সর্বশেষ সংবাদ :

বীর মুক্তিযোদ্ধাকে ‘অসম্মান’ করে ইউজিসির চিঠি নিয়ে রাবিতে তোলপাড়

নিজস্ব প্রতিবেদক : বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) একটি চিঠিতে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারকে পাঠানো এক চিঠিতে বীর মুক্তিযোদ্ধার আগে ‘বীর’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি।
রাষ্ট্রীয় আইন অমান্য করাসহ ওই চিঠিতে সরকারি চাকরি আইনের অপব্যাখ্যা করারও অভিযোগ ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয় আইনের প্রতিও অসম্মান দেখানো হয়েছে ওই চিঠিতে। যা নিয়ে সমালচনার ঝড় উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন মহলে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চাকরির বয়স বাড়ানো নিয়ে দুইজন শিক্ষকের অভিযোগের প্রেক্ষিতে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, নাট্যকার ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মলয় কুমার ভৌমিককে নিয়ে ইউজিসি গত ১৭ অক্টোবর ‘বিতর্কিত’ এক চিঠি দেয়। ইউজিসি সচিব ড. ফেরদৌস জামান স্বাক্ষরিত চিঠি পাঠানো হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের কাছে। ওই চিঠিতে বীর মুক্তিযোদ্ধা মলয় কুমার ভৌমিককে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ বলা হলেও ‘বীর’ উল্লেখ করা হয়নি। এতে ‘বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট আইন, ২০১৮’-এর ২(১১) ধারা অমান্য করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০২০ সালের ২৯ অক্টোবর ‘বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট আইন, ২০১৮’-এর ২(১১) ধারায় মুক্তিযোদ্ধাদের ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। আইনের এই ধারার ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে ইউজিসির চিঠিতে।
জানতে চাইলে ইউজিসির সচিব ড. ফেরদৌস জামান বলেন, ‘চিঠি তো সচিব তৈরি করে না। যিনি চিঠি তৈরি করেছেন এটা তার ভুল হয়েছে। প্রতিদিন একশ-দুইশ চিঠিতে স্বাক্ষর করি। বীর মুক্তিযোদ্ধাকে অবশ্যই বীর মুক্তিযোদ্ধা লেখা উচিত। আমার বাবাও একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।’
ইউজিসির চিঠিতে বলা হয়, “রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মলয় কুমার ভৌমিককে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১২ সালের ১০ জুলাই সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার চাকরির বয়স দুই বছর বৃদ্ধি করে ৬৫ থেকে ৬৭ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে মর্মে একটি অভিযোগপত্র পাওয়া গেছে।
উল্লেখ্য, ‘সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮’-এর ১(৩)(ঘ) এবং ২ (১৬) ধারা অনুযায়ী সরকারি কর্মচারী বলতে উক্ত আইনের আওতাভুক্ত প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত কোনও ব্যক্তিকে বোঝানো হয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োজিত ব্যক্তিগণের জন্য এ আইন প্রযোজ্য নয়।”
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষক-কর্মচারীর বয়স বাড়ানো হলেও শুধু অধ্যাপক মলয় ভৌমিকের বিষয়ে এ ধরনের অভিযোগ সাম্প্রদায়িক চিন্তা থেকে করা কিনা জানতে চাইলে ড. ফেরদৌস জামান বলেন, ‘নিঃসন্দেহে। তা না হলে এ ধরনের অভিযোগ আসবে কেন? উনারা (অভিযোগকারী) ওই ধরনের লোক বিধায় অভিযোগ আসছে। আর কারও নাম দেওয়া হয়নি অভিযোগে।’
চিঠিতে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ শব্দটির আগে ‘বীর’ শব্দটি যুক্ত করা হয়নি। এছাড়া সরকারি কর্মচারী বলতে ওই আইনের আওতাভুক্ত প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত কোনও ব্যক্তিকে বোঝানো হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। অথচ ২০১৮ সালের চাকরি আইনের ১ উপধারা ৩ উল্লেখ করা হয়নি।
আইনের ১-এর ৩ উপধারায় বলা হয়েছে, ‘অন্য কোনও আইন, চুক্তি বা সমজাতীয় দলিলে ভিন্নরূপ কোনও বিধান না থাকিলে, এই আইনের বিধানাবলি নিম্নবর্ণিত কর্ম বা কর্ম বিভাগ বা উহাতে নিয়োজিত ব্যক্তিগণের জন্য প্রযোজ্য হইবে না, যথা: (ক) সংবিধান দ্বারা সৃষ্ট কোনও চাকরি বা পদ; (খ) বিচার-কর্ম বিভাগ; (গ) প্রতিরক্ষা-কর্ম বিভাগ; (ঘ) পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়; (ঙ) জাতীয় সংসদ সচিবালয়; (চ) বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট; (ছ) নির্বাচন কমিশন সচিবালয়; (জ) স্ব-শাসিত সংস্থা ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান; (ঝ) স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান; (ঞ) সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প, কর্মসূচি বা অনুরূপ কোনও কার্যক্রমের আওতাধীন চাকরি; এবং (ট) অ্যাপ্রেনটিস, চুক্তি বা এডহকভিত্তিক অথবা অন্য কোনও প্রকার অস্থায়ী, সাময়িক বা খণ্ডকালীন চাকরি।’
অর্থাৎ এসব প্রতিষ্ঠান সরকারি চাকরি আইনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। অথচ সরকারি চাকরি আইনের এই ধারায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয় নিজস্ব আইনে সুনির্দিষ্ট করা হলেও তা উল্লেখ করা হয়নি ইউজিসির চিঠিতে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক বলেন, শুধু মলয় কুমার ভৌমিককে নয়, অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষক-কর্মচারীর চাকরির বয়স বাড়ানো হয়েছে। শুধু তার বিরুদ্ধে আইনের অপব্যাখ্যা করে ইউজিসিতে চিঠি দেওয়া হয়েছে সাম্প্রদায়িক কারণে। অধ্যাপক মলয় কুমার ভৌমিক শিক্ষাবিদ, অভিনেতা, লেখক, সাংবাদিক, নাট্যকার ও নাট্যনির্দেশক। তিনি সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১৭ সালের বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন।
এছাড়া তিনি বাংলা একাডেমির একজন ফেলো। নাটকে বিশেষ অবদান রাখায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি তাকে ‘শিল্পকলা পদক-২০২০’ প্রদান করে। ১৯৯২ সালে ঢাকার লোক নাট্যদল তাকে নাট্যকর্মী পদক প্রদান করে। এছাড়া বাংলাদেশে পথনাটক আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃত তিনি। এসব কারণে সাম্প্রদায়িক লোকজন তাকে বিতর্কিত করতে চাচ্ছে। আর তা না বুঝেই ইউজিসি প্ররোচিত হয়েছে।
এদিকে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক মো. আবদুস সালাম ইউজিসির চিঠির জবাব দিয়েছেন। তিনি জবাবে বলেছেন, ‘২০১২ সালের ৩০ জুন অনুষ্ঠিত ৪৪২তম সিন্ডিকেট সভার ৫২ নম্বর সিদ্ধান্তে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত বীর মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষকদের অবসর গ্রহণের বয়স ৬৫ থেকে ৬৭ এবং কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবসর গ্রহণের বয়স ৬০ থেকে ৬২ বছর করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৩ সালের ২৩ ও ২৪ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ৪৫০তম সিন্ডিকেট সভার ১৫০ নম্বর সিদ্ধান্তে কর্মরত বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের অবসর গ্রহণের বয়সসীমা ৬২ বছর থেকে ৬৩ বছর করা হয়।
এই সিদ্ধান্তের পর বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক মলয় কুমার ভৌমিকসহ পাঁচ জন শিক্ষক, ১০ জন কর্মকর্তা এবং পাঁচ জন কর্মচারীকে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বর্ধিত বয়সসীমা পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চাকরি করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।’
রেজিস্ট্রারের জবাবে আরও বলা হয়, সরকারি চাকরি আইন-২০১৮ অনুসারে নয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন-১৯৭৩ সালের আইনের ক্ষমতা বলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অবসর গ্রহণের সময়সীমা বর্ধিতকরণ সম্পর্কিত অর্ডিন্যান্স ও বিধি প্রণয়ন করা হয়েছে।
জানতে চাইলে অধ্যাপক মলয় ভৌমিক বলেন, ‘আমি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ করেছি। ১৯৯৬ সালে জনতার মঞ্চে ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাকে যখন গ্রেপ্তার করা হয় তখন আন্দোলন করেছি, জেল হাজতে গিয়েছি। আমি কখনও কিছু চাইনি। আমার কোনও চাওয়া নেই। যারা অভিযোগ করেছেন তারা সাম্প্রদায়িক শক্তি।
তিনি বলেন, ২০১৮ সালের সরকারি কর্মচারী আইনে স্পষ্ট বলা আছে এটা অন্যদের জন্য প্রযোজ্য নয়। অন্যরা কারা তা ওই আইনের বলা আছে। চিঠি যারা দিয়েছেন, তাদের আইন বিষয়ে কোনও ধারণা নেই প্রতীয়মান হচ্ছে। স্বাধীনতাবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক শক্তি পরিকল্পিতভাবে এটা করেছে। আর ইউজিসি তাদের দ্বারা প্ররোচিত হয়েছে বলেও প্রতীয়মান হয়।’


প্রকাশিত: নভেম্বর ২, ২০২২ | সময়: ৬:১২ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ