দলগত ব্যর্থতায় আড়াল ব্যক্তিগত সাফল্যের মালা

স্পোর্টস ডেস্ক: একাধিক ফিক্সিংয়ের প্রস্তাবের খবর কর্তৃপক্ষকে না জানানোয় সাকিব আল হাসানের নিষেধাজ্ঞায় দেশের ক্রিকেটাই যেন পাল্টে গেল! দেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে উজ্জ্বল ধ্রুবতারাকে হারানোর পাশাপাশি ওলটপালট হয়ে গেল অনেক কিছু।
‘ফ্রম নো ওয়ার’ মুমিনুল হক পেয়ে যান অধিনায়কত্ব। কিন্তু ‘টেস্ট স্পেশালিস্ট’ খেতাব পেয়ে যাওয়া মুমিনুল যেন নেতৃত্বের ভারে নুহ্য। নিজে ঠিকঠাক রান পাচ্ছেন না, দলও চলছে ব্যাকগিরয়ারে। সবশেষ শ্রীলঙ্কা সিরিজ যেন ব্যর্থতার স্তুপে আরেকটি বোঝা বাড়িয়েছে। দলগত নৈপুণ্য না থাকলেও ছিল ব্যক্তিগত সাফল্য। কিন্তু দলগত ব্যর্থতায় আড়াল ব্যক্তিগত সাফল্যের মালা।
সাকিবকে পাওয়ার সিরিজ: নিষেধাজ্ঞার পর সাকিবকে এবারই দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে দুটিতেই পেয়েছে বাংলাদেশ। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ দিয়ে সাকিব মাঠে ফিরেছিলেন। চট্টগ্রামে খেললেও কুচকির চোটে ঢাকায় খেলা হয়নি তার। এরপর শ্রীলঙ্কা ও জিম্বাবুয়ে সফর করেননি। ঘরের মাঠে পাকিস্তানের বিপক্ষে ঢাকায় খেললেও চোটের কারণে চট্টগ্রামে খেলা হয়নি। নিউ জিল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকাতেও তার খেলা হয়নি। এবার শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দুই টেস্টেই সাকিবকে পেয়েছে বাংলাদেশ। তবে এখানেও ছিল দোলাচাল। সিরিজ শুরুর ছয়দিন আগে কোভিড পজিটিভ হন সাকিব। চারদিনের ব্যবধানে নেগেটিভ হলেও তার খেলা নিয়ে ছিল অনিশ্চিয়তা। চট্টগ্রামে ম্যাচের আগের দিন মাত্র ৩০ মিনিটের অনুশীলনে সাকিব হয়ে উঠেন প্রাণবন্ত। কোভিড থেকে সেরে ওঠার ৪৮ ঘণ্টা মধ্েয সাকিব নেমে পড়েন পাঁচদিনের টেস্টে। দ্বিতীয় টেস্টে সাকিব অ্যাভেইলেভেল থাকেন। পুরোপুরি ফিট হয়েই খেলেন ঢাকা টেস্ট। দুই ম্যাচে সাকিব রান করেছেন ৮৪, বল হাতে উইকেট পেয়েছেন ৯টি। ব্যাটিংয়ে আরেকটু ভালো করতে পারলে তাকে পাওয়ারে ষোলোকলা পূর্ণ হতো তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
মুশফিকের ছন্দে ফেরা: দক্ষিণ আফ্রিকায় তার ব্যাট হাসেনি। আউটের ধরনে হয়েছিলেন সমালোচিত। সব কিছুকে পেছনে ফেলে মুশফিক এখন দারুণ ছন্দে। ভালো করার জেদ থেকেই তার ব্যাটে এমন রান ফোয়ারা। চট্টগ্রামের পর ঢাকাতেও মুশফিকের ব্যাট থেকে আসে সেঞ্চুরি। ২ ম্যাচে ৩ ইনিংসে ৩০৩ রান করেছেন। যা সিরিজে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ঢাকায় প্রথম ইনিংসে দলকে খাদের কিনারা থেকে তুলে ১৭৫ রানের অপরাজিত যে ইনিংসটি খেলেছেন তা স্রেফ অভিজ্ঞতাতেই সম্ভব। ২২ গজে তার এমন রাজসিক ফেরা বলে দেয় সাদা পোশাকে দেশকে দেওয়ার অনেক কিছুই আছে তার। একটি পরিসংখ্যান মুশফিকের উপস্থিতিকে আরও রঙিন করতে পারে। ২০০০ সালের পর কমপক্ষে ২০ ইনিংস খেলেছেন এমন ব্যাটসম্যানদের ব্যাটিং গড়ে সবচেয়ে এগিয়ে মুশফিক। ২১ ইনিংসে ৫৮.৯৪ গড়ে তার রান ১০০২।
ম্যাজিকাল লিটন: তার হাতের ব্যাট যেন তুলি। মাঠটা যেন ক্যানভাস। সবুজ সেই ক্যানভাবে লিটন যেন লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি। যিনি শুধু এঁকে যান মাঠের ‘মোনালিসা’। তার কভার ড্রাইভ নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই। পুল শটে এতোটাই হাত পাকিয়েছেন যে বোলাররা দ্বিধায় থাকেন বলটা করবেন কই? মুগ্ধতা ছড়িয়ে লিটন দিনকে দিন হয়ে উঠছেন ধ্রুবতারা। যার উজ্জ্বল আলোয় জ্বলছে দেশের ক্রিকেট। ৩ ইনিংসে ২৮১ রান করা এ ব্যাটসম্যান নিজের প্রতিটি শটে, প্রতিটি ক্ষণে দেখিয়েছেন সৃষ্টিশীলতা। একটা সময় তার জায়গা নিয়ে নানামুখী সমালোচনা হয়েছিল। কিন্তু এখন লিটন দলের ভরসার আরেক নাম।
নাঈমের আত্মবিশ্বাসী প্রত্যবর্তন: আচমকা হাতের মুঠোয় পাওয়া সুযোগ কিভাবে কাজে লাগাতে হয় তা খুব ভালোভাবে করে দেখালেন নাঈম হাসান। ১৫ মাস পর জাতীয় দলে ফিরে করছেন ক্যারিয়ার সেরা বোলিং। নিয়মিত দুই স্পিনার সাকিব আল হাসান ও তাইজুল ইসলামকে ছাপিয়ে চট্টগ্রামে ২২ বছর বয়সী তরুণ হয়ে উঠেছিলেন দলের ধ্রুবতারা। ১০৫ রানে নিয়েছিলেন ৬ উইকেট। মিরাজের পরিবর্তে সুযোগ পেয়ে তা খুব ভালোভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন। কিন্তু ঢাকায় তার খেলা হয়নি। চট্টগ্রামেই দ্বিতীয় ইনিংসে বোলিংয়ের সময় আঙুলের চোটে ছিটকে যান। মিরাজের অনুপস্থিতিতে পাওয়া সুযোগ নাঈম রাজসিকভাবে প্রত্যাবর্তন রাঙিয়েছেন। নিজেকে নতুন করে চিনিয়েছেন। এই পুনর্জন্মে ২২ বছর বয়সী ক্রিকেটার থিতু হতে পারেন কিনা সেটাই দেখার।
সিরিজের ব্যর্থতাগুলো হচ্ছে-জয়ের আপস অ্যান্ড ডাউন: বাংলাদেশের ওপেনিং নিয়ে দুশ্চিন্তা এখনও কাটেনি। মাহমুদুল হাসান জয়কে ঘিরে বড় আশা করা হলেও তার পারফরম্যান্স অধারাবাহিক। উঠা-নামার ভেতরেই থাকে ব্যাট। বিশেষ করে দেশের মাটিতে জয়ের রান খরা চলছে। ৬ ম্যাচে তার ২টি সেঞ্চুরি। ২টি দেশের বাইরে। একমাত্র হাফ সেঞ্চুরি পেয়েছেন এই সিরিজেই। চট্টগ্রামে ইনিংসে ৫৮ রান করেছিলেন। ঢাকা টেস্টে তার ব্যাট একদমই হাসেনি। প্রথম ইনিংসে শূন্যরানে আউট হওয়ার পর দ্বিতীয় ইনিংসে ১৫ রান করেন। দ্বিতীয় ইনিংসে দুইবার জীবন পেয়েও ইনিংস বড় করতে পারেননি।
ছায়া হয়ে থাকা শান্ত: অতি গুরুত্বপূর্ণ তিন নম্বর পজিশনে ব্যাটিং করে ধারাবাহিকভাবে ব্যর্থ নাজমুল হোসেন শান্ত। শেষ কবে বাঁহাতি ব্যাটসম্যান রান পেয়েছেন সেজন্য টাইম মেশিনে করে পেছনে ফিরতে হবে। শেষ ১৫ ইনিংসে তার হাফ সেঞ্চুরি মাত্র ১টি। রান ২৭৩। ৭ ইনিংসেই দুই অঙ্কের ঘরে যেতে পারেননি। প্রতিশ্রতিশীল, সামর্থ্যবান ক্রিকেটার হিসেবে বারবার তাকে সুযোগ দেওয়া হলেও শান্ত নিজের ছায়া হয়ে আছেন। ব্যাটে রান না থাকায় ভুগতে হচ্ছে দলকেও।
অফস্পিনার অলরাউন্ডার সংকট: মেহেদী হাসান মিরাজ টেস্ট ক্রিকেটে থিতু হয়েছেন। ওয়ানডেতেও তার বিকল্প নেই। তার চোটে এবার নাঈম হাসানকে দলে নিয়েছিল। তবে নাঈম ব্যাটিং পারবেন কিনা তা নিয়ে ছিল দুশ্চিন্তার ভাজ। বোলিংয়ে নাঈম দলের চাহিদা পূরণ করেছেন। কিন্তু ব্যাট হাতে ছিলেন নিষ্প্রভ। নাঈম ঢাকা টেস্টের আগে ইনজুরিতে পড়লে আবার টিম ম্যানেজমেন্টের মাথায় হাত? কাকে দিয়ে পঞ্চম বোলারের ঘাটতি পূরণ করবে? দল বেছে নিল মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতকে। অথচ এ স্পিনার ঘরোয়া ক্রিকেটে সাদা পোশাকে তেমন কিছুই করেননি। তবুও তার উপর রেখেছিল আস্থা। দুই ইনিংস মিলিয়ে তাকে ১২ ওভার বোলিং দিয়েছিলেন মুমিনুল। ৩৮ রান দিয়ে ছিলেন উইকেটশূন্য।
দলের ভারে বিবর্ণ মুমিনুলের ব্যাট: আচমকা টেস্ট অধিনায়কত্ব পেয়ে মুমিনুল হককে বেশ আত্মবিশ্বাস দেখালেও মাঠে উল্টো চিত্র। পরাজয়ের মিছিল দিনকে দিন লম্বা হচ্ছে। সঙ্গে ব্যাটসম্যান মুমিনুলও যেন হারিয়ে যাচ্ছেন অতলে। শেষ ১০ ইনিংসে তার রান মাত্র ৭৪। ৮ ইনিংসেই দুই অঙ্কের ঘরে যেতে পারেননি। তিনটিতেই মেরেছেন ডাক। রান না পাওয়ায় বেশ সমালোচিত হচ্ছেন বাংলাদেশের অধিনায়ক। সঙ্গে যোগ করছে নেতৃত্বগুণের ঘাটতি। অধিনায়ক হিসেবে ১৭ ম্যাচে মুমিনুলের রান ৯১২। ব্যাটিং গড় ৩১.৪৪। পেয়েছেন ৩ সেঞ্চুরি। অধিনায়কত্বের আগে ৩৬ টেস্টে ৪১.৪৭ গড়ে রান করেছেন ২৬১৩। সেঞ্চুরি ছিল ৮টি। অধিনায়কত্বের বাড়তি বোঝা দিয়ে ব্যাটসম্যান মুমিনুলকে কি হারাচ্ছে বাংলাদেশ? প্রশ্নের উত্তর খোঁজা এখনই জরুরি।


প্রকাশিত: মে ২৯, ২০২২ | সময়: ৫:৪৫ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ