সোমবার, ৯ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৫শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ।
সানশাইন ডেস্ক: ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের তুলনায় তৃতীয় ধাপে সংসদ সদস্যদের আত্মীয়-স্বজনরা অংশ নিয়েছেন বেশি।
প্রথম ধাপে ১৩ জন এবংদ্বিতীয় ধাপে ১৭ জন অংশ নিয়েছিল, তৃতীয় ধাপে সেটি বেড়ে ১৮ জনে দাঁড়িয়েছে বলে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ, টিআইবি। এই প্রার্থীদের মধ্যে একজন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই শাহাদাত হোসেনও প্রার্থী হয়েছেন।
সোমবার রাজধানীর ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে টিআইবির কার্যালয়ে প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ করে এই তথ্য তুলে ধরেন সংস্থাটির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের সহ-সমন্বয়ক রিফাত রহমান। আগামী বুধবার ১০৯টি উপজেলায় ভোট হওয়ার কথা ছিল। তবে ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত ও দুর্গত এলাকা বিবেচনায় দেশের ১৯ উপজেলা পরিষদের ভোট স্থগিত করেছে নির্বাচন কমিশন।
সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীর স্বজনরা যাতে উপজেলা নির্বাচনে অংশ না নেয়, সেজন্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তরফে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে আওয়ামী লীগ এবার কাউকে প্রার্থী করেনি, সমর্থনও করেনি। দলীয়ভাবে কাউকে বসিয়ে দেওয়ার উদ্যোগও নেই। তবে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের পরে বলেছেন, স্বজন বলতে স্বামী-স্ত্রী বা সন্তানকে বুঝিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নির্বাচনে কাউকে দলীয় প্রতীক না দেওয়া এবং প্রার্থিতা উন্মুক্ত করে দিয়েছিল ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ার চেষ্টায়। তবে বিএনপি ও সমমনারা জাতীয় নির্বাচনের মত এই নির্বাচনেও আসেনি। দলটির যেসব প্রার্থী ভোটে এসেছেন তারাও কাগজে কলম স্বতন্ত্র প্রার্থী, তাদেরকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
স্বতন্ত্র প্রার্থীদের এই নির্বাচনে প্রথম দফায় ভোট পড়েছে ৩৬ শতাংশের কিছু বেশি, তবে সেদিন ভোটারদের বাধা দান বা জাল ভোটের মতো অভিযোগ ছিল কম। বিএনপি যেসব নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ভোটে এসেছে, তারাও তেমন কোনো অভিযোগ করেননি। তবে একটি উপজেলায় এক আওয়ামী লীগ নেতা কারচুপির অভিযোগ এনে ভোট থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন, যদিও তার অভিযোগ সুনির্দিষ্ট ছিল না।
আর দ্বিতীয় ধাপের ভোটের হার ছিল কিছুটা বেশি, ৩৮ শতাংশ ভোট পড়ে সেদিন। এদিনও দিনভর ভোট হয়েছে শান্তিপূর্ণ। জাতীয় নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের মতো তৃতীয় ধাপেও ব্যবসায়ী প্রার্থীদের দাপট রয়েছে বলে জানিয়েছে টিআইবি। ব্যবসায়ী প্রার্থীদের সংখ্যা চতুর্থ নির্বাচনের তুলনায় ৭ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৮ দশমিক ১৪ শতাংশ।
যার মধ্যে চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ৬৬ দশমিক ৫৩শতাংশই ব্যবসায়ী, ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ৬৮ দশমিক ৯৯ শতাংশ, নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ৩১ দশমিক ৫৬ শতাংশ ব্যবসাকে পেশা হিসেবে দেখিয়েছেন। নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ৪৮ দশমিক ৫৪ শতাংশই গৃহস্থালির কাজকে পেশা হিসেবে দেখিয়েছেন।
গৃহস্থালি কাজকে পেশা হিসেবে দেখানো প্রার্থীদের সাড়ে ১৪ শতাংশের আয় আসে ব্যবসা থেকে। ১৫ দশমিক ১৪ শতাংশ প্রার্থীর কোনো না কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “মুনাফার সম্ভাবনা রয়েছে বলেই রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের আগ্রহ বাড়ছে, বাড়ছে স্থানীয় পর্যায়ে পরিবারতন্ত্র।
“জনপ্রতিনিধি হতে পারাকে বাজার নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে একদিকে যেমন ক্ষমতা অপব্যবহারের লাইসেন্স হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে, অন্যদিকে তেমনি সংশ্লিষ্ট খাতে সিদ্ধান্ত ও নীতিকাঠামোতে ব্যবসায়ী লবির প্রভাব ও স্বার্থ রক্ষিত হয়।”
নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ সার্বিক একটি পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছে টিআইবি। পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী- প্রথম দুই ধাপের মতো তৃতীয় ধাপের নির্বাচনেও অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের অধিকাংশই ‘আওয়ামী লীগ দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী’ এবং দলের স্থানীয় নেতৃত্বের সমর্থনপুষ্ট।
দলের নির্দেশনা উপেক্ষা করে দ্বিতীয় ধাপেও লড়ছেন বিএনপির স্থানীয় প্রার্থীরা। যদিও দলের নির্দেশ না মেনে বহিষ্কৃত হয়েছেন ৬১ জন। উপজেলা নির্বাচন দলীয় প্রতীকে রাজনৈতিক লড়াই হওয়ার কথা থাকলেও সেখানে দলগত অবস্থান প্রায় শূন্য। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নারীর অংশগ্রহণ জাতীয় নির্বাচনের তুলনায়ও কম। উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পদে তৃতীয় ধাপের নির্বাচনে নারী প্রার্থী আছেন ২০ জন। সার্বিকভাবে প্রার্থীদের ৩৭ শতাংশই আয় দেখিয়েছেন সাড়ে তিন লাখ টাকার নিচে, অর্থাৎ করযোগ্য আয় নেই তাদের। সাড়ে ১৬ লাখ টাকার বেশি আয় দেখিয়েছেন ১০ দশমিক ৫ শতাংশ প্রার্থী।
চেয়ারম্যান ও অন্যান্য প্রার্থীদের মাঝে উল্লেখযোগ্য ‘আয় বৈষম্য’ লক্ষ্য করা গেছে। চেয়ারম্যান প্রার্থীদের প্রায় ২৪ দশমিক ২১ শতাংশ প্রার্থীদের আয় সাড়ে ১৬ লাখ টাকার উপরে, যেখানে অন্যান্য প্রার্থীদের ক্ষেত্রে তা ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। চেয়ারম্যান প্রার্থীদের প্রায় ১৯ দশমিক ৫ শতাংশর আয় সাড়ে তিন লাখ টাকার নিচে। অন্যান্য প্রার্থীর ক্ষেত্রে তা এ হার ৪৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ। অর্থাৎ চেয়ারম্যান পদে অপেক্ষাকৃত ধনীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ বা ১০৬ প্রার্থীর কোটি টাকার বেশি সম্পদ রয়েছে। ৫ বছরে প্রায় ৪ গুণ হয়েছে কোটিপতির সংখ্যা। প্রায় ২২ দশমিক ৫ শতাংশ প্রার্থীর ঋণ রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৮৫ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে একজন চেয়ারম্যান প্রার্থীর। আইনি সীমার বাইরে জমির মালিকানা রয়েছে ৬ প্রার্থীর। প্রার্থীদের ১৬ শতাংশ প্রার্থী বর্তমানে বিভিন্ন মামলার অভিযুক্ত।
১০টির বেশি মামলায় অভিযুক্ত প্রার্থীর সংখ্যা ৭, একজন চেয়ারম্যান প্রার্থীর সর্বোচ্চ মামলা চলমান রয়েছে ২৭টি। তাদের বিরুদ্ধে আঘাত, জনগণের শান্তিভঙ্গ, ভীতিপ্রদর্শন, অপমান, উৎপাত, নারী ও শিশু নির্যাতন, প্রতারণার মামলা রয়েছে বা আগে ছিল। ৫ বছরে একজন চেয়ারম্যানের আয় বেড়েছে সর্বোচ্চ ১০ হাজার ৪২২ শতাংশ, ১০ বছরে এই বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ ২ হাজার ৮৮৯ দশমিক ৬৮ শতাংশ; অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে সর্বোচ্চ ১৮ হাজার ৭৯৩ শতাংশ, স্ত্রী ও নির্ভরশীলদের সম্পদ বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ ৫ হাজার ৪০০ শতাংশ।
৫ বছরে অস্থাবর সম্পদ বৃদ্ধিতে স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিরা পেছনে ফেলেছেন সংসদ সদস্যদের। একজন সংসদ সদস্যদের সম্পদ বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৬৫ শতাংশ, যেখানে একজন চেয়ারম্যানের সম্পদ বেড়েছে ৯ হাজার ৮৫০ শতাংশের বেশি।
উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে জয়ী প্রার্থীদের সঙ্গে নির্বাচিত হননি, এমন প্রার্থীদের গত ১০ বছরের আয় ও সম্পদ বৃদ্ধির তুলনা করলে দেখা যাচ্ছে, অনির্বাচিতদের তুলনায় আয় ১০ ও অস্থাবর সম্পত্তি প্রায় ৩৭ গুণ বেড়েছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের। অর্থাৎ ক্ষমতায় থাকার সঙ্গে দ্রুত আয় ও সম্পদ বৃদ্ধির প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।