রাসিকের সঙ্গে আন্তর্জাতিক চক্রের ষড়যন্ত্র

স্টাফ রিপোর্টার : রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের নাম ব্যবহার করে পাসপোর্ট, ইমেইল, মোবাইল নম্বর জালিয়াতি করে গভীর ষড়যন্ত্র শুরু করেছে কোরিয়ান একটি কোম্পানী। এ নিয়ে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। কোরিয়ান ওই কোম্পানীর বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে রাজশাহী নগরীর বোয়ালিয়া থানার সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে। শিগগিরই সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলা করা হবে বলে জানিয়েছেন সিটি মেয়র ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিয়াম সদস্য এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন।
ফায়ারফাইটিং সরঞ্জাম কেনার জন্য রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন সঠিক প্রতিষ্ঠান না হলেও সে বিষয়ে একটি ভুয়া চুক্তি দেখিয়ে ক্ষতিপূরণ দাবি করেছে কোরিয়ার কোম্পানিটি। আটটি ফায়ারফাইটিং ট্রাক না নেওয়ায় ক্ষতিপূরণ হিসেবে কোম্পানিটি এখন ১০ দশমিক ১২ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ৮৭ কোটি টাকা) দাবি করছে। এ ঘটনায় চরম উদ্বেগ একাশ করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীন পরচালিত রাষ্ট্রীয় সেবা প্রতিষ্ঠান রাসিক।
বুধবার দুপুরে রাজশাহী নগর ভবনের এনেক্স ভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে রাসিক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন বিদেশী ওই চক্রের প্রতারণর বিষয়টি তুলে ধরেন। মেয়র বলেন, রাজশাহীর ভাবমূর্তি ম্লান করতে ওই চক্রটি নানাভাবে ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। এ বিষয়ে নগরবাসীকে বিভ্রান্ত না হওয়ারও আহ্বান জানান তিনি। মেয়র বলেন, ইতিমধ্য ওই চক্রটির বিরুদ্ধে খোঁজ খবর নেয়া হচ্ছে। তাদের প্রতারণার উৎস খুজে বের করা হবে। প্রতারণার সঙ্গে যুক্ত ওই কোরিয়ান ওই কোম্পানীর নাম সিনসিন গ্লোবাল কোম্পানী লিমিটেড।
সংবাদ সম্মেলনে মেয়র লিটন বলেন, রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন দেশের অন্যতম একটি সেবাসংস্থা। রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন নগরবাসীর সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার পাশাপাশি পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা, সবুজায়ন, বায়ুদূষণ কমানো, ইপিআই কার্যক্রমে জাতীয়ভাবে পরপর ১০ বার দেশসেরা হয়েছে। নানাবিধ ক্ষেত্রে দেশ-বিদেশে সুনাম অর্জন করেছে। ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের অদম্য অগ্রযাত্রার ধারাবাহিকতায় ব্যাপক উন্নয়নের মাধ্যমে রাজশাহীতেও উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় এগিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক একটি চক্র জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধমে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অপতৎপরায় লিপ্ত হয়েছে।
লিটন বলেন, চক্রটি কৌশলে আমার পাসপোর্ট জালিয়াতি, ভুয়া ইমেইল আইডি ও মোবাইল নম্বর ব্যবহার ও সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তার ভূয়া নাম, পদবী ও স্বাক্ষর ব্যবহারের মাধ্যমে কোরিয়ান সিনসিন গ্লোবাল কোম্পানী লিমিটেডের নিকট হতে ৮টি ফায়ার ফাইটিং ট্রাক ক্রয়ে ৯টি ভুয়া ডকুমেন্ট তৈরি করে চুক্তিপত্র সম্পাদন করেছে। মেয়র বলন, বিষয়টি অবহিত হওয়ার পর থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে।
মেয়র বলেন, কোরিয়ান সিনসিন গ্লোবাল কোম্পানী লিমিটেড তৃতীয় কোন পক্ষের মাধ্যমে প্রতারিত হয়েছে নাকি কোম্পানীর প্রেসিডেন্ট বিসি সিন ও তার সহযোগীরা বিভিন্ন ভূয়া ডকুমেন্ট তৈরি করে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনকে ফাঁসানোর জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে, তা যথাযথ তদন্ত ও তথ্য প্রমাণ প্রাপ্তি সাপেক্ষে জানা যাবে।
মেয়র বলেন, ‘আমার সঙ্গে কোনো ফোনালাপ কিংবা আমার ইমেইলে যোগাযোগ না করে ভূয়া ইমেইলে যোগাযোগের মাধ্যমে চুক্তিপত্র সম্পাদনের বিষয়টি অবহিত করার পরও দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে বিসি সিন একাধিকবার যোগাযোগ ও মিথ্যা অভিযোগ দাখিল করেছে। ফলে মেয়র ও রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। যা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্টের গভীর অপচেষ্টা বলে উল্লেখ করেন মেয়র লিটন।
সংবাদ সম্মেলনে মেয়র লিটন বলেন, রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের কার্যাবলীর মধ্যে ফায়ার ফাইটিং সেবা অন্তর্ভূক্ত নয়। বাংলাদেশে ফায়ার ফাইটিং এর জন্য ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স নামক একটি স্বতন্ত্র ও পূর্ণাঙ্গ সরকারী সংস্থা রয়েছে। স্বভাবতই, রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক ফায়ার ফাইটিং ট্রাক ক্রয়ের কোন প্রশ্নই আসে না। বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক ও অযৌক্তিক।
লিটন বলেন, সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়া পিপিএ-২০০৬ ও পিপিআর-২০০৮ অনুযায়ী সিটি কর্পোরেশনের সকল ক্রয় কার্যক্রম সম্পাদিত হয়। যে কোন পণ্য (যানবাহন) ক্রয়ের ক্ষেত্রে যথাযথ নিয়ম মেনে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সরবরাহকারীর নিকট থেকে ক্রয় করা হয়ে থাকে। সরাসরি বিজ্ঞপ্তি ব্যতিরেকে সরকারি অর্থের মাধ্যমে এরূপ বৃহৎ অংকের পণ্য (যানবাহন) কোন সরবরাহকারীর নিকট থেকে ক্রয়ের সুযোগ নেই। সেক্ষেত্রে কোরিয়ান সিনসিন গ্লোবাল কোম্পানীর সঙ্গে ১০ দশমিক ১২ মিলিয়ন ইউএস ডলারের সরাসরি ক্রয়চুক্তি সরকারি ক্রয় নীতিমালা পরিপন্থি ও বাস্তবসম্মত নয়।
এসময় মেয়র লিটন রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সঙ্গে জালিয়াতির বিষয়ে তার নাম, পাাসপোর্ট ইমেইল নম্বরের পূর্ন ব্যাক্ষা দেন। মেয়র বলেন, ২০১৮ সালের ১৩ জানুয়ারি ঝঐওঘঝঐওঘ ঊহমরহববৎরহম ঈড়. খঃফ রাজশাহীতে ১০০ মেগাওয়াট সোলার পাওয়ার প্লান্ট নির্মাণের আগ্রহ দেখিয়ে রাসিক মেয়র বরাবর পত্র দেয়। পত্রের প্রেক্ষিতে সেই সময়ে সিনসিন কোম্পানীর প্রেসিডেন্ট বিসি সিন (ই.ঈ. ঝযরহ) রাজশাহীতে আসেন। একাধিক আলোচনার পর রাসিকের পক্ষ থেকে সোলার পাওয়ার প্লান্ট নির্মাণে অনাগ্রহ দেখানোয় সে সময়েই এ বিষয়টির সমাপ্তি ঘটে।
অথচ ওই ঘটনার তিন বছর পর গত ১ ডিসেম্বর বিসি সিন তার টেলিফোন নম্বর থেকে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের ইঞ্জিনিয়ারিং এ্যাডভাইজার আশরাফুল হককে ফোন করে ৮টি ফায়ার ফাইটিং ট্রাক রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে ক্রয়ের বিষয়ে জানতে চান। তখন সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে কোম্পানিটির কখনোই যোগাযোগ না হওয়ার বিষয়টি বিসি সিনকে জানিয়ে দেওয়া হয়। এরপর বিসি সিন কয়েকটি ই-মেইল পাঠিয়ে তার কোম্পানি থেকে ৮টি ফায়ার ফাইটিং ট্রাক ক্রয় বিষয়ক ভুয়া ডকুমেন্ট প্রেরণ করেন। তবে সিটি কর্পোরেশনের ইঞ্জিনিয়ারিং এ্যাডভাইজার আশরাফুল হকের নিকট প্রেরিত ডকুমেন্ট ও পূর্বের কথিত ইমেইলসমূহ যাচাই করে দেখা যায় যে, বিসি সিন ৮টি ফায়ার ফাইটিং ট্রাক ক্রয় সংক্রান্ত যাবতীয় যোগাযোগ একটি ভূয়া ইমেইল এড্রেস (শযুুধসধহথষরঃড়হ@ুধযড়ড়.পড়স) এর সঙ্গে করেছেন। যা আমার ইমেইল এড্রেস নয়। প্রকৃতপক্ষে, আমার ইমেইল এড্রেস শযুধসধহথষরঃড়হ@ুধযড়ড়.পড়স। লক্ষনীয় যে, আমার ইমেইল এড্রেস থেকে বিসি সিন যোগাযোগকৃত ইমেইল এড্রেসে একটি জেড বেশি। বিসি সিন তার কথিত অর্থ লেনদেনের কোনো পর্যায়ে তিনি আমার সাথে ফোনালাপ বা আমার প্রকৃত ইমেইল এড্রেসে কোন ইমেইল প্রেরণ করেননি বলে জানান মেয়র লিটন।
মেয়র লিটন বলেন, আমার বরাবর কথিত যে চাহিদাপত্র প্রেরণ করেছেন, তার সংযুক্তি হিসেবে প্রাপ্ত ৯টি ডকুমেন্ট যাচাই-বাছাই করে আমার পাসপোর্ট জালিয়াতি ও ভূয়া ইমেইল আইডি ব্যবহার, সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তার ভূয়া নাম, পদবী ও স্বাক্ষর ব্যবহারের বিষয়টি স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়েছে।
মেয়র বলেন, বিসি সিনের ডকুমেন্টে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের যে প্যাড ব্যবহার করা হয়েছে, তা কর্পোরেশনের নয়। এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট এর যে নাম দেখানো হয়েছে, সে নামে কোন এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট সিটি কর্পোরেশনে কখন কর্মরত ছিলেন না। চুক্তিতে মো: ইসলাম খান উদ্দিন নামে সিটি কর্পোরেশনের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার নাম, পদবী ও সীল উল্লেখ রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সিটি কর্পোরেশনে মো: ইসলাম খান উদ্দিন নামে কোন হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা বর্তমানে কর্মরত নেই বা কখনো ছিলেন না। এতে প্রমানিত হয়, কোরিয়ান সিনসিন গ্লোবাল কোম্পানীর চুক্তিপত্রটি বানোয়াট ও ভূয়া। ডকুমেন্টে প্রদত্ত ইমেইল এড্রেস ও মোবাইল নাম্বার মেয়র লিটনের নয়। এছাড়া ডকুমেন্ট হিসেবে সংযুক্ত আছে পাসপোর্টের দুটি জাল পাতা। সেখানে প্রদত্ত আমার নাম, পাসপোর্ট নাম্বার, ইমাজেন্সী কন্টাক্ট ও অন্যান্য তথ্যাদি সঠিক নয়। পাসপোর্টে থাকা ছবিটি পাসপোর্ট সাইজের না। আমার ছবিটি পোস্টার বা ফেসবুক থেকে সংগ্রহ করে পাসপোর্টে লাগানো হয়েছে। সুতরাং বিসি সিনের কথিত লেনদেনের দায় রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন এর উপর বর্তায় না বলে জানান মেয়র লিটন।
আন্তর্জাতিক বাজার হতে বাংলাদেশে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তফশিলী ব্যাংকে এল.সি খোলার মাধ্যমে অর্থ লেনদেন করা হয়ে থাকে। কোরিয়ান সিনিসিন কোম্পানী তাদের স্ব-খ্যাত আবেদনপত্রে দাবী করেছে, রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র কোরিয়ান ঝঐওঘঝঐওঘ এষড়নধষ ঈড়. খঃফ কে ফিলিপাইন ও যুক্তরাজ্যের জনৈক ব্যক্তিবর্গকে ৭৮,৮৯৩ ইউএস ডলার প্রদান করার নির্দেশনা দিয়েছেন। সংযুক্তিতে ক্রয়চুক্তিটি পর্যালোচনা করে দেখা যায় কোরিয়ান ঝঐওঘঝঐওঘ এষড়নধষ ঈড়. খঃফ কর্তৃক দক্ষিণ কারিয়ায় উৎপাদিত ফায়ার ফাইটিং ট্রাক রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনকে সরবরাহ করবেন। সেক্ষেত্রে, রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র কর্তৃক কোরিয়ান ঝঐওঘঝঐওঘ এষড়নধষ ঈড়. খঃফ কে ফিলিপাইন ও যুক্তরাজ্যে অর্থ প্রেরণের নির্দেশনার দাবীটি হাস্যকর ও অযৌক্তিক।
মেয়র বলেন আমার ও রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করায় অপতৎপরতা চলছে। এ ব্যাপারে ইতোমধ্যে বোয়ালিয়া মডেল থানায় জিডি করা হয়েছে। প্রকৃত ঘটনা উল্লেখ করে বাংলাদেশ দূতাবাস, সিউল, দক্ষিণ কোরিয়াকে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে পত্র প্রেরণ করা হয়েছে। চক্রটির বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।


প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২২ | সময়: ৬:৪৫ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ