প্রস্তুতি নেই। এ বছরের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে আগামী বছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের লক্ষ্যে প্রস্তুতি এগিয়ে চলছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল জানান, শতভাগ সুষ্ঠু ভোট নিশ্চিত করা ইভিএমে যেমন সম্ভব নয়, ব্যালটেও পুরোপুরি সম্ভব নয়। বিষয়টা আপেক্ষিক হতে পারে। আমরা সবসময় বিশ্বাস করেছিলামÍ ব্যালটের চেয়ে ইভিএমে ভোট অনেক বেশি নিরাপদভাবে করা সম্ভব হয়। এটা যান্ত্রিক কারণে…।
ইভিএম নির্বাচনে কোনোভাবেই বড় চ্যালেঞ্জ নয় বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘ইভিএম মোটেই বড় চ্যালেঞ্জ নয়। আমাদের নির্বাচনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছেÍযে রাজনৈতিক সংকটটা বিরাজ করছে, নির্বাচনে সবাই বা প্রধানতম দলগুলো অংশ নেবে কিনা, সেটা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। ইভিএমে ভোট করলে পোলিং প্রসেস সহজ হয়। নির্বাচনে বড় দলগুলো একেবারেই অংশ না নিলে নির্বাচনের লিগ্যালিটি নিয়ে কোনও সংশয় হবে না।’
তবে লেজিটিমেসি শূন্েযর কোঠায় চলে যেতে পারে বলে উল্লেখ করেন কাজী হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেন, ‘এটা আপেক্ষিক। লেজিটিমেসি ও লিগ্যালিটি বুঝতে হবে। লিগ্যালি নির্বাচন শুদ্ধ হয়ে যাবে, কিন্তু লেজিটিমেট পুরোপুরি হবে না।’ সিইসি জানান, নির্বাচন কমিশন সবসময় আন্তরিকভাবে চায় সব দল ভোটে অংশ নিক। সে লক্ষ্েয ইসির প্রয়াস শেষ পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘কাউকে জোর করে আমরা আনতে পারছি না। কিন্তু যেটা করার সে অ্যাপিল করেই যাচ্ছি। আমাদের ডাকে সাড়া দেবেন তাও নয়। সংকটটা যদি রাজনৈতিক দলগুলোর হয়ে থাকে, অথবা সরকারি দলের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের হয়ে থাকে, আমরা বলবো যে রাজনৈতিক সংকটগুলো আপনারাই নিরসন করেন। তাহলে নির্বাচনটা সহজ ও ইসির জন্য অনুকূল হয়ে যাবে।’
রাজনৈতিক সংকট সমাধানে ইসির কোনও ভূমিকা না রাখার বিষয়টি আবারও স্মরণ করিয়ে দিয়ে সিইসি বলেন, ‘এখানে ইসি কোনও বড় রোল প্লে করতে পারবে না। এটাই আমাদের বড় রোলÍ প্লিজ আসেন, আসেন নির্বাচনে। আপনারা নিজেদের মধ্েয সংলাপ করুন, বিরাজমান দূরত্ব ও সংশয়, বিরোধ থাকলে তা মিটিয়ে ফেলেন। এক কথায় বলেছি, সব দল অংশগ্রহণ করলে গণতান্ত্রিক চেতনা থেকে সে নির্বাচন জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য ও অনেক প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে।’
এক প্রশ্নের জবাবে সিইসি জানান, ইভিএম থেকে সরে আসা হয়েছে সেদিন। এ নিয়ে নানা সংশয় বাজারে দেখা দিয়েছে। এটা কি চাপে করা হলো, নাকি এটা করা হলো, ওটা করা হলো। এটা নিয়ে কমিশন দীর্ঘ আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হয়েছে।
তিনি জানান, কোনও দলের প্রত্যাশা ছিল ৩০০ আসনে ইভিএম। পরে কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছেÍসর্বোচ্চ দেড়শ’ আসনে করবে। ইভিএমের প্রতি ইসির আস্থাটা অনেক বেশি। ইভিএমকে হ্যান্ডেল করেছে ইসি, রাজনৈতিক দলগুলো করেনি। প্রায় ১২শ’ নির্বাচন হলেও একটিতেও অভিযোগ পড়েনি যে ম্যানিপুলেশন হয়েছে, ম্যাল ফাংশনাল হয়েছে কোথাও, মেকানিক্যাল কথা বলা হয়Íএখানে ভূত আছে, ভানুমতির খেল আছে। ১০টা ভোট দিলে তিনটা এক জায়গায়, সাতটা অন্য জায়গায় যায়, এমন অভিযোগ আসেনি। আমরা বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করেছি, একেবারে অভিযোগ সত্য নয়। তারপরও অনেকের আস্থা নেই।
সিইসি জানান, কিন্তু তারপরও অর্থ পেলে দেড়শ’ আসনে করতাম। কিন্তু বৈশ্বিক আর্থিক সংকট। তাতে সরকার সংগত কারণে এগ্রি করতে পারেনি। পরে ১২শ’ কোটি টাকার প্রস্তাব দেওয়া হয় ইভিএম মেরামতের জন্য। তাতেও সরকার এগ্রি করতে পারেনি। এমন পরিস্থিতিতে ইভিএম থেকে সরে আসতে কমিশন দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে বলে জানান তিনি।
কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘আমরা দ্বিধাবিভক্ত হলাম, আলোচনা করলাম গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। দুজন কমিশনার বললেন, ২৫-৩০টা ইভিএমে করে ফেলি। আমরা দেখলাম, ইভিএমের লাইফটাও শেষ হয়ে আসবে, সে সময় হয়তো ম্যালফাংশন হলে একটা দোদুল্যমান অবস্থা আমাদের মধ্েয। তখন আমিও যুক্ত হলাম। আমরা ইভিএমে যাবো না, আরও দুজন সহকর্মী থাকলো। এটা সম্পূর্ণরূপে আমাদের সিদ্ধান্ত।’
এ সিদ্ধান্ত নিতে কোনও চাপ ছিল না উল্লেখ করে সিইসি বলেন, ‘এর বাইরে কোনও চাপে করা হয়েছে কিনা, বা বিএনপিকে ভোটে আগ্রহী করার জন্য করা হয়েছেÍএ ধরনের কোনও চিন্তা-চেতনা আমাদের মধ্েয ছিল না। দ্বিধাবিভক্ত ছিলাম আমরা। দুজন মতামত দিলেন ইভিএমের মাধ্যমে কিছু হোক, আমরা তিন জন বললামÍএটা অনিশ্চয়তা, এটা সমর্থন করছি না।’
সিইসি জানান, বেশ কিছু ইতিবাচক দিক ইভিএমে রয়েছে, ব্যালটে নেই। তুলনামূলক বলা যায়, ইভিএম বেশ ব্যয়বহুল, ব্যালট অতটা ব্যয়বহুল নয়। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে ইসির ত্রুটি থাকবে না দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমাদের চেষ্টার ত্রুটি থাকবে না। সুষ্ঠু ভোট করতে চেষ্টা করবো। এটা সত্য, ব্যালটে রিগিং প্রতিহত করা যতটা কষ্টকর, ইভিএমে মোটেই অতটা কষ্টকর নয়। যেমন অনেকে বলে থাকেÍব্যালটে রাতে ভোট হয়ে গেছে। সত্য-মিথ্যা আমি একেবারেই জানি না। কিন্তু পারসেপশন ক্রিয়েট করেছে রাতেও ভোট হতে পারে। ইভিএম কিন্তু সকাল ৮টার আগে চালুই হবে না, এটা সো অটোমেটিক। এখানে ন্যূনতম সম্ভাবনা ছিল না। ওদিক থেকে ইভিএমে বেশ কিছু ইতিবাচক দিক ছিল।’
সিইসি বলেন, ‘কেন্দ্রের নিরাপত্তা সবচেয়ে বেশি ভালো হয়Íনির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হলে। ধরেন কোনও দল অংশ নিলো না, একটা দল অংশ নিলো, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হবে সন্দেহ নেই। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো থাকলে কেন্দ্রে ভারসাম্য হয়, যা আর্মি নেভি র‌্যাব পুলিশ করে না। সেখানে ভারসাম্য রক্ষা করতে সনাতন পদ্ধতি হচ্ছেÍদল থাকবে, এজেন্ট থাকবে। কেন্দ্রের বাইরেরটা আমরা দেখতে পারবো। কিন্তু ভেতরেও কারচুপির সুযোগ থাকে। এটা রাজনৈতিক দলগুলো বুঝবে। অংশগ্রহণমূলক ভোটের জন্য তারা আলোচনা করে গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি এনে দিলে, আমাদের জন্য সহায়ক হবে।’
সিসি ক্যামেরা ব্যবহারের বিষয়ে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানান তিনি। এক প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, ‘আগাম ভোটের প্রশ্নই আসে না। আগাম নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণ করছি না। আমরা ভোটের প্রস্তুতি নিচ্ছিÍডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে অথবা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছি। আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি ডিসেম্বর এবং জানুয়ারির।’
দলগুলোকে ভোটে আসার জন্যে প্রচেষ্টার বিষয়ে তিনি জানান, দলগুলোকে আবারও অনানুষ্ঠানিক আলোচনার জন্েয ডাকা হয়েছে। সাংবাদিক নীতিমালা ও ভোটের দিন মোটরসাইকেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি জানতে চাইলে সিইসি তা এড়িয়ে যান। এখন এ নিয়ে আলোচনা করতে চান না তিনি।


প্রকাশিত: এপ্রিল ৭, ২০২৩ | সময়: ৫:২২ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ