ফের রাতভর বিক্ষোভে কাঁপল ইরান

সানশাইন ডেস্ক: সাম্প্রতিক সময়ে ইরানে সরকারবিরোধী আন্দোলনের তেজ কিছুটা কম বলে মনে হলেও রাতভর বিক্ষোভ ফের ইসলামী প্রজাতন্ত্রটিকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে রাজধানী তেহরানসহ অনেকগুলো শহরে বিক্ষোভ শুরু হয়ে গত মাসে ফাঁসিতে ঝোলানো দুই বিক্ষোভকারীর চল্লিশা শুরুর রাত পর্যন্ত চলেছে বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
এসব বিক্ষোভের ভিডিও শুক্রবার অনলাইনেও এসেছে। ইরান গত ৮ জানুয়ারি মোহাম্মদ মেহদি কারামি ও মোহাম্মদ হোসেইনি নামের দুই বিক্ষোভকারীকে ফাঁসির দড়িতে ঝোলায়, ডিসেম্বরে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে আরও দুইজনের। ইরানজুড়ে ছড়িয়ে পড়া এই বিক্ষোভের সূত্রপাত হয়েছিল গত বছরের সেপ্টেম্বরে, কঠোর হিজাব আইন না মানার অভিযোগে গ্রেপ্তার কুর্দি-ইরানি তরুণী মাশা আমিনি নিরাপত্তা হেফাজতে মারা যাওয়ার পর।
কঠোর ওই হিজাব আইনের কারণে দেশটিতে ঘরের বাইরে নারীদের শরীর ও মাথার চুল ঢেকে রাখতে হয়। তেহরানের বেশ কয়েকটি এলাকার পাশাপাশি কারাজ, ইস্ফাহান, কাজভিন, রাশত, আরাক, মাশহাদ, সানানদাজ, করবেহ ও খুজেস্তান প্রদেশের ইজেহতে বিক্ষোভের বিষয়টি শুক্রবার অনলাইনে পাওয়া ভিডিও থেকে জানা গেছে।
শিয়া সম্প্রদায়ের কাছে খুবই পবিত্র হিসেবে পরিচিত উত্তরপূ্র্েবর মাশহাদ শহরের বিক্ষোভ বলে মনে হওয়া এক ভিডিওতে আন্দোলনকারীদের চিৎকার করে ‘আমার শহীদ ভাইয়েরা, আমরা তোমাদের রক্তের বদলা নিব’ বলতে শোনা গেছে। বেশকিছু ভিডিওতে শুক্রবার ইরানের সংখ্যালঘু বালুচ সম্প্রদায়ের আবাসস্থল দক্ষিণপূর্বাঞ্চলীয় সিস্তান-বালুচিস্তান প্রদেশের রাজধানী জাহেদানে বড় বিক্ষোভের দৃশ্য দেখা গেছে। রয়টার্স জাহেদানের বিক্ষোভের তিনটি ও তেহরানের একটি বিক্ষোভের ভিডিওর সত্যতা নিশ্চিত হতে পেরেছে।
এদিকে ইরানের বিচারবিভাগ ধর্ষণের অভিযোগে এক পুলিশ কমান্ডারকে কারাদণ্ড দিয়েছে। ৩০ সেপ্টেম্বরের বিক্ষোভের আগে ধর্ষণের ওই ঘটনা আন্দোলনকারীদের তাঁতিয়ে দিয়েছিল; জাহেদানে সেদিনের বিক্ষোভে নিরাপত্তা বাহিনী তুমুল বলপ্রয়োগ করলে অন্তত ৬৬ জন নিহত হয় বলে দাবি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গোষ্ঠী অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের। দেশটিতে এতদিন ধরে চলা বিক্ষোভ ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর থেকে ইরানের শাসকদের জন্য অন্যতম শক্তিশালী চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
অনেকেই এখন প্রকাশ্যে হিজাব আইন অমান্য করছে, নারীরা তাদের স্কার্ফ ফেলে দিচ্ছে বা পুড়িয়ে ফেলছে, অনেকে এমনকি চুলও কেটে ফেলছেন। দমনপীড়ন এবং অনেকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর এই ধরনের প্রতিবাদ অনেকটাই কমে এলেও আইন অমান্য চলছিল।
রাতে তেহরান ও অন্যান্য শহরজুড়ে সরকারবিরোধী স্লোগান প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। তরুণ-যুবকরা রাতের বেলায় প্রজাতন্ত্রের নিন্দা করে গ্রাফিতি আঁকছে কিংবা মূল মূল মহাসড়কে থাকা সাইন বা সরকারপন্থি বিলবোর্ড পোড়াচ্ছে। কর্তৃপক্ষের ধারাবাহিক সাবধানবাণী উপেক্ষা করেই সড়ক, মল, দোকানপাট ও রেস্তোরাঁয় হিজাববিহীন নারী দেখা যাচ্ছে।
সম্প্রতি জেল থেকে ছাড়া পাওয়া কয়েক ডজনসহ অনেক নারীকে ক্যামেরার সামনে হিজাব ছাড়া পোজ দিতে দেখা গেছে। তবে এসব সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত বাধ্যতামূলক হিজাব পরিধানের নীতি থেকে পিছু হটেনি। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ইরানের গণমাধ্যম হিজাব আইন না মানায় একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, রেস্তোরাঁ ও ক্যাফে বন্ধ করে দেওয়ার খবর দিয়েছে।
গত সপ্তাহে ইরানের কর্মকর্তারা ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে তেহরানের দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে হিজাব সংক্রান্ত বিধিবিধান কঠোরভাবে অনুসরণের আহ্বান জানিয়েছেন। ‘ঠিকঠাক পর্দানসীন’ নয় এমন নারী শিক্ষার্থীদেরকে গত মাসে সতর্ক করে তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় বলেছে, বিধিনিষেধ না মানলে তাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে দেওয়া হবে না।
হিজাব আইন না মানায় প্রায় অর্ধশত শিক্ষার্থীকে উর্মিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে বাধা দেওয়ার খবর দিয়েছে স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যন্ত ৭১ অপ্রাপ্তবয়স্কসহ পাঁচশর বেশি বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছেন। ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে অন্তত ৪ জনকে। এর মধ্যে হোসেইনি ও ২২ বছর বয়সী কারাতে চ্যাম্পিয়ন কারামিকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে বাসিজ আধাসামরিক বাহিনীর এক সদস্যকে হত্যার দায়ে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, জোরপূর্বক নেওয়া স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে আদালত কারামিকে দোষী সাব্যস্ত করেছে। আর হোসেইনির আইনজীবী বলছেন, তার মক্কেল নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। এর আগে ৮ ও ১২ ডিসেম্বর আরও দুইজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল। বৃহস্পতিবার মুক্তি পাওয়া ৫ নারী অ্যাক্টিভিস্ট বলেছেন, তারা তাদের মুক্তির জন্য ‘ইরানের স্বাধীনতা আকাঙ্ক্ষী জনগণ ও যুবদের’ সংহতির কাছে ঋণী। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসা একাধিক পোস্ট থেকে একথা জানা গেছে। “মুক্তির দিন ঘনিয়ে আসছে,” বিবৃতিতে বলেছেন ওই ৫ অ্যাক্টিভিস্ট।


প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০২৩ | সময়: ৭:১২ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ

আরও খবর