সর্বশেষ সংবাদ :

অব্যবস্থাপনায় রসাতলে বাগমারা হাসপাতাল

মাহফুজুর রহমান প্রিন্স, বাগমারা: এত বড় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স অথচ এখানে রোগিরা চিকিৎসা নিতে আসতে চায় না। ডাক্তাররা ব্যস্ত থাকেন প্রাইভেট ক্লিনিকে চিকিৎসা দিতে। রোগি ভর্তি হলেও তাদের ওষুধ দেওয়া হয় না। এক্স-রে মেশিন থাকলেও সেখানে এক্স-রে করানো হয় না। পাঠানো হয় প্রাইভেট ক্লিনিকে। রোগিদের খাবারের মান অতি নিম্ন। টয়লেটের বারান্দা সহ সর্বোত্রই অপরিস্কার।
গত ২৯ জুলাই উপজেলার মাসিক সমন্ময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাগমারা আসনের সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক হাসপাতালটির বাস্তব চিত্র তুলে ধরে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
সভায় উপস্থিত উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা অফিসার ডা. গোলাম রাব্বানীকে কটাক্ষ করে তিনি বলেন, নতুন এ্যম্বুলেন্স এনে দিয়েছি। শুনতে পাই সেটাও অকেজো পড়ে থাকে। ডাক্তার হয়ে আপনারা রোগি পাঠান প্রাইভেট ক্লিনিকে। সেখান থেকে কমিশন পান। অপ্রয়োজনীয় টেস্ট দিয়ে রোগিদের নাজেহাল করা হয়। ছোটখাট সামস্যা নিয়ে রোগিরা গেলে তাদের অবস্থা জটিল এখানে চিকিৎসা সম্ভব নয় বলে রাজশাহী পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
বাগমারা মেডিকেলের ডাক্তারদের এমনি ভুরি ভুরি অনিয়ম দুর্নীতির কথা তুলে ধরে এমপি এনামুল হক আরো বলেন, এই রোগি ও তাদের আত্মীয় স্বজনের ট্যাক্সের টাকায় আপনাদের বেতন হয়। অথচ তারা আজ আপনাদের সেবা বঞ্চিত।
বাগমারা মেডিকেলের এই অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র দীর্ঘ দিনের। এখানে স্বজনপ্রীতি ও রোগিদের সাথে দুব্যবহার নিত্যদিনের ঘটনা। অভিযোগ রয়েছে ওপরে তদবরি করে নার্স সহ ৫-৬ জন ডাক্তার এই উপজেলার স্থানীয় বাসিন্দা হিসাবে বাগমারা মেডিকেলে পোস্টিং নিয়েছে। তারা ধরাকে সরা জ্ঞান করে রোগিদের সাথে চরম দুব্যবহার করে থাকেন। অনেক সময় তারা মেডিকেল থেকে জোরপূর্বক রোগিদের বের করে দেওয়ার ঘটনা ঘটান।
এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র জানতে বুধবার দুপুরে সরেজমিন এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে গেলে ওঠে আসে এর নানান অনিয়মের কাহীনি।
উপজেলার চকহায়াতপুর গ্রামের তয়েজ উদ্দিন (৮০) গত ৩-৪ দিন ধরে প্রচণ্ড পায়খানা ও বমন জনিত সমস্যায় বাগমারা মেডিকেলে ভর্তি হয়েছেন। একই সমস্যা নিয়ে তার পুত্র আলতাফ হোসেন (৫০) ও নাতি সাদেক হোসেন (১৫) ভর্তি হয়েছেন। তয়েজ উদ্দিনের সাথে এসেছেন তার পুত্রবধু সাজেদা বেগম।
তিনি অসুস্থ শ্বশুর, স্বামী ও পুত্রের সেবা যত্ন করছেন। তারা জানান, এখানে ভর্তির পর তাদের শুধু স্যালাইন দেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত কোন ওষধ দেওয়া হয়নি। তারা খাবারের মান, নোংরা ট্রয়লেট বারান্দা ও অপরিস্কার বিছানার চাদর নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। একই ওয়ার্ডে মাথায় ও হাতে ব্যাণ্ডেজ নিয়ে ভর্তি হয়েছেন বাইগাছা গ্রামের মৃত শফি উদ্দিনের পুত্র শহিদুল (৫৫) ও তাদের প্রতিপক্ষএকই গ্রামের এজাজুল খান ((৭০)। তারও মাথায় ও পায়ে একাধিক ব্যাণ্ডেজ করা। তারা মারামারি করে উভয়ে আহত হয়েছেন।
যন্ত্রনায় কাতর এই রোগিরা জানান, দুইদিন হল তারা এখানে ভর্তি হয়েছেন। তাদের শুধু স্যালাইন দেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত কোন ওষধ পাননি।
তারা সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে এই প্রতিবেদকের কাছে আকুতি মিনতি করে বলেন, শুনছি সরকারি মেডিকেলে রোগিদের ফ্রি ওষধ দেওয়া হয়। এখন এখানে এসে দেখছি উল্টো চিত্র। তাদেরকে স্লিপ লিখে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে বাইরে থেকে ওষধ কিনে আনার জন্য। রাকিব (২৩) ভটখালির চন্দ্রপুর থেকে গত ৩১ আগস্ট ভর্তি হয়েছেন পেটে গ্যাস জনিত সমস্যায়। সঙ্গে তার পিতা এছহাক আলীও আছেন।
তারা জানান, এখানে ভর্তির পরেই তাদেরকে এক্স-রে করার জন্য উপজেলা সদরে ভবানীগঞ্জ নামক ক্লিনিকে পাঠানো হয়েছে এক্স-রে করার জন্য। সেখানে একটি এক্স-রে করার জন্য তাদের কাছে চৌদ্দশ টাকা আদায় করা হয়েছে। তারা প্রশ্ন করে বলেন, বাগমারা মেডিকেলে এক্স-রে মেশিন থাকার পরও তাদেরকে পাঠানো হয়েছে ভবানীগঞ্জ নামক ক্লিনিকে।
এছাড়া তাদেরকে শুধু স্যালাইন ছাড়া কোন ওষধ দেওয়া হয়নি। তারা ওষধ না পাওয়া ও বাইরের ক্লিনিকে এক্স-রে করার জন্য যাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সরকারি বরাদ্দের ওষধ এখান থেকে কী হাওয়া হয়ে যায়।
এদিকে বাগমারা মেডিকেলের চিকিৎসা সেবার মান দিনে দিনে কমতে কমতে এখন তলানীতে এসে ঠেকেছে। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে একের পর এক ক্লিনিক ও ডায়াগনষ্টিক সেন্টারের সংখ্যা।
উপজেলার ওই মাসিক সমন্ময় সভায় উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী এই উপজেলায় মোট অনুমোদিত ক্লিনিকের সংখ্যা ২৮টি এবং এর বাইরে অবৈধ ক্লিনিক রয়েছে আরো ত্রিশটি। এসব ক্লিনিতে মাঝে মধ্যে লোক দেখানে অভিযান চালায় উপজেলা প্রশাসন ও মেডিকেল র্কর্তৃপক্ষ। ফলাফল সেই চোর পুলিশ খেলা। আবারও আগের মত চলতে থাকে অবৈধ ক্লিনিক।
ভবানীগঞ্জ গোডাউন মোড়ে অবস্থিত আত-তাবারা এমনই একটি ক্লিনিক। এই ক্লিনিতে গত ৬ আগষ্ট তাহেরপুর পৌরসভার জামলই গ্রামের মৎস ব্যবসায়ী বাবুর স্ত্রী শিউলীকে জোরপূর্বক অপারেশন করার চেষ্টা চালায় ডাক্তাররা। ডাক্তাররা জানায় শিউলীর বাম কিডনী বড় হয়ে গেছে। তাকে জরুরী ভিত্তিতে অ্যাপেন্ডিক্স অপারেশন করতে হবে। পরে এই ক্লিনিক থেকে ডাক্তারের বাধা উপেক্ষা করে রোগির স্বজনরা রোগিকে এক রকম জোরপূর্বক শহরের একটি ক্লিনিকে নিয়ে ভর্তি করে জানাতে পারেন শিউলীর ওই সমস্ত কোনই রোগ হয়নি। সে গ্যাস জনিত কারণে পেটের ব্যাথায় ভুগছিল। অভিযোগ রয়েছে এই ক্লিনিক থেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্্ের ও উপজেলা প্রশাসনে নিয়মিত মাসোহারা পাঠানো হয়।
তথাকথিত কিছু মিডিয়া কর্মীরাও এই সুবিধা নিয়ে থাকেন। অভিযোগ রয়েছে এই ক্লিনিকের অপারেশন থিয়েটারের ইনচার্জ আব্দুল মতিন ৮ম শ্রেণি পাশ। ডাক্তার না থাকলে তিনি নিজেই সিজারিয়ান সহ ছোটখাত অপারেশন করে থাকেন। এই ক্লিনিক ছাড়াও গ্রামবাংলা সহ আরো বেশ কিছু ক্লিনিকে অবৈধ গর্ভপাত এখন নিত্যদিনের ঘটনা। স্কুল কলেজ পড়ুয়া তরুণীরা দালাল মারফত এসব ক্লিনিকে এসে নির্বিগ্নে গর্ভপাত করে চলে যান।
এর আগে এমনি এক অবৈধ গর্ভপাত করাতে গিয়ে এক প্রসূতির মৃত্যু ঘটায় ওই ক্লিনিক মালিককে প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক টাকার খেসারত দিতে হয়। নানান অব্যবস্থাপনায় এসব ক্লিনিক চলছে দেদারছে।
স্থানীরা জানান, এসব ক্লিনিক মালিকদের সাথে স্বাস্থ্য বিভাগ, পুলিশ, প্রশাসন, মিডিয়া ও স্থানীয় রাজনৈতিক দলের কথিপয় নেতার রয়েছে গভীর সখ্যতা। তারা রোগিদের সর্বশান্ত করে ছাড়ছে। সুস্থ মানুষকে ভুল চিকিৎসা করে জটিল রোগি সাজিয়ে তাকে জমি জমা বিক্রি করে পথের ফকির বানাচ্ছে। তাদের ফক্করে সেই পড়ছে সেই জানতে পারছে এসব ডাক্তার রুপী হায়েনার যন্ত্রনা।
শুধু উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নয়। এই উপজেলার ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের একই করুন অবস্থা। এখানে ডাক্তার পোষ্টং থাকলেও তারা নিয়মিত সেখানে বসেন না। বুধবার বেলা সাড়ে এগারোটার দিকে মাড়িয়ার যাত্রাগাছি উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় সেখানকার কর্তব্যরত ডাক্তার আনোয়ার হোসেনের চেয়ারটি ফাকা। পাশেই বসে আছেন বালানগর গ্রামের পঁছাত্তর বছর বয়সী বৃদ্ধ লায়েব উল্যা।
তিনি জানান, ডাক্তার ১০টায় আসেন ১২ টায় যান। কিন্তু তখন সাড়ে এগারোটায় ডাক্তার নেই কেন এমন প্রশ্নের জবাবে লায়েব উল্যা বলেন, বাবা আমি এখানকার কেউ নই। এ বিষয়ে কিছু বলতে পারবো না।
এ বিষয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. গোলাম রাব্বানীর দৃষ্টি আকর্শণ করা হলে তিনি বলেন, আমার পদবি উপজেলা স্বাস্থ্য পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হলেও উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র গুলো দেখাশুনা করেন উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা। আমিও কিছু উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র দেখশুনা করি। তবে ওইটি আমার তালিকার বাহিরে। তারপরও ওনার অনুপস্থিতিরি বিষয়টি আমার যাচাই করে দেখবো।
এছাড়া অন্যান্য অনিয়মের বিষয়ে তিনি বলেন, আমার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২৮ জন ডাক্তারের স্থলে আছে ১৭ জন এবং ৩২ জন নার্সের স্থলে আছে ২৫ জন। তার মতে স্টাফ মোটামুটি ঠিকই আছে। আমি এসব স্টাফদের নিয়ে নিয়মিত মিটিং করছি এবং সার্বিক সেবার মান উন্নত করা সহ অন্যান্য সমস্যার দ্রুত সমাধানের জন্য স্থানীয় এমপি মহোদয়ের পরামর্শে দ্রুত কাজ শুরু করেছি। তবে রোগিদের ওষধ না পাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, সরকারি বরাদ্দের বাইরে তো আর রোগিদের ওষধ দিতে পারবো না। তার মতে, ওষধ নিয়ে রোগিরা একটু বাড়াবাড়ি করে বলেন।


প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১, ২০২২ | সময়: ৬:১০ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ