‘শিক্ষক, কোচিং ও ভাইয়া’ সিন্ডিকেটের ফাঁদে রাজশাহীর শিক্ষার্থী অভিভাবক

শাহ্জাদা মিলন

রাজশাহীকে বলা হয় শিক্ষা নগরী। এখানে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঘিরে প্রায় দুই দশক আগেই গড়ে উঠে কোচিং ব্যবসা। কয়েক বছর ধরে পাঠদানের নতুন আরেকটি পদ্ধতি চলছে। সেটি হলো বিভিন্ন ভাইয়ার ব্যাচে কোচিং। রাজশাহী শহর ঘুরে প্রায় অর্ধশতাধিক ভাইয়া ও কোচিং সেন্টার ও কয়েকজন শিক্ষকের অনুসন্ধান করে বিভিন্ন তথ্য বেরিয়ে এসেছে। জানা গেছে বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এই কোচিং গুলোর শিক্ষক। শিক্ষকদের ক্লাস প্রতি সম্মানী দেয় ভাইয়া ও কোচিং চালানোর সাথে সংশ্লিষ্টরা। আর শিক্ষার্থীদের অভিযোগ তুলছেন তাদের কিছু শিক্ষকদের উপর। যদি কেউ না পড়ে তবে মার্ক কম দেয়া হতে পারে।

 

 

তানোর উপজেলা থেকে শারিরীক ভাবে গুরত্বর অসুস্থ জুলফিকার আলী এসেছেন তার এসএসসি পরীক্ষার্থী দিচ্ছে ছেলের জন্য কোচিং করাবেন রাজশাহীতে। এইচএসসিতে ভালো কলেজে চান্স পাওয়ানোর জন্য ভর্তির খোঁজ নিচ্ছিলেন। তিনি জানান, কোচিং গুলোতে যে খরচ তাতে বাচ্চাকে পড়াতে পারলাম না। আর ভাইয়াদের বিভিন্ন রকমের আলাদা সিস্টেম। এক ভাইয়া গণিত পড়াবে তো আরেক ভাইয়া ফিজিক্স,কেউ বাংলা পড়াবে তো আরেকজন অর্থনীতি। ইংলিশ আলাদা, রসায়ন আলাদা। এটা কোন সিস্টেম পড়ালেখা চলছে বুঝে আসছেনা। ব্যক্তিগত লাভ করছে কোচিং আর ভাইয়া সিন্ডিকেট মিলে। মাঝখানে আমরা অভিভাবকরা বেকায়দায়। পড়ালেখা না করালে ভবিষ্যতে কিছু করতে পারবে না সন্তান। আবার না পড়ালে কিভাবে চলবে সে।

 

 

 

ভর্তির জন্য অগ্রীম এককালীন টাকা বন্ধ করা হোক বলে তিনি দাবি জানান। অগ্রিম টাকা না নিয়ে মাসে মাসে বেতন নিলে অনেকের জন্য ভালো হয়। এমনিতে সবকিছুর খরচ বেশি। এখন বই খাতার দাম বেশি। প্রাইভেটের বেতন বেশি। আমার মতো গরীব মানুষের ছেলে মেয়েরা অগ্রীম টাকা দেয়ার অভাবে লেখাপড়া করবেনা? এটা জোরালো ভাবে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর দেখা উচিত বলে জানান।

 

 

 

বাগমারা উপজেলা থেকে মেয়েকে নিয়ে এসেছেন মো: আলী আকবর। তার মেয়ে এসএসসি ও এইচএসসিতে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছিলো। প্রথমবার রাজশাহীর আরেকটি নামকরা কোচিং সেন্টারে দিয়েছিলেন তবে কোথাও চান্স না পাওয়ায় এবার মেডিকেলের জন্য আবারো রাজশাহীতে এসেছেন। তিনি জানান,আত্নীয়ের বাড়িতে রেখে মেয়ে আপাতত কোচিং করাবেন শহরে। সামান্য বেতনে ও জমিজমা থেকে যা আসে তা দিয়ে কোন রকমে চলে। বড় মেয়েকে নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন। মেডিকো কোচিংয়ে ভর্তি করিয়েছেন এবার (এক্সাম ব্যাচে)।

 

 

 

 

তিনি বলেন, কোচিংগুলো সিন্ডকেট করে ব্যবসা করছে। ব্যাচে পড়াবে অনেক শিক্ষার্থীদের নিয়ে। একজন যদি সর্বনিম্ন ৭০০০ টাকা দেয় তবে ৩০ জনের ব্যাচ হলে দুই লাখ দশ হাজার টাকা ফান্ডে জমা হচ্ছে। টিচাররা যদি ক্লাশ প্রতি ৪০০ টাকাও পায় ৫০ টা ক্লাশ ধরলেও মাত্র ২০ হাজার টাকা হচ্ছে। বই খাতা দিয়ে এক ব্যাচের সবার আরো ৫০ হাজার টাকা যোগ হলো। কোটিং সেন্টারের ভাড়া ও বাকি স্টাফ ২ থেকে ৩জনের বেশি লাগেনা তাহলে সারাদিনে ৫ থেকে ৬ টি ব্যাচ যদি পড়ায় মাসে গড়ে ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা লাভ করছে। সরকার এখান থেকে কতো টাকা ভ্যাট ট্যাক্স পায় সে বিষয়ে তিনি সন্দেহ প্রকাশ ও প্রশাসনের কঠোর মনিটরিংয়ের দাবি জানান।

 

 

 

রাজশাহী নগর ভবনের পশ্চিমে সবচেয়ে বড় কোচিং সেন্টার সান-ডায়াল অবস্থিত। ৩৫ বছর ধরে কোচিং করানো হচ্ছে যা তাদের লিফলেটে পাওয়া যায়। এখানে চতুর্থ শ্রেণী থেকে সর্বোচ্চ এসএসি পর্যন্ত ব্যাচ খোলা হয়েছে। ২০২২ সালের এসএসসি প্রিপারেশন এর লিফলেটে লেখা রয়েছে চলতি বছর ০৩ ও ০৪ জানুয়ারি ব্যাচ শুরু হয়েছে। তিনমাসের পরীক্ষা ব্যাচের কোর্স ফি ৮০০০ টাকা ও তিন মাসের ক্লাস ব্যাচের কোর্স ফি ৯০০০ টাকা। লোভনীয় অফার হিসেবে ৪ জানুয়ারির আগে ভর্তি হলে ৩০০০ টাকা কোর্স ফি থেকে ছাড় দেয়া হবে। এখানে সবগুলো বিষয় পড়ানো হয় বলে অভিভাবকদের চাহিদা বেশি ।

 

 

এই কোচিংয়ে গিয়ে এসএসসি ভর্তির বিষয়ে জানতে গেলে কর্মরত বাবু নামে একজন জানান, এখানে সিস্টেম হলো মাসে মাসে বেতন দিতে হয় অগ্রীম। এসএসসি জন্য দুই ধরনের নিয়ম রয়েছে। টেস্ট পরীক্ষার আগে এক ফি। আর টেস্ট পরীক্ষার পর আরেক ফি। তবে ভর্তির পর যদি কেউ ক্লাস না করে এখান থেকে চলে যায় বা অন্য কোথাও শিফট হয় তবে টাকা ফেরত দেয়ার নিয়ম নেই।

 

 

এই কোচিং সেন্টারের পাশের বিল্ডিংয়ে জাহিদ ফিজিক্স নামে আরেকটি প্রাইভেট সেন্টার রয়েছে। এখানে পদার্থ আর দুটি বিষয়ে পড়ানো হয়। রুয়েট থেকে পাশ করা ইঞ্জি.জাহিদুল ইসলাম এটি পরিচালনা করছেন। এখানে সরেজমিনে খোঁজ নেয়া হলে অফিসে থাকা রাশেদ নামে একজন জানান,আমাদের কাছে ভর্তি হতে হলে অগ্রীম তেরো হাজার টাকা জমা দিতে হয়। এখানে এসএসসি থেকে বিশ^বিদ্যালয় ভর্তি কোচিং করানো হয়। পুরো সিলেবাসের টাকা একবারের নেয়ার কারন জানতে চাইলে তিনি জানান, অন্য সব ভাইয়ারা এটা করছে। তাই আমরাও করছি।

 

 

 

শহীদ নজমুল হক বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের পশ্চিমে মেডিকো কোচিং সেন্টার। এটি ঢাকা থেকে পরিচালিত হচ্ছে বলে জানানো হয়। ক্যাডেট, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি, মেডিকেলসহ অন্যান্য পরীক্ষার জন্য এখানে ভর্তি নেয়া হয়। তাদের নিজস্ব বই দেয়া হচ্ছে।
এখানেও অগ্রীম টাকা দিতে হয় একবারে। এখানে ভর্তির কাগজপত্র দেখছিলেন মোসুমী নামে অফিসের কর্মি। তিনি জানান, বর্তমানে ভর্তি দুই ভাবে নেয়া হচ্ছে। নিয়মিত ব্যাচ ও পরীক্ষা ব্যাচ। নিয়মিত ব্যাচে বইসহ ৯৫০০ টাকা আর পরীক্ষা ব্যাচে ৭৫০০ টাকা। নিয়মিত ব্যাচ বলতে তিনি জানান যারা ক্লাশ করবে তাদের জন্য। পরীক্ষা ব্যাচ যারা শুধু পরীক্ষা দিবে ক্লাস করবে না। বই না নিলে শুধু পরীক্ষা দিবে তাদের জন্য ৫৫০০ টাকা।

 

 

এইচএসসি চলাকালীন সময়েই বুকিং দিতে হবে। অগ্রীম বুকিং না দিলে ভর্তির সুযোগ নেই। চাপ থাকে অনেক। যদি কোন শিক্ষার্থী অগ্রীম বুকিং দিয়ে এইচএসসিতে ফলাফল খারাপ করে তবে টাকা ফেরত দেয়া হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি জানান এ ধরনের কোন সুযোগ নেই টাকা ফেরতের।

 

 

 

মহানগরীর সোনাদিঘি মোড়ের মালোপাড়ায় মাসুদ স্যারের হিসাব বিজ্ঞান ও ফিনান্স প্রাইভেট কোচিং সেন্টার। পরিচালক মাসুদ রাজশাহী বিশ্ব বিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র। এখানে এইচএসসি পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য নেয়া হচ্ছে দশ হাজার টাকা। অর্ধেক পেমেন্ট অগ্রীম দিয়ে ভর্তি বাকি অর্ধেক পরবর্তীতে নেয়া হয়। একাউন্টিং ম্যানেজমেন্ট ও মার্কেটিং বিষয়ে ৩০ টি লেকচার সীট,সপ্তাহ ভিত্তিক পরীক্ষা নেয়া হয়।

 

 

শহরজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রেটিনা, উদ্ভাস-উন্মেষ,সাফল্য কোচিং সেন্টার, ইংলিশ লার্নিং সেন্টার, ক্রিয়েটিভ ম্যাথ ( বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি ),জনি বাংলা একাডেমি ও এডমিশন কেয়ার,সালমান ইংলিশ একাডেমি (বিশ^বিদ্যালয় ভর্তি ), ওবাইদুল ইংলিশ (বিশ^বিদ্যালয় ভর্তি),সজল ভাইয়ার সাধারন জ্ঞান (বিশ^বিদ্যালয়, মেডিকেল, বিসিএস ভর্তি কোচিং), সামির ম্যাথ ফাইনাল পিপারেশন ( এইচএসসি ১ম ও ২য় বর্ষ),ডা:তৌহিদের বাইলোজি ও মেডিকেল এডমিশন,নিউরন প্লাস মুকুল ভাইয়ের বিএসসি ও ডিপ্লোমা নার্সিং,প্রান্ত ফিজিক্স,চঞ্চল ফিজিক্স,আজমুল ইংলিশ,জুয়েল কিবরিয়া স্যারের (বাংলা) এইচএসসি ১ম ও ২য় বর্ষ,বিশ^বিদ্যালয় কোচিং,ইসমাইল কেমিস্ট্রি,শরীফ অর্থনীতি ও পরিসংখ্যানসহ আরো বিভিন্ন ভাইয়ার প্রাইভেট কোচিং সেন্টার সাইনবোর্ড দেখতে পাওয়া যায়।

 

 

শিক্ষার অবস্থা ও কোচিং বানিজ্য নিয়ে দেশের অন্যতম শিক্ষাবিদ রাজশাহী কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর হবিবুর রহমান বলেন, শিক্ষা হবে প্রাতিষ্ঠানিক। বর্তমানে শিক্ষাকে বানিজ্যকরণ করা হয়েছে। আমি এটার ঘোর বিরোধী। আমরাও শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়িয়েছি তবে সামান্য খরচে। আমি শিক্ষক থাকাকালীন সময়ে পরিবর্তন আনতে চেয়েছি লেখাপড়ায় যাতে কাউকে কোচিং না করতে হয়। নিয়মিত ক্লাশ করিয়ে রাজশাহী কলেজ দেশের সেরা হয়েছে।

 

 

বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েটে মেডিকেলে ভর্তির জন্য জিপিএ ফাইভকে একটি যোগ্যতা হিসেবে দেখা হচ্ছে  এটা উঠিয়ে দেয়া উচিত। কারন এখানে বলা হচ্ছে জিপিএ ফাইভ না পেলে শিক্ষার্থীর যোগ্যতা কম। যদি পরীক্ষাগুলোতে এই সিস্টেম উঠিয়ে দিয়ে সকলেই আবেদন করার সুযোগ পায় তাহলে জিপিএ ফাইভের প্রতি শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ কমে আসবে। শিক্ষার্থীরা প্রকৃত লেখাপড়া করবে। গোল্ডের পাওয়ার জন্য অতিরিক্ত চাপ নিতে হবে না। অভিভাবকদের দুশ্চিন্তা কমে আসবে।

 

 

তিনি জানান, কোচিং একটা ব্যাধি হয়ে দাড়িয়েছে আমাদের সমাজে। গোল্ডেং প্লাস বা জিপিএ ফাইভের জন্য এত ছোটাছুটি করানো উচিত নয়। যে ছেলেটা এবার ম্যাট্রিক দিচ্ছে তাকে উচ্চ মাধ্যমিকের জন্য অগ্রীম ভর্তি হতে হচ্ছে ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা দিয়ে। বিভিন্ন শিক্ষকের কাছে তাকে নাম লেখাতে হচ্ছে । আমি মনে করি কোন শিক্ষক বা কোচিং শিক্ষার্থী অভিভাবকদের নাম লেখাতে বাধ্য করছে তা রাজশাহী মহানগরী থেকে খুঁজে বের শুরু হোক। শুধু সার্টিফিকেট ভালো করলে এইসব শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তার বিষয় হয়ে দাড়াবে। কারন তাদের টার্গেট হচ্ছে  জিপিএ ফাইভ। এখানে সুশীল সমাজ, অভিভাবক, শিক্ষিত সমাজ মিলে বড় ধরণের সম্মেলন সভা করা উচিত। উচ্চতর জায়গা থেকে শুরু করা উচিত যারা জিপিএ ফাইভ নিয়ে ব্যস্ত।

 

অগ্রীম টাকা নিয়ে ভর্তির বিষয়ে তিনি বলেন, এটা অমানবিক। এটা কসাইয়ের কাজ। বানিজ্য করার জায়গা শিক্ষা নয়। কিছু শিক্ষক ও কোচিং সেন্টার ঠিক এই কাজ করছে। উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, আমরা মাস শেষে টাকা নিয়েছি সামান্য। এখন সিন্ডিকেট চলছে অগ্রীম তাও পুরো সিলেবাসের। যদি কোন সরকারি -বেসরকারি কর্মকর্তা কর্মচারী অফিসিয়াল কারনে কিংবা ব্যবসায়িক কারনে রাজশাহী ছাড়তে হয় তবে তার সেই অগ্রীম টাকা গুলো ফেরত দেয়া হচ্ছেনা। এসবের বিরুদ্ধে জোরালো পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

 

 

কোচিং করাতে আসা আরো কয়েকজন অভিভাবকদের সাথে কথা বললে তারা জানান, বাচ্চাদের হাত খরচ,পড়ালেখার খরচ দিতে গিয়ে অভিভাবকদের হিমশিম হতে হচ্ছে। ছেলে বাচ্চা হয়তো সাইকেলে অটো রিকশায় আসতে পারে। মেয়েদের একা ছাড়া সম্ভব না। ফলে আসা যাওয়ার খরচটাও বেড়ে যাচ্ছে। যার স্বামির মাসে আয় ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা সে কি করে অগ্রীম বারো তেরো হাজার টাকা দিবে এক সন্তানের জন্য অগ্রীম। বাকি সন্তান আর সংসার চলবে কিভাবে তাহলে। এমন প্রতারণার সিন্ডিকেট ভাঙ্গা দরকার ও অভিযান চালানো উচিত যারা এককালীন অগ্রীম টাকা নিয়ে শিক্ষাকে ব্যবসা বানিয়েছে।

সানশাইন / শামি


প্রকাশিত: অক্টোবর ৬, ২০২২ | সময়: ১০:০৯ অপরাহ্ণ | Daily Sunshine