আসাদুজ্জামান নূর : রাজশাহী নগরীর উপশহরে প্রসিদ্ধ মাষকলাই রুটির দোকান ‘কালাই হাউজ’। দোকানের সামনে হুইল চেয়ারে বসে আছেন এক প্রতিবন্ধী যুবক। একটি পা নেই, আরেকটি অক্ষম। চেয়ারের পেছনে ফুডপান্ডার খাবার বহন করার ব্যাগ। কিছুক্ষণ পরেই দোকানের এক কর্মচারী কালাইরুটি ও অন্যান্য খাবার নিয়ে এলেন। ভরে দিলেন হুইল চেয়ারের পেছনের ব্যাগে।
হুইল চেয়ার আরোহী ফোনে কথা বলে ছুটলেন তার গন্তব্যস্থলের দিকে। থামলেন নগরীর সিলিন্দা বটতলা মোড়ে। অপেক্ষমান গ্রাহক সাঈদ সাতিলের হাতে খাবার তুলে দিয়ে বুঝে নিলেন ২৮৫ টাকা। এখান থেকে তার আয় হবে ২২ টাকা।
শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী ফুডপান্ডার এই সাপ্লাইয়ারের নাম জাহিদুল ইসলাম পলাশ (২২)। নগরীর কাজলার ধরমপুর পশ্চিম পাড়ায় তার বাড়ি। বাবা নাজির আলি (৫০) একজন রিকশাচালক। মা জানেহার বেগম (৪০) গৃহিনী। তিন ভাইয়ের মধ্যে পলাশ দ্বিতীয়।
পলাশের জন্ম ১৯৯৮ সালে। জন্মের পরে সুস্থ-সবল ছিলেন। বেড়ে উঠছিলেন আর দশজনের মতই। কিন্তু ২০১০ সালের ১৮ ডিসেম্বর একটি দুর্ঘটনা জীবনের মোড় বদলে দেয়। নগরীর কাজলায় বৈদ্যুতিক তার খসে পড়ে তার গায়ে।
জ্ঞান ফেরার পরে নিজেকে আবিষ্কার করেন ঢাকায় একটি হাসপাতালের বার্ণ ইউনিটে। বাম পায়ের হাড় ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট ছিলনা। হাটুর নিচে থেকে সেটা অপসারণ করা হয়েছে। আর ডান পায়ের ৩টা আঙ্গুল ও রগ (ভেইন) নেই। ফলে শরীরের সঙ্গে থাকলেও সেটা আর তেমন কাজ করেনা। প্লাস্টিক সার্জারি রয়েছে ঘাড়ের উপরেও। এরপর থেকেই শুরু হয় পলাশের হুইল চেয়ারের জীবন।
পলাশ জানান, সপ্তাহ দুয়েক হলো ফুডপান্ডার রাইডার হিসেবে কাজ করছেন। ফাঁকা সময়ে তিনি এই খাবার সরবরাহের কাজটা করেন। নির্ধারিত জোনের ২০০-৫০০ ফিটের মধ্যে প্রতিটি ডেলিভারির জন্য পান ২২ টাকা। এর বাইরে যেতে হলে প্রতি কিলোমিটারের জন্য যোগ হয় আরও দুই টাকা। এভাবে ডেলিভারি প্রতি ২২ থেকে ৩২ টাকা পর্যন্ত পান পলাশ।
পলাশ জানালেন, ফুডপান্ডায় ৩ ঘন্টা ও ৬ ঘন্টার কাজের শিফট থাকে। নিজের শারীরিক অক্ষমতার কারনে সবসময় শিফট ধরতে পারেন না। তখন অন্য কারো শিফট চেয়ে নিয়ে কাজ করেন। সোমবার বিকেল ৫টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত কাজ করেছেন। এই সময়ে আয় করেছেন ২৫৬ টাকা। আর গত ২ সপ্তাহে তার মোট আয় ১ হাজার ৪০০ টাকা।
উচ্চতর ডিগ্রী নিতেই ফুডপান্ডায় কাজ করছেন পলাশ। নগরীর দেওয়ানপাড়াস্থ মেট্রোপলিটন বিজনেস ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছেন। ভালো একটা বিশ^বিদ্যালয় বা কলেজ থেকে লেখাপড়া শেষ করতে চান পলাশ। তার জন্য জমাচ্ছেন টাকা।
পলাশ বলেন, বাবার রিকশা চালানোর আয় দিয়েই অনেক কষ্টে সংসার চলে। ছোট ভাই নুরুজ্জামান প্রান্ত এসএসসি পরীক্ষা দেবে। দুজনের লেখাপড়ার ব্যয় বহন করতে হিমশিম খাচ্ছেন বাবা। এর মাঝে ছোট ভাইটাও বসে থাকেনা। নিজের পকেট খরচের জন্য মাঝে মাঝে মানুষের কাজে লেগে পড়ে। তাই আর বসে থাকতে পারলাম না। নিজেকে আত্মনির্ভরশীল করতে এবং উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পথে আর্থিক অসঙ্গতি যেন বাধা হয়ে না দাঁড়াতে পারে তাই ফুডপান্ডায় কাজ শুরু করলাম।
পলাশ বলেন, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। অন্যের উপর নির্ভরশীল না হয়ে স্বাবলম্বী হতে চাই। যেন কারও কাছে হাত পাততে না হয়।
সুখী, সমৃদ্ধ ও উন্নত একটি বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন পলাশ। যেখানে প্রতিবন্ধী ও সক্ষম মানুষের মধ্যে থাকবে না কোনো ভেদাভেদ। তিনি জানান, প্রতিবন্ধীদেরকে সমাজের মূলধারায় সম্পৃক্ত করতে চান। এজন্য প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘আশার আলো প্রতিবন্ধী উন্নয়ন সংগঠন’। এরই মধ্যে সংগঠনে যুক্ত হয়েছেন ৬০ জন প্রতিবন্ধী।
করোনা দুর্যোগের সময় একক প্রচেষ্টায় মেয়রের ত্রাণ তহবিল থেকে ৯০০ কেজি পাইয়ে দিয়েছেন সংগঠনের সদস্যদের। শীতবস্ত্রের জন্য আবেদন করেছেন। সেটা পেলেই বিতরণ করবেন বলে জানান তিনি।
পলাশ বলেন, নিজের উদ্যোগে সংগঠন চালিয়ে যাচ্ছি। এভাবে চালাতে থাকবো। এরপর একটা চাকুরী পেলে সংগঠনকে চাঙ্গা করতে পারবো। সবকিছু ভেবে দেখলাম, আগে নিজেকে কিছু করতে হবে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। তারপর ইচ্ছেমত সংগঠের জন্য ও মানুষের জন্য কাজ করবো।
এখানেই শেষ নয়, পলাশের রয়েছে অসাধারণ ক্রীড়া দক্ষতা। বাংলাদেশ হুইল চেয়ার স্পোর্টস ফাউন্ডেশনের নিবন্ধিত প্লেয়ার সে। ফাউন্ডেশনের আয়োজনে ২০১৯ সালে জাতীয়ভাবে অনুষ্ঠিত ডার্ট প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। প্রাণশক্তিতে ভরপুর পলাশ বর্তমানে গ্রাফিকস ডিজাইনের উপর প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।
পলাশ বলেন, প্রতিবন্ধী মানুষ হলেও আমি স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছি। একজন প্রতিবন্ধী মানুষ কৃষিকাজ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের নেতৃত্বের জায়গাতেও অবদান রাখতে পারেন এবং সেটা সম্ভব বলে আমি বিশ^াস করি। তাই নিজের সামর্থের উপর আস্থা রেখে সৃষ্টিকর্তার ভরসায় এগিয়ে চলেছি।
পা নেই তবুও ফুডপান্ডার রাইডার পলাশ
জানুয়ারি ২৭
০৬:১৫
২০২১