সর্বশেষ সংবাদ :

রাজশাহীতে অপরিকল্পিত পুকুরখননে খাদ্য সঙ্কটের আশংকা

স্টাফ রিপোর্টার: রাজশাহী জেলার বিভিন্ন উপজেলায় বিগত বছরের ন্যায় আবারো শুরু হয়েছে অপরিকল্পিত পুকুরখনন। তবে পুকুরখনন সিন্ডিকেটের সদস্যরা পরিকল্পিতভাবেই ম্যানেজের মাধ্যমে চালিয়ে যাচ্ছে এই খননযজ্ঞ। পবা উপজেলার অনেক মাঠেই তিন ফসলি জমিতে শুরু হয়েছে সংস্কারের নামে মাটি বিক্রির জন্য পুকুরখনন। চোর-পুলিশ খেলায় বিভিন্ন কারণে হেরে যাচ্ছে পুলিশসহ প্রশাসন। এতে পুকুর খনন বন্ধে উপজেলা ও জেলা প্রশাসনে আবেদন দিয়েও ফলাফল শূণ্যই থেকে যাচ্ছে। প্রেক্ষিতে একদিকে আবেদনকারিরা পড়ছে বিপাকে এবং অন্যদিকে খননকারিরা হচ্ছে উৎসাহিত।
এতে জেলায় কমেছে খাদ্য উৎপাদন, হুমকিতে পড়েছে পরিবেশ। গত পাঁচ বছরে বাণিজ্যিক মাছের খামার বেড়েছে বহুগুণ। কমেছে চারণভূমি, সংকট বেড়েছে পশু খাদ্যের। কৃষি জমি কমেছে প্রায় হাজার হেক্টর (প্রায় ৭৫ হাজার বিঘা)। বর্ষায় জলাবদ্ধতায় ব্যাহত চাষাবাদ।
জানা গেছে, পানি শুকানোর পাশাপাশি জেলার বিভিন্ন উপজেলায় একদিকে জোরেশোরে এবং অন্যদিকে চুপিসারে আবারো শুরু হয়েছে অপরিকল্পিত পুকুরখননযজ্ঞ। প্রশাসনের কর্মকর্তারা দিনে খননকাজে ব্যবহৃত মেশিন অকেজো করলেও রাতে ঠিকই চলছে খনন। আর এ চিত্র জেলার প্রায় সবক’টি উপজেলাতেই। বিশেষ করে পবা, মোহনপুর, দুর্গাপুর, গোদাগাড়ী ও তানোর উপজেলায় পুকুরখনন এখন একেবারে খোলামেলা।
এরইমধ্যে পবা উপজেলার বাগধানি, কর্ণহার, দর্শনপাড়া ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে জোরেশোরে চলছে পুকুরখনন। প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলের নাম ভাঙ্গিয়ে চলছে এসব পুকুরখনন। চলতি বছরের গত ৯ জানুয়ারী অবৈধ পুকুর খনন সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের আবেদনে স্বাক্ষর করেছেন দর্শনপাড়া ইউনিয়নের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান শাহাদৎ হোসেন সাব্বির নিজেই। জেলা প্রশাসন বরাবরে এ আবেদন করেছেন এলাকাবাসী।
আবেদন থেকে জানা গেছে, দারুশা এলাকার মৃত হারুনার রশিদ ওরফে হারানের ছেলে পুকুরখনন সিন্ডিকেটের প্রধান মিনারুল ইসলাম বিগত কয়েক বছর থেকে কর্ণহার ও এর আশেপাশের বিল এলাকায় পরিবেশ ও রাস্তাঘাট নষ্ট করে বেপরোয়াভাবে অবৈধ পুকুরখনন চালিয়ে যাচ্ছে। নতুনভাবে কর্ণহার গুচ্ছগ্রামের পাশে ১২৫ বিঘা পুকুরসহ আরো কয়েকটি পুকুরখনন করছে। যা জেলা প্রশাসকের নির্দেশে উপজেলা প্রশাসন থেকে অভিযান চালানোর পরেও এখনো দিন-রাত পুকুরখনন চালিয়ে যাচ্ছে সে। আর এর সাথে জড়িত আছে নগরীর কয়েরদাঁড়া এলাকার মৃত আব্দুস সামাদের ছেলে আব্দুল লতিফ বাবু। একটি অসমর্থিত সূত্র দাবি করেছে পবা উপজেলা সহকারি কমিশনার ভূমি’র গাড়িচালক কবির হোসেনের আত্মীয় এই বাবু। ওই এলাকায় কবিরের ছত্রছায়ায় পুকুর খনন হচ্ছে বলে ওই সূত্রটি দাবি করেছে। ভ্রাম্যমাণ অভিযানের আগে কবিরই পুকুরখনন সিন্ডিকেটের সদস্যদের জানিয়ে দেয় বলে অভিযোগ উঠেছে। এমনকি ভ্রাম্যমাণ আদালতে ব্যাটারি ও অন্য যন্ত্রপাতি তার মাধ্যমে রাতের আঁধারে আবারো চলে যায় সেখানেই।
এদিকে রাজনৈতিক জবাবদিহিতা ও প্রশাসনের হস্তক্ষেপ ছাড়া এই অপরিকল্পিত পুকুরখনন কখনোই সম্ভব নয়। এছাড়াও জনসচেতনতা বৃদ্ধি খুবই জরুরী হয়ে পড়েছে। পুকুর খননে মাছের লাভের চেয়ে অনেক বেশী ক্ষতি হচ্ছে কৃষিজীবী ও পরিবেশের। সংসদ সদস্য, প্রশাসন, জনপ্রতিনিধিদের মদদেই অপরিকল্পিত পুকুর খননের মহোৎসব চলছে বলে জানিয়েছেন সচেতনমহল, পরিবেশবাদি ও ভুক্তভোগিরা।
রাজশাহী জেলায় বাণিজ্যিক মাছের খামার বেড়েছে প্রায় ৩ গুন। মাছের উৎপাদন বাড়ায় একে সাফল্য হিসেবে দেখছে মৎস দপ্তর। এই সাফল্যই সুদুরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভার ফেলেছে কৃষিজীবীদের। শুধুমাত্র অপরিকল্পিত পুকুরখননের জন্যই রাজশাহী জেলার বিভিন্ন ফসলের মাঠে দেখা দিয়েছে জমির প্রকৃতি পরিবর্তন, দীর্ঘ মেয়াদি জলাবদ্ধতা, পুকুরখননে মাটি বহনে গ্রামীণ রাস্তা নষ্ট, ফসল উৎপাদন ব্যাহত, বিলের পানি বেরুনোর নালা (খাল, ড্রেনেজ) ব্যবস্থা না থাকায় গ্রামের বাড়ি-ঘরে জলাবদ্ধতা, কৃষিজীবীদের মধ্যে বেকারত্ব বৃদ্ধি, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্ঠনী নষ্ট, কৃষিকাজ না থাকায় যুব সমাজ মাদকে আসক্ত হচ্ছে এবং সর্বপুরি নগরীতে ভাসমান শ্রমিক বাড়ছে। অপরিকল্পিত পুকুরখননের ফলে এসব না সূচক ও নেতিবাচক প্রভাব দেখেও অজানা কারণে নিশ্চুপ আছে প্রশাসন ও রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ। সচেতনমহল, পরিবেশবাদি ও ভুক্তভোগিরা পরোক্ষ ও প্রত্যেক্ষভাবেই দোষারোপ করে আসছে তাদের।
জেলার কৃষি দপ্তর বলছে, বাণিজ্যিকভাবে এসব পুকুর খনন হয়েছে আবাদি জমিতেই। অপরিকল্পিতভাবে পুকুর খননে জলাবদ্ধতায় প্রতি বছরই ব্যাপক ফসলহানি হচ্ছে। ফসল হানির পরিমান প্রতিবছরই অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। পরিবেশের উপর বাড়ছে চাপ। এছাড়াও ফসল রোপনের আগেই ডুবে যাচ্ছে খনন এলাকা।
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে জেলায় মোট জমির পরিমাণ ২ লাখ ৪২ হাজার ৯৩১ হেক্টর। এক শতাংশও আবাদযোগ্য পতিত জমি নেই। ২০০৭-২০০৮ সালেও জেলায় আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ছিল এক লাখ ৯১ হাজার ৭৮০ হেক্টর। ২০১২-২০১৩ মেয়াদে তা গিয়ে দাঁড়ায় এক লাখ ৯০ হাজার ৮১০ হেক্টরে। এখন আবাদযোগ্য জমি রয়েছে এক লাখ ৮৮ হাজার ৭৫৮ হেক্টর। এক দশকে আবাদযোগ্য জমি কমেছে ৩ হাজার হেক্টরের উপরে। এর একটি বড় অংশ চলে গেছে বাণিজ্যিক পুকুর খননে। পরের বছরগুলো চিত্র আরো ভয়াবহ। জ্যামিতিক হারে কমছে জেলার কৃষি জমি। সচেতন মহল ও বিশেষজ্ঞদের মতে সঠিক হিসাব করলে প্রায় পুকুর ঘেরের জন্য কষি জমি নষ্টে ১০ হাজার হেক্টর ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
সূত্রমতে, ২০১৭ সালে জেলায় মোট জলাশয়ের পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ২৯৪ হেক্টর। সেখানে বাণিজ্যিক মাছের খামার ছিল ৩ হাজার ৪৬২ হেক্টর। ২০১৮ সালে বাণিজ্যিক খামারের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় ১২ হাজার ৩০৯ হেক্টর। বাণিজ্যিক খামার বৃদ্ধির সেই হিসেবে রাজশাহীতে পুকুরের মধ্যে প্রবেশ করেছে ৮ হাজার ৮৬৭ হেক্টর জমিতে। এ হিসেব তো ২০১৮ সালের। সেই থেকে পুকুর খনন চলছেই। এমন কি করোনার মধ্যেই থেমে ছিল না পুকুর খনন। দানব এস্কেভেটর মেশিন থাবা বসিয়েই চলেছে কৃষি জমিতে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শ্রেণি পরিবর্তন করে আবাদযোগ্য জমিতে পুকুর খননের সুযোগ নেই। তারপরও এক শ্রেণির অসাধু ব্যক্তি নানান কৌশলে পুকুর খনন করে যাচ্ছে। বিশেষ করে বিল ও নিচু এলাকাগুলোতে অনাবাদি কিংবা এক ফসলি দেখিয়ে পুকুর খনন করছেন। মুনাফালোভীরা সেই সুযোগটিই নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন কৃষি বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা।
জানা গেছে, মৎস্য খামারিরা সাধারণত ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের জমি বছর মেয়াদি লিজ নিচ্ছেন কাউকে জমি বিক্রি করতে বাধ্যও করছেন। তাছাড়া জলাবদ্ধতার কারণে চাষাবাদ না হওয়ায় চাষিরাও জমি লিজ অথবা বিক্রি করছেন। পুকুর খনন করে পানি নিষ্কাশনের কোনো ব্যবস্থা রাখছেন না খামারিরা। ফলে বর্ষায় জলাবদ্ধতায় ব্যাহত হচ্ছে চাষাবাদ। কৃষকরা বলছেন, ফসলি জমি কেটে আসলে পুকুর হচ্ছে না, বরং ঘের হচ্ছে। মাত্র চার থেকে পাঁচ ফুট খনন করা হচ্ছে। কিন্তু পুকুর করতে হলে অন্তত ১৫ থেকে ২০ ফুট গভীর করে খনন করতে হয়। কিন্তু খামারে খনন হচ্ছে মাত্র ৫-৮ ফুট।
শিক্ষক মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে পুকুর খনন চলছে জেলার নয় উপজেলাতেই। আগে ছিল জমিদারদের দখলে, নীলকরদের দখলে। বর্তমানে জেলার কৃষি জমি এখন অলিখিতভাবে পুকুরখননকারিদের দখলে। রাষ্ট্রযন্ত্রের জেলা উপজেলার কর্তা ব্যক্তিরা নীরব ভূমিকা পালন করছেন। এতে পুকুর খননকারিরা উৎসাহিত হচ্ছে’।
তিনি আরো বলেন, ‘ভূক্তভোগিরা বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দিয়ে নির্যাতনের ঝুকির মধ্যে থাকছে। আবার কোন ঘের মালিক হাই কোর্টে রিট করে পুকুরখনন করছে। এতে অনেকগুলো ঝুকি থাকলেও প্রশাসন উদ্যোগ নিচ্ছেন না। পাশাপাশি রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মদদে পুকুরখননের হিড়িক চলছে’। স্থানীয় সংসদ সদস্য, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও জনপ্রতিনিধিরা যদি মনে করেন নিজ নিজ এলাকায় এই অপরিকল্পিত পুকুরখনন করতে দিবেন না, তবে কখনোই পুকুরখনন নয়। সর্ষের মধ্যে ভুত থাকলে প্রশাসনের পক্ষে বারবার অভিযান করেও পুকুরখননরোধ সম্ভব নয়।
পুকুর খনন শুরু হয়েছে জেলার পবা, মোহনপুর, গোদাগাড়ী, বাগমারা ও দুর্গাপুরে। আবারো কৃষি জমি হননের মহোৎসব চলছে। ক্ষুদ্র চাষিরা অনেক সময় প্রভাবশালীদের ভয়ে, সাময়িক বেশী লাভের আশায় এবং শ্রম থেকে রেহাই পেতে পুকুর খনন করতে দিচ্ছে। কিন্তু প্রশাসন এই অপরিকল্পিত পুকুর খনন রোধে বরাবরই জেগে জেগে ঘুমাচ্ছেন। যা এ অঞ্চলে ভবিষ্যতে কৃষিতে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে।
বর্তমানে জেলার যে উপজেলাতেই পুকুরখনন হচ্ছে-তা আওয়ামী লীগ নেতা ও নেতার ছত্রছায়াই হচ্ছে।
রাজশাহী নগরীর উপকণ্ঠ পবা উপজেলার পারিলা ইউনিয়ন পরিষদ সাাবেক চেয়ারম্যান সাইফুল বারী ভুলু জানান, কয়েক বছরে তার ইউনিয়নের অর্ধেক আবাদি জমি পুকুরে চলে গেছে। যেটুকু জমি অবশিষ্ট ছিল নতুনভাবে তাতেও চলতে শুরু করেছে খননযন্ত্র। অপরিকল্পিত পুকুর খননে জলাবদ্ধতায় ফসলহনিসহ জনদুর্ভোগের সৃষ্টি করছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক উপপরিচালক ছামশুল হক বলেন, অধিকাংশ পুকুর খনন করা হয়েছে নিষ্কাশন নালা, এমনকি ব্রিজ-কালভার্টের মুখে। এতে হালকা বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। শুধু ফসল নষ্টই নয়, পুকুর খনন বেশি হওয়ায় গ্রামে গৃহপালিত প্রাণিও কমে যাচ্ছে। চারণভূমি সংকটে মানুষ গরু, মহিষ ও ছাগল প্রতিপালনে নিরুৎসাহিত হচ্ছে। কৃষকরা জানান, এসব অঞ্চলের ধান ও পাট, পানের বরজ, মরিচ, শাকসবজির উৎপাদন কমে যাচ্ছে।
পবা উপজেলা সহকারি কমিশনার ভূমি শেখ এহসান উদ্দীন বলেন, অভিযান হচ্ছে না বিষয়টি সঠিক নয়। পারিলা ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বড়ভালাম এলাকায় অভিযান চালিয়ে স্বপন ও রফিকের পুকুরখনন কাজ বন্ধ করা হয়েছে। এছাড়াও সম্প্রতি কর্ণহার বিলে মিনারুলের খননকৃত পুকুরেও অভিযান চালিয়ে দু’টি এস্কেভেটর মেশিন বিকল করা হয়েছে। প্রশাসন এ ব্যাপারে কার্যকরি পদক্ষেপ নিচ্ছে।


প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৬, ২০২২ | সময়: ৬:১৮ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ