সর্বশেষ সংবাদ :

সক্ষমতা বাড়লেও দেশে বীজের চাহিদা পূরণ হচ্ছে না

সানশাইন ডেস্ক: খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় দানাদার খাদ্যশস্য গম ও ভুট্টার চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। ধানের চেয়ে কম খরচে অনেক বেশি উৎপাদন করা যায় এ দুটি ফসল। মুনাফাও দুই থেকে তিন গুণ বেশি। সেই লক্ষ্যে দিনাজপুরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট। কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে কৃষকের চাহিদা অনুযায়ী নতুন বীজ সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
প্রতিবছর এ দুটি ফসলের চাহিদা বাড়ছে ১৩ শতাংশ। দেশে গমের চাহিদা বছরে ৭৫ লাখ মে. টন আর উৎপাদন হচ্ছে ১২ লাখ মে. টন। পাশাপাশি ভুট্টার চাহিদা ৭০ লাখ মে. টন আর উৎপাদন হচ্ছে ৫৫ লাখ মে. টন। নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনের ফলে বেড়েছে হেক্টরপ্রতি উৎপাদন। ফলে ফসল দুটি চাষাবাদে কৃষকদের আগ্রহও বেড়েছে। তবে প্রতিষ্ঠানটি সেই পরিমাণ প্রজনন বীজ দিতে পারছে না।
দেশের গম ও ভুট্টার উৎপাদন বৃদ্ধি নিশ্চিত করে খাদ্য পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে ২০১৭ সালের ২২ নভেম্বর আন্তর্জাতিক গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের আদলে দিনাজপুরে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট। এর আগে এখানে ছিল গম গবেষণা কেন্দ্র। নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন ও হেক্টরপ্রতি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে স্বাক্ষর রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে কৃষকদের জন্য যে পরিমাণে বীজ প্রয়োজন, তা মেটাতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি। নতুন নতুন জাত সরবরাহ করতে না পারায় সরকারের উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে।
প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটই একমাত্র রাষ্ট্রীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান, যারা বাংলাদেশের উৎপাদিত গমের শতভাগ জাত নিশ্চিত করেছে। এ ক্ষেত্রে কোনও বিদেশি বা স্থানীয় কোম্পানি বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভাবিত জাতের সমকক্ষ নয়। প্রতিষ্ঠানটি এ পর্যন্ত ৩৭টি গমের জাত উদ্ভাবন করেছে। আর ভুট্টার জাত উদ্ভাবিত হয়েছে ২৯টি।
দেশে পোলট্রি শিল্পের মূল উপাদান গম ও ভুট্টা। হাঁস-মুরগির খাবার, গবাদিপশুর খাবার, মাছের খাবারসহ বিভিন্ন পোলট্রির খাবার উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় ভুট্টা। শুধু তা-ই নয়, মাঠভুট্টা, মিষ্টি ভুট্টা (সুইটকর্ন), খই ভুট্টা (পপকর্ন) ও বেবিকর্নসহ ভুট্টার নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন হয়েছে। ভুট্টা থেকে তেল ও কর্নফ্লেক্স উৎপাদন হচ্ছে। এই দুটি ফসলের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। দুটি ফসল উৎপাদনে কৃষকরাও উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। কিন্তু তারা পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রজনন বীজ পান না।
সূত্র জানায়, দেশে বার্ষিক ৪০ থেকে ৪৫ হাজার মে. টন গম বীজের বিপরীতে বিএডিসিসহ রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান উৎপাদন করে ১৮ থেকে ২০ হাজার মে. টন বীজ। বাকি বীজ দেশি-বিদেশি অন্যান্য কোম্পানি থেকে কিনতে হয় কৃষকদের। প্রতিষ্ঠানটি থেকে প্রতিবছর গমের প্রজনন বীজ সরবরাহ করা হয় মাত্র ৫০ মে. টন। অথচ দেশে যে পরিমাণে গম আবাদ হয়, এ জন্য প্রজনন বীজ প্রয়োজন প্রায় ১৫০ মে. টন। তবেই বীজের চাহিদা পূরণ সম্ভব।
সূত্র আরও জানায়, দেশে বার্ষিক ভুট্টার বীজের প্রয়োজন ১০ থেকে ১২ হাজার মে. টন। এর মধ্যে বিএডিসি উৎপাদন করে মাত্র ২০ থেকে ২৫ মে. টন। বাকি বীজ কৃষকরা দেশি-বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে কেনেন। অথচ প্রতিবছর প্রতিষ্ঠানটি থেকে ২০০ মে. টন কৌলিক সারির বীজ সরবরাহ করার সক্ষমতা রয়েছে। এই পরিমাণ কৌলিক সারির বীজ সরবরাহ করলে বিএডিসিসহ রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো প্রয়োজনীয় বীজ সরবরাহ করতে পারবে। অথচ শুধু জমির অভাবে গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের কাছে সেই বীজ পায় না।
বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের জমি আছে ১৯.৫ একর। ৫০ মে. টন গম বীজ উৎপাদনের জন্য প্রতিবছর ১৫ থেকে ২০ একর জমি ধার নেওয়া হয়। বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বীজ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে কিন্তু এ জন্য জমি প্রয়োজন। প্রয়োজনীয় জমি প্রদান করা সম্ভব হলে প্রাথমিকভাবে বিএডিসিকে ২০০ টন কৌলিক সারির বীজ সরবরাহ করতে পারবে তারা।
কর্তৃপক্ষের একাধিক গবেষক জানিয়েছেন, বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট ইতোমধ্যেই অনেকগুলো উন্নত জাত অবমুক্ত করেছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় কৌলিক সারি রক্ষণাবেক্ষণ ও বিভিন্ন ধরনের ক্রস করে উপযুক্ত হাইব্রিড ভুট্টার জাত উৎপাদনের জন্য নিরাপদ দূরত্ব রাখা প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া অনেক কারিগরি দিক বিবেচনায় আনতে হয়। ভুট্টার হাইব্রিড জাত ও পর্যাপ্ত বীজ উৎপাদনের জন্য প্রচুর জমির প্রায়োজন। প্রতিষ্ঠানের অধীনে মাত্র ১৯ দশমিক ৫ একর জমি রয়েছে, যা থেকে কিছু গমের প্রজনন বীজ তৈরি করা হয়। তবে ভুট্টার প্রজনন বীজ করা বা কৌলিক সারির বীজ উৎপাদনের কোনও জমি নাই।
গবেষণায় নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন হলেও সেগুলো সম্প্রসারিত হচ্ছে না। কৃষকরা তাদের চাহিদামাফিক গবেষণায় প্রাপ্ত উন্নত বীজ পাচ্ছেন না। তবে ইনস্টিটিউট-সংলগ্ন বন্ধ ঘোষিত চিনিকলগুলোর হাজারে হাজার একর জমি পড়ে আছে। সেগুলো ইনস্টিটিউটের আওতায় আনলে গম-ভুট্টার উৎপাদন নিশ্চিত করা যাবে বলে জানায় কর্তৃপক্ষ।
তারা জানান, এ জন্য মন্ত্রণালয়ে আবেদনও করা হয়েছে। কিন্তু তা আলোর মুখ দেখেনি। ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানটি সরকারকে প্রয়োজনীয় জমি চিহ্নিত করতে অনুরোধ করেছে। এর মধ্যে দিনাজপুর, রাজশাহী ও জামালপুর অঞ্চলে আনুমানিক এক হাজার একর জমি রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট গবেষকরা জানিয়েছেন, গম ও ভুট্টার পুষ্টিমান ও উৎপাদন ধানের চেয়ে অনেক বেশি। মুনাফাও কমপক্ষে যথাক্রমে ২ ও ৩ গুণ বেশি। ধানে কীটনাশক ও পানির পরিমাণ বেশি প্রয়োজন হয়। সে ক্ষেত্রে গমের কম হয়। এক কেজি ধান উৎপাদন করতে প্রয়োজন হয় ৩ হাজার লিটার পানি, সেখানে সমপরিমাণ গমের জন্য প্রয়োজন ৪০০ থেকে ৫০০ লিটার। আর ভুট্টার লাগে ৭০০ থেকে ৮০০ লিটার।
দেশে সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয় বোরো ধান। চলতি মৌসুমে চালের গড় উৎপাদন প্রতি হেক্টরে ২ দশমিক ৮৯ মে. টন। সেখানে গমের উৎপাদন হেক্টরপ্রতি ৩ দশমিক ৬৫ ও ভুট্টার উৎপাদন হেক্টরপ্রতি ১০ দশমিক ২০ মে. টন আর খরিপ মৌসুমে ৭ দশমিক ৭৫ মে. টন।
দিনাজপুর সদর উপজেলার সুন্দরবন ইউনিয়নের রামডুবি এলাকার কৃষক দবিরুল ইসলাম বলেন, ‘গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটটি আমাদের বাড়ির পাশেই অবস্থিত। এখানে উন্নত জাতের গম ও ভুট্টার বীজ উদ্ভাবন হলেও সেগুলো আমরা পাই না। ফলে বাধ্য হয়ে বিদেশি কোম্পানির বীজ কিনতে হয়।’
চেহেলগাজী ইউনিয়নের গোপালগঞ্জ এলাকার কৃষক ফরিদ উদ্দিন বলেন, ‘এই প্রতিষ্ঠানের বীজের মান ভালো, ফলন ভালো ও রোগবালাই প্রতিরোধী। কিন্তু এখানকার বীজ তো বাজারে পাওয়া যায় না। যদি এই বীজ বাজারে পাওয়া যেতো, তাহলে এই বীজ ব্যবহার করতাম।’ বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মাহফুজ বাজ্জাজ বলেন, ‘এখন পর্যন্ত যেসব জাত উদ্ভাবন হয়েছে, সেসব উচ্চ ফলনশীল, রোগবালাই প্রতিরোধী, ভিটামিন ও জিংক সমৃদ্ধ, ব্লাস্ট ও মরিচা প্রতিরোধী এমন অনেক গুণাগুণ রয়েছে। নতুন নতুন বীজ উদ্ভাবনে আমাদের অনেক সাফল্য রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি ও বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) মাধ্যমে এসব জাত সম্প্রসারণের কাজ চলছে। এসব জাত সম্প্রসারিত হলে এই দুটি ফসলের উৎপাদন বাড়বে। ফলে কৃষকদের মাঝে গম ও ভুট্টা আবাদের আগ্রহ ফিরবে। কিন্তু জমি-সংকটের কারণে সেটা পারছি না। এই সংকট দূর হলে আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণ হবে। এতে কৃষকদের আগ্রহ বাড়বে, উৎপাদন বাড়বে; আমদানিনির্ভরতা কমবে।’
বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. গোলাম ফারুক বলেন, ‘গম ও ভুট্টা চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট জনগণের পুষ্টির নিরাপত্তা ও দৈনন্দিন ব্যবহারের দিকে লক্ষ রেখে নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করেছে। উচ্চ ফলনশীল, তাপসহিষ্ণু, দুর্যোগ ও রোগসহনশীল, ভিটামিন-সমৃদ্ধ জাতের পাশাপাশি মিষ্টি ভুট্টা, খই ভুট্টা, পপকর্ন ও বেবিকর্নের একাধিক জাত উদ্ভাবন করেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘নতুন হাইব্রিড জাত উৎপাদনের জন্য অস্ট্রেলিয়ান সরকারের সহযোগিতায় কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। এগুলোর অধিক উৎপাদনের লক্ষ্যে ভালো জাত ও কৌশল উদ্ভাবনপ্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এখন আমাদের জমির প্রয়োজন। নতুন নতুন জাতের জন্য প্রজনন বীজ করা যাচ্ছে না জমির অপ্রতুলতার কারণে। তবে আমরা আশাবাদী জমি পাওয়া গেলে কৃষকদের চাহিদামাফিক বীজ সরবরাহ করতে পারবো।’


প্রকাশিত: নভেম্বর ২৭, ২০২২ | সময়: ৬:৩২ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ