সামরিক বাহিনীর পক্ষে মোশতাকের সাফাই ও জিয়ার তৎপরতা

সানশাইন ডেস্ক: ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পরপরই রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে খন্দকার মোশতাক বেতার ও টেলিভিশনে ভাষণ দেন। সেখানে তিনি সেনাবাহিনীর পক্ষে সাফাই গাওয়ার পাশাপাশি হত্যাকাণ্ড ও সরকার পরিবর্তনের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। এদিকে জিয়াউর রহমান সরাসরি হত্যাকাণ্ডের স্পটে উপস্থিত না থাকলেও এর পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে তিনি সরাসরি যুক্ত ছিলেন বলে তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের বিচারের সময় সাক্ষ্যদান ও বিচারকাজ পরিচালনার দায়িত্বে থাকা আইনজীবীর ব্যাখ্যায় তা উঠে আসে।
প্রথম দিনের ভাষণে খন্দকার মোশতাক বলেন, ‘দেশের শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তন সর্বমহলের কাম্য হওয়া সত্ত্বেও বিধান অনুযায়ী তা সম্ভব না হওয়ায় সরকার পরিবর্তনের জন্য সামরিক বাহিনীকে এগিয়ে আসতে হয়েছে। সশস্ত্র বাহিনী পরমতম নিষ্ঠার সঙ্গে তাদের দায়িত্ব সম্পন্ন করে দেশবাসীর সামনে সম্ভাবনার এক স্বর্ণদ্বার উন্মোচন করেছে। এখন দেশবাসী সব শ্রেণির মানুষকে ঐক্যবদ্ধভাবে দ্রুত নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নে নিষ্ঠার সঙ্গে কঠোরতর পরিশ্রম করতে হবে। সর্বপ্রকার কলুষ থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে, দেশে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং মানুষের মর্যাদা যাতে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, সেজন্য সমাজে মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’
নিজের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্বগ্রহণ প্রসঙ্গে ভাষণে মোশতাক বলেন, ‘এক ঐতিহাসিক প্রয়োজনে এবং বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের সঠিক ও সত্যিকারের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপদানের পূত পবিত্র দায়িত্ব সামগ্রিক ও সমষ্টিগতভাবে সম্পাদনার জন্য পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা ও বাংলাদেশের গণমানুষের দোয়ার ওপর ভরসা করে রাষ্ট্রপতি হিসেবে সরকারের দায়িত্ব আমার ওপর অর্পিত হয়েছে।’
বঙ্গবন্ধুর মামলার কার্যক্রম যখন হাইকোর্টে চলছিল, তখন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল পদে ছিলেন (পরবর্তীকালে বিচারপতি) শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। তিনি মামলার নথি পর্যালোচনার ভিত্তিতে বলেন, ‘প্রসিকিউশন দলের হয়ে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। এ মামলায় সাক্ষীদের জবানি থেকে জিয়াউর রহমানের সম্পৃক্ততা সম্পর্কে কিছু কথা সামনে আসে। হত্যাকারীদের দুজন কর্নেল ফারুক ও কর্নেল রশিদ একটি ব্রিটিশ টেলিভিশন চ্যানেলে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিল, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনাকালে তারা সে সময়ের উপ-সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের কাছে গিয়ে বিষয়টি ব্যক্ত করলে জিয়া তাদের এগিয়ে যেতে বলেন এবং তাদের উৎসাহিত করে বলেন, তারা সফল হলে জিয়া তাদের সঙ্গে থাকবেন। তার এই অবস্থানের কারণে তিনি দায় এড়াতে পারেন না। আমার বিবেচনায়, জিয়া সেদিন তাদের উৎসাহিত না করে যদি তাদের আইনের আওতায় আনার ব্যবস্থা করতেন, তাহলে বঙ্গবন্ধু খুন হতেন না। একজন সেনা কর্মকর্তার কাছে যখন রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যার পরিকল্পনা প্রকাশ করা হয়, সেই সেনা কর্মকর্তার তাৎক্ষণিক দায়িত্ব হয়ে যায় পরিকল্পনাকারীদের পুলিশে সোপর্দ করা। তা না করা রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল এবং জিয়াও সে কারণে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ করেছেন। ফৌজদারি দণ্ডবিধি আইনে যে ব্যক্তি অপরাধ করার জন্য অন্যকে উৎসাহিত করে, সেও একই অপরাধে অপরাধী এবং তার সাজাও সমান।’
এ মামলায় যারা সাক্ষী দিয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সে সময়ের (১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট) সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাহ। তার জবানবন্দি থেকেও জিয়ার তৎপরতা ও যুক্ততা উঠে আসে। তিনি বলেন, ‘‘আমি যখন হত্যা সংঘটিত হওয়ার কিছু আগে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলি, তিনি আমার গলার আওয়াজ শুনে বলে উঠলেন, ‘সফিউল্লাহ তোমার ফোর্স আমার বাড়ি অ্যাটাক করেছে, কামালকে বোধহয় মেরে ফেলেছে। তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও।’ আমি জিয়া ও খালেদ মোশাররফকে তাড়াতাড়ি আমার বাসায় আসার কথা বলি। ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে তারা এলে আমি তাদের পরিস্থিতি জানালাম এবং খালেদ মোশাররফকে ৪৬ ব্রিগেডে তাড়াতাড়ি গিয়ে শাফায়াত জামিলকে সাহায্য করার জন্য নির্দেশ দেই। একপর্যায়ে আমার ডেপুটি চিফ (জিয়াউর রহমান) আমাকে বললেন, ‘ডোন্ট সেন্ড হিম (খালেদ মোশাররফ), সে এটা নষ্ট করে দেবে।’ একপর্যায়ে ডেপুটি চিফ জেনারেল জিয়া বলেন, ‘সিজিএস খালেদ মোশাররফকে আর বাইরে যেতে দিও না।’ খালেদ মোশাররফকে কোনও অপারেশনে না পাঠানো এবং বাইরে না যেতে দেওয়ার দাবিও সারকামস্টেনশেয়াল সাক্ষ্যের চেইনে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।’’
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবীর বলেন, ‘মূল পরিকল্পনার জায়গায় জিয়াউর রহমান থাকলেও সে নিজেকে আড়ালে রাখার চেষ্টা করেছিল। পরিকল্পনাকারীদের সে গ্রিন সিগন্যাল দিয়েছিল এই বলে যে যদি তারা সফল হয় তবে সে তাদের সঙ্গে অবশ্যই থাকবে। বঙ্গবন্ধুর মতো নেতাকে সপরিবারে হত্যা করার পরে পারিপার্শ্বিক প্রতিক্রিয়া কেমন হবে, সেটা সামলানোর ক্ষমতা তার আছে কিনা বুঝতে না পারার কারণে, সে সামনে ছিল না। কিন্তু হত্যা সংঘটিত হওয়ার পরে আর সে আড়ালে থাকতে পারেনি। মাত্র ৮৩ দিনের মাথায় খন্দকার মোশতাককে খালেদ মোশাররফকে দিয়ে সরিয়ে দিয়ে সে আসলে ধীরে ধীরে নিজের রাস্তা পরিষ্কার করেছিল। ১৫ আগস্টের পরবর্তী সময়ে তার একের পর এক তৎপরতা সেটা প্রমাণ করে।’
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের আগেই বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সরকারকে নিয়ে বহুমাত্রিক ষড়যন্ত্র আর প্রচারণা শুরু হয় উল্লেখ করে সাংবাদিক মাসুদা ভাট্টি বলেন, বাসন্তীর জাল পরা ছবির মত মর্মান্তিক মিথ্যাচার ও স্থুল প্রচারণা যেমন ছিল, তেমনই পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পলাতক স্বাধীনতা-বিরোধীরা বিদেশেও বঙ্গবন্ধু-বিরোধী প্রচারণা শুরু করে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে তখন ঘোর শীতল যুদ্ধের আমল এবং এই সময়কালে বঙ্গবন্ধুসহ চিলির আলেন্দে, কঙ্গোর লুমুম্বাসহ জাতীয়তাবাদী নেতাদের বিরুদ্ধে বিরাট বাজেট নিয়েই অপপ্রচার চলে বিশ্বময়।’
বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু সরকারের একটা সমস্যা তৈরির সঙ্গে পদ্মা সেতু নিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের সৃষ্ট সমস্যার মধ্যে মিল পাওয়া যায় বলেও উল্লেখ করেন মাসুদা ভাট্টি। তিনি বলেন, ‘হেনরি কিসিঞ্জারকে বঙ্গবন্ধু এয়ারপোর্টে বসিয়ে রেখেছেন, এ ধরনের প্রচারণাও সে সময় কৌশলে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর জাসদের পত্রিকা গণকণ্ঠতো ছিলই গুজবের কারখানার মতো; যে কোনও বিষয়ে সংবাদ, বিশ্লেষণ, সম্পাদকীয় এমনকি ব্যাঙ্গ কবিতা পর্যন্ত ছাপা হয়েছে। মোটকথা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার আগেই একটি ব্যাকগ্রাউন্ড তৈরি করে পরাজিত শক্তিগুলো আর সপরিবারে হত্যার পরে তো অপপ্রচার সকল রেকর্ড অতিক্রম করে। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে ‘বস্তায় বস্তায় সোনা-দানা আর টাকা-পয়সা পাওয়া যাওয়া’র খবর তো মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। অথচ শেখ হাসিনা যখন রাষ্ট্রের কাছ থেকে ৩২ নম্বরের জিনিসপত্র বুঝে নেন, তার মধ্যে ছিল কিছু খাট পালঙ্ক আর জামাকাপড়; তাও তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল অনেক সুকৌশলে। কিন্তু প্রচারণায় আগ্নেয়াস্ত্রের কথাও বলা হয়েছিল।’


প্রকাশিত: আগস্ট ১২, ২০২৩ | সময়: ৫:৪৩ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ