ধাঁধার নাম নাঈম

স্পোর্টস ডেস্ক: বাঁহাতি পেসার শফিকুল ইসলামের বলে একটু শাফল করে জায়গা করে নিলেন। শর্ট বল পুল করে ওড়াতে চাইলেন ছক্কায়। ঠিক মতো খেলতে পারলেন না, ব্যাটের ওপরের কানায় লেগে ক্যাচ গেল মিড অফে। মোহাম্মদ নাঈম শেখ একাদশে ফিরলেন বটে, তবে সুসময় ফিরল না। বরং আরও প্রলম্বিত হলো তার দুঃসময়।
৭ ইনিংসে রান স্রেফ ৫০। গড় ৮.৩৩, স্ট্রাইক রেট ৬৫.৭৮। সব মিলিয়ে ৭৬ বলে বাউন্ডারি কেবল তিনটি। কোনো বোলারের নয়, টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের প্রথম পছন্দের ওপেনার নাঈমের পরিসংখ্যান এটি। চলতি বিপিএল তার জন্য যেন হয়ে ওঠেছে দুঃস্বপ্ন।
রান হারিয়ে গেছে ব্যাট থেকে। আগে অন্তত এক প্রান্ত আগলে রাখতে পারতেন, এখন সেই কাজটাও করতে পারছেন না। গত বছরে টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ রান করা তরুণ যেন হয়ে উঠেছেন এবারের আসরের সবচেয়ে বড় ধাঁধা।
মূল দায় তারই। তামিম ইকবাল ও মোহাম্মদ শাহজাদের মতো অভিজ্ঞ দুই জন ওপেনার থাকায় স্বাভাবিকভাবেই মিনিস্টার ঢাকার উদ্বোধনী জুটিতে সুযোগ মেলেনি নাঈমের। কিন্তু তিনে যখন খেলেছেন, তখনও পারেননি নিজের দাবি জানিয়ে রাখতে। বরং ব্যাট হাতে ব্যর্থতায় পিছিয়ে গেছেন আরও। ব্যাটিং অর্ডারে পাননি নির্দিষ্ট পজিশন। দল ভালো শুরু পেয়ে গেলে কখনও কখনও তিনি হয়ে উঠেছেন যেন দলের আপদ, কোনো পজিশনেরই উপযুক্ত মনে হয় না তাকে!
সিলেটে দলের সবশেষ ম্যাচে শাহজাদ যখন জায়গা হারালেন একাদশে, তখনও ওপেনিংয়ে খেলানো হয়নি তাকে। উল্টো সেই ম্যাচে রাখা হয়নি একাদশেই। মিরপুরে ফিরে শুক্রবার ফরচুন বরিশালের বিপক্ষে বাঁহাতি ব্যাটসম্যান খেলেন প্রিয় পজিশন ওপেনিংয়ে, চলতি বিপিএলে প্রথমবার। রানের দেখা পাননি সেখানেও। শের-ই-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে টস জিতে ব্যাট করতে নেমে তামিম ও নাঈমের নতুন উদ্বোধনী জুটি টেকেনি বেশিক্ষণ।
মুজিব উর রহমান প্রথম বল ঠেকিয়ে পরেরটিতে দ্রুত একটি সিঙ্গেল নিয়ে নাঈম খোলেন রানের খাতা। পরের ওভারে শফিকুলের অফ স্টাম্পের বাইরের বলে ব্যাট পেতে দিয়ে থার্ড ম্যান দিয়ে পান চার। দুটি বল ডট খেলে এরপর ওই পুল এবং বিদায়। আরেকটি ইনিংসের হতাশাজনক সমাপ্তি। কোনো পজিশনেই তিনি মানিয়ে নিতে পারছেন না, রান পাচ্ছেন না কোথাও। পাওয়ার প্লের ভেতরে, মাঝের ওভারগুলোতে কিংবা শেষে- তার ব্যাট হাসেনি কখনও।
নাঈমের দুঃসময়ের শুরু বিপিএলের উদ্বোধনী দিন থেকেই। দিনের দ্বিতীয় ম্যাচে প্রথমবার মাঠে নামে ঢাকা। তামিম ও শাহজাদ ভালো শুরু এনে দেওয়ার পর নাঈমের দায়িত্ব ছিল স্রেফ সেটা টেনে নিয়ে যাওয়া। ব্যাটিং তখন ছিল সহজ, বল ব্যাটে আসছিল খুব ভালোভাবে। শুরুর জুটির সৌজন্েয ছিল দৃঢ় ভিত। কিন্তু সেটা কাজে লাগাতে পারেননি নাঈম। নবম ওভারে ক্রিজে গিয়ে ১১ বলে ফেরেন কেবল ৯ রান করে, ইনিংসে নেই কোনো বাউন্ডারি।
পরের ম্যাচে খেলেন চারে। এবার দ্বাদশ ওভারে ক্রিজে গিয়ে ৬ বলে করতে পারেন কেবল চার রান। পরের ম্যাচে তৃতীয় বলেই ক্রিজে যান। এই ম্যাচে তার ব্যাট থেকে আসে একটি বাউন্ডারি। কিন্তু থেমে যান একটি চার মেরেই। ৬ বলে রান ওই চারই। চতুর্থ ম্যাচে চলতি বিপিএলে বল ও রানের দিক থেকে নিজের সবচেয়ে বড় ইনিংসটি খেলেন নাঈম। দ্বিতীয় ওভারে ক্রিজে গিয়ে ৩০ বল টিকতে পারেন, করতে পারেন কেবল ১৫ রান! ইনিংসে নেই কোনো বাউন্ডারি।
পরের ম্যাচে ব্যাট করতে হয়নি। তামিম ও শাহজাদের জুটিই কাজ প্রায় শেষ করে ফেলে। তিনে নেমে কোনো বল খেলতে হয়নি ইমরান উজ্জামানের। এরপর সাতে নেমে এক চারে ৯ বলে নাঈম করেন ১০ রান। আসরে এটাই তারএকমাত্র একশ ছোঁয়া স্ট্রাইক রেটে খেলা ইনিংস। সিলেটে দলের প্রথম ম্যাচে পরিস্থিতি তাকে ঠেলে দেয় আট নম্বরে। এক প্রান্তে তামিম তখনও টিকে। নাঈমের কাজ ছিল থিতু ব্যাটসম্যানকে স্ট্রাইক দেওয়া। সেই কাজ ঠিকঠাক করতে পারেননি নাঈম। শেষ ওভারে তামিম খেলেন কেবল ১ বল।
শেষ ওভারে বিস্ময়করভাবে বিমার কাজ লাগাতে পারেননি নাঈম। যে কোনো জায়গায় পাঠানো যেত, এমন বল পাঠান সোজা বোলারে কাছে। ম্যাচের শেষ বলটি ছিল ফ্রি হিট, টাই করতে প্রয়োজন ছিল বাউন্ডারি। নিচু ফুল টস বলে নাঈম নিতে পারেন কেবল ১ রান। ঢাকার হাতের মুঠো থেকে সেদিন জয় ছিনিয়ে নেয় চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্স। ৫ বলে অপরাজিত ২ রান করার পর একাদশ থেকে বাদ পড়েন নাঈম। ঢাকায় ফিরে একাদশে ফিরলেও আত্মবিশ্বাস ফেরেনি, ব্যাটে রানও ফেরেনি। শরীরীভাষাতে ছিল স্নায়ু চাপে ভোগার স্পষ্ট ছাপ।
নাঈমের স্ট্রাইক রেট নিয়ে প্রশ্ন বরাবরের। তার ইনিংসগুলো সত্িযকার অর্থে কতটা কার্যকর, তা নিয়ে সংশয় জেগেছে অনেকবারই। তবুও এক প্রান্ত ধরে রাখার সক্ষমতার জন্য আপাতত তিনিই টি-টোয়েন্টিতে প্রথম পছন্দ। সেটি থাকবেন কি না, তা নিয়ে দ্বিধা জাগিয়েছে বিপিএলের নাজুক পারফরম্যান্স। এই টুর্নামেন্টের পরপরই আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ। তামিম আগেই বলে দিয়েছেন, আগামী ছয় মাস আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে খেলবেন না তিনি। নাঈমের ব্যাটে এমন ভাটার টান, নির্বাচকদের হয়তো খুঁজতে হবে দুই জন ওপেনার।
টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহই আছেন ঢাকার নেতৃত্বে। খুব কাছ থেকে তিনি দেখছেন সতীর্থ নাঈমের ব্যর্থতা। গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকে এই সংস্করণে বাংলাদেশের বাজে অবস্থার পেছনে সবচেয়ে বড় দায় টপ অর্ডারের। সেখানে রানে থাকা ব্যাটসম্যানের ছন্দ হারিয়ে ফেলে অধিনায়কের চিন্তার ভাঁজ নিশ্চিতভাবেই বাড়াচ্ছে। সময় যে ফুরিয়ে আসছে দ্রুত।


প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২২ | সময়: ৬:৪২ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ