সর্বশেষ সংবাদ :

২ মধুমালা তরমুজের বাণিজ্যিক চাষ

মতলুব হোসেন, জয়পুরহাট: বরেন্দ্র অঞ্চল হিসেবে খ্যাত আর ধান ও আলুর উৎপাদনের জন্য জয়পুরহাটের কালাই উপজেলা পরিচিত প্রাচীনকাল থেকে। তবে এই উপজেলায় নতুন করে, বাণিজ্যিক ভাবে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে মাচা পদ্ধতিতে বিদেশি নানান জাতের বর্ষাকালীন তরমুজের চাষ। কম খরচে বেশি লাভ হওয়ায় অন্য ফসল বাদ দিয়ে অসময়ে তরমুজ চাষে ঝুঁকছেন এলাকার কৃষকেরা।
অন্যসব ক্ষেতে তরমুজ যখন শেষ, তখন এই আগস্ট মাসে মাচায় মাচায় ঝুলছে চায়না ও থাইল্যান্ড দেশের মধুমালা আর তৃপ্তি জাতের তরমুজ। বাজারমূল্য অনেক ভালো হওয়ায় ধানসহ অন্যান্য ফসল বাদ দিয়ে কালচে ও হলুদ রঙের তরমুজ চাষে ঝুঁকে পড়ছেন এখানকার কৃষকরা। এই ফল ভিতরে লাল ও রসাল আর খেতে অনেক সুস্বাদু ও মিষ্টি হওয়ায় বাজারে এর চাহিদাও দিন দিন বাড়ছে।
বর্তমানে এ তরমুজ উপজেলায় চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি হচ্ছে ঢাকা, রাজশাহী, বগুড়া, নওগাঁ, নাটোর সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, কালাই সদর থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার পশ্চিম দিকে উপজেলার আহম্মেদাবাদ ইউনিয়নের হাজীপাড়া। উপজেলার হাতিয়র ব্লকের সেই হাজীপাড়ায় সবুজ মাঠ পেরিয়ে আঁকাবাঁকা জমির আইলপথ ধরে সামনে এগিয়েই পশ্চিম-হাজীপাড়া মাঠে চোখধাঁধানো বিদেশী জাতের তরমুজের রাজ্য। সেখানে চাষী সাগর হোসেন, বাবলু মিয়া, ছাইদুল ইসলাম ও সুজাউলসহ অনেকেই বিদেশী জাতের তরমুজের বীজ রোপনের অল্প দিনের মধ্যেই জমিতে গাছগুলো বেড়ে ওঠেছে। চাষীরা জমিতে বেড করে মাটির সঠিক আর্দ্রতা ধরে রাখতে মালচিং পেপার দিয়ে ঢেকে রেখেছে। জুন মাসে ১৮ ইঞ্চি পর পর চায়না ও থাইল্যান্ড দেশের মধুমালা আর তৃপ্তি জাতের তরমুজের বীজ রোপণ করেন কৃষকেরা। পুরো ক্ষেতে বাঁশের খুঁটি ওপরে চিকন দড়ি দিয়ে জালের মতো করে বিছিয়ে মাচা তৈরী করা হয়েছে।
বীজ রোপণের ৩০ দিনের মধ্যে গাছের লতা-পাতাগুলো মাচায় উঠেছে। রোপণের ৪০ দিনের মধ্যে গাছে গাছে প্রচুর হলুদ রঙ্গের ফুল ফুটেছে এবং অনেক গাছে কুড়িও এসেছে। প্রজাপতিরা এক ফুল থেকে অন্য ফুলে আপন মনে উড়ে গিয়ে বসছে আর মাচায় ওপরে গাছের সবুজ পাতার নিচে বোটায় ধরানো ছোট বড় অনেক পরিপক্ক তরমুজ ঝুলছে। তাদের নিবেদিত চেষ্টা, শ্রম, আর ঘামের প্রতিফলন সুরভিত হয়ে কাঙ্খিত ছোট-বড় অসংখ্য তরমুজ মাচায় মাচায় গাছের ডগায় ডগায় ঝুলে বাতাসে দুলঝে।
ঐসব তরমুজ ৩৫ দিনের পরিপক্ক হয়ে মাচায় ডোগায় ডোগায় ঝুলে আছে আড়াই থেকে চার কেজি ওজনের তরমুজ। এই তরমুজ দেখতে অনেকটা হলুদ রঙের মতো মনে হলে ভিতরে কিন্তু লাল টুকটুকে ও রসেভরা আর খেতে অনেক সুস্বাদু এবং মিষ্টি। এখানকার কৃষকেরা ব্যস্ত বিদেশি তরমুজ চাষ করতে। তাদের কোন প্রশিক্ষণ লাগেনি। তাই নিজেরাই বীজ সংগ্রহ করে নেমে পড়ে ছিলেন তরমুজ চাষ করতে।
এইসব তরমুজগুলো বিষ ও ফরমালিন মুক্ত পুষ্টিগুন সমৃদ্ধ তরমুজগুলো খেতে সু-স্বাদ, দেখতে আকর্ষণীয় ও চাহিদা বেশি, ভালো দাম থাকায় এবং লাভজনক হওয়ায় এই জাতের তরমুজ দেখতে ক্ষেতে ভিড় করেন অনেকেই। এখানকার কৃষকেরা বিদেশী জাতের এই তরমুজ চাষের সফলতা হওয়ায় অন্য এলাকায় অনেক কৃষকেরা তরমুজ চাষের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। অন্যান্য ফসলের মতো এটি বিক্রিতে সমস্যা হচ্ছেনা, তাই সরাসরি ব্যবসায়ীরা ক্ষেতে এসে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।
উপজেলার হাজীপাড়ার সফল তরমুজ চাষী মো. সাগর হোসেন বলেন, জয়পুরহাটের ভুতগাড়ী এলাকায় অন্যান্য ফসলের মতো জমিতে তরমুজ চাষ হচ্ছে তা জানতে পেরে সেখানে তরমুজ ক্ষেত গিয়ে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে মাচায় তরমুজ চাষের পরিকল্পনা নেই। আমার ৭০ শতাংশ জমিতে বেড করে মাটির সঠিক আর্দ্রতা ধরে রাখতে মালচিং পেপার পদ্ধতিতে জুন মাসে ২০ ইঞ্চি পর পর চায়না ও থাইল্যান্ড দেশের মধুমালা আর তৃপ্তি জাতের তরমুজের বীজ রোপণ করি। বীজ রোপণের ৩০ দিনের মধ্যে গাছ মাচায় উঠে যায়। রোপণের ৪০ দিনের মধ্যে গাছে প্রচুর ফুল ও কুড়ি আসে। তারপর ফলের ৩৫ দিনের পরিপক্ক হয়ে মাচায় ডোগায় ডোগায় ঝুলে আছে আড়াই থেকে তিন কেজি ওজনের তরমুজ। ঐ তরমুজ কাটলে ভিতরে লাল টুকটুকে, রসালো আর খেতে মিষ্টি ও খুব সু-স্বাদ। বর্তমান বাজারে এই তরমুজের চাহিদা অনেক বেশি, দামও ভালো আছে। প্রতিটি তরমুজ গড়ে আড়াইশো টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এপর্যন্ত খরচ হয়েছে প্রায় ১৮ হাজার টাকা। এতে সব কিছু খরচ বাদ দিয়ে আমার আয় হবে প্রায় ২ লাখ টাকা। সেখানে আরেক তরমুজ চাষী বাবলু মিয়া বলেন, এক সময় ধান, আলু, চিচিঙ্গা, বেগুনসহ অন্যান্য ফসল আবাদ করতাম।
জমিতে মাচায় করে তরমুজ চাষ করা যায় তা আমি জানতাম না। এখানে সাগর হোসেন, ছাইদুল ইসলাম ও সুজাউলসহ অনেকেই বিদেশী জাতের তরমুজ চাষ করছে,তা দেখে আমি এবার পরীক্ষামূলকভাবে ২ বিঘা জমিতে মধুমালা জাতের তরমুজের বীজ রোপণ করেছি। বিঘা প্রতি খরচ হয়েছে ৯ হাজার টাকা। এপর্যান্ত তরমুজ বিক্রি করেছি প্রায় ১লাখ ৯০ হাজার টাকা। সেখানে আরও তরমুজ বিক্রি হবে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা। সবকিছু মিলিয়ে প্রতি বিঘা জমিতে লাভ হবে প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা।
উপজেলার তরমুজ চাষের অনুপ্রাণিত কৃষক রবিউল ইসলাম ও রাফিউলসহ অনেকেই জানান, হাজীপাড়ার কৃষকেরা অসময়ে তরমুজ চাষ কি ভাবে করছেন তা দেখে ও পরামর্শ নেওয়া জন্য তারা এখানে এসেছেন। তরমুজ চাষী সাগর হোসেন, বাবলু মিয়া, ছাইদুল ইসলাম ও সুজাউল ইসলামের মতো তারাও আগামীতে এই ভালজনক তরমুজ চাষ করবেনা বলে তারা জানান।
স্থানীয় তরমুজ ব্যবসায়ী ইলিয়াস ও জাহিদুল ইসলাম জানান, কালাই উপজেলার উৎপাদিত তরমুজগুলো গুনগত মান অনেক ভাল। এই এলাকার তরমুজ বিষ ও ফরমালিন মুক্ত এবং খেতে খুব সু-স্বাদ, দেখতেও অনেক আকর্ষণীয়। তাছাড়া এখারকার তরমুজ ক্রেতাদের চাহিদা বেশি রয়েছে। তারা ক্ষেত থেকে প্রতি মণ তরমুজ ১ হাজার ৮শ টাকা দরে পাইকারী কিনছেন। এখানকার তরমুজ কিনে ঢাকা, রাজশাহী, বগুড়া, নওগাঁ, নাটোরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তারা পাঠান।
উপজেলার হাতিয়র ব্লকের দ্বায়িত্বে থাকা উপ-সহকারী কৃষি অফিসার ডি. কৃষিবিদ সাহাবুদ্দিন বলেন, আমরা উপজেলা কৃষি অফিসের মোটিভেশনের মাধ্যমে এলাকার কৃষকেরা অসময়ে মাচায় তরমুজ চাষ করে সাফল্য পেয়েছেন। আশা করছি আগামী বছরে অফ-সিজনে এই উপজেলা জুড়ে এ জাতের তরমুজ চাষের আরও বৃদ্ধি পাবে।
কালাই উপজেলার কৃষি অফিসার নীলিমা জাহান বলেন, উপজেলায় ১০ হেক্টর জামিতে মধুমালা ও তৃপ্তি জাতের তরমুজ চাষ হয়েছে। এলাকায় তরমুজ চাষের জন্য কৃষকদের উন্নত জাতের বীজ সংগ্রহের পরামর্শ এবং বালাইনাশক ব্যবহারে ক্ষেত্রে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। এই এলাকার কৃষকেরা নতুন পদ্ধতিতে তরমুজ চাষ করছেন। আগামীতে এই ফসল চাষ আরও বৃদ্ধি পাবে।
এই নতুন পদ্ধতিতে তরমুজ চাষ সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়া গেলে একদিনে যেমন তরমুজ সারাবছর পাওয়া যাবে, অন্যদিকে তরমুজ চাষিরা অর্থনৈতিক ভাবে অনেক স্বাবলম্বী হয়ে উঠবে।


প্রকাশিত: আগস্ট ১৪, ২০২২ | সময়: ৫:০৫ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ

আরও খবর