স্টাফ রিপোর্টার, শিবগঞ্জ: চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার ১২ নং পাঁকা ইউনিয়নের একটি প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ প্রমানের পর অন্যান্য প্রকল্প গুলোতেও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। সংশ্লিষ্ট বিভাগে এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আবেদন জানিয়েও নেয়া হচ্ছেনা কোন পদক্ষেপ।
এদিকে অতি দরিদ্র কর্মসংস্থান কর্মসূচির আওতাধীন প্রকল্পের অনিয়ম প্রমানিত হবার পরও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে এখনো নেয়া হয়নি কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। অনিয়মের মাধ্যমে সুবিধাভোগীরা গত ৪ বছর ধরে সুবিধা নিয়ে আসলেও এসব সরকারী সুবিধা বন্ধ বা অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার চিঠি চালাচালির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। এছাড়াও মাতৃত্ব কালীন ভাতা ও ভিজিডি প্রকল্পের অনিয়মের একাধিক অভিযোগ থাকলেও তা এখনও তদন্তই করেনি সংষিøষ্ট বিভাগ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পাঁকা ইউনিয়নের ৮ জন ওয়ার্ড সদস্য এবং ৩ জন সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ড সদস্যের মধ্যে শুধুমাত্র ৭ নং ওয়ার্ড সদস্যের বিরুদ্ধে কোন অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যাযনি। ১ নং ওয়ার্ড সদস্য নজরুল ইসলাম মেহেদীর তৈরীকৃত ভিজিডি তালিকায় এক এবং মাতৃত্বকালিন ভাতার তালিকায় নিজ স্ত্রীসহ এক নিকট আত্মীয়ের নাম রয়েছে।
২নং ওয়ার্ড সদস্য আজিজুল ইসলাম রেনুর প্রেরিত হত দরিদ্রদের কর্মসূচি প্রকল্পের তালিকায় নিজ ছেলে হাসান আজিজের (তালিকায় ১৪ নম্বরে) নামসহ ৫ আত্মীয়ের নাম রয়েছে।
৩ নং ওয়ার্ড সদস্য রমজান আলীর হত দরিদ্রদের কর্মসূচির প্রেরিত তালিকায় নিজ ভাইসহ ৭ নিকট আত্মীয়ের নাম, ভিজিডির তালকায় ৪ এবং মাতৃত্বকালিন ভাতাভোগীর তালিকায় ২ নিকট আত্মীয়ের নাম রয়েছে।
তালিকায় দেখা গেছে মাতৃত্বকালিন ভাতা ও ভিজিডির তালিকায় রমজানের ফুফাত বোন সাবিনা বেগম, ফুফাত ভাবি ও ফুফুর নাম রয়েছে। শুধু তাই নয় ১৭-১৮ অর্থ বছরে ও ১৯-২০ অর্থ বছরে মাতৃত্বকালিন ভাতায় এবং ১৯-২০ অর্থ বছরে ভিজিডির তালিকায় এদের নাম রয়েছে।
৪ নং ওয়ার্ড সদস্য জসিমের তালিকায় অতি দরিদ্র কর্মসূচির তালিকায় ২ ভাই মাহমুদুল্লাহ ও ফাজেলের নাম সহ ৭ আত্মীয়ের নাম, ভিজিডির তালিকায় বোন জাহান্নারা খাতুন (তালিকায় ৪৩) ও স্ত্রী সানজিদা বেগম (তালিকায় ৪৪) এবং মাতৃত্বকালিন ভাতাভোগীর তালিকায় রয়েছে অপর এক বোনের নাম।
৫ নং ওয়ার্ড সদস্য রুহুল আমিনের অতি দরিদ্র কর্মসূচির তালিকায় রয়েছে ছেলে আসাদুজ্জামানের (তালিকায় ৪৯ নম্বরে) নাম।
৬ নং ওয়ার্ড সদস্য কাইয়ুমের হতদরিদ্র সুবিধাভোগীদের তৈরীকৃত তালিকাতে ভাই মতিনের নামসহ (তালিকায় ৫৫ নম্বরে) ৫ আত্মীয়ের নাম ভিজিডির তালিকায় ৩ মাতৃত্বভাতার তালিকায়-১ আত্মিয়ের নাম রয়েছে।
৮নং ওয়ার্ড সদস্য তরিকুল ইসলামের ভিজিডি তালিকায় স্ত্রী মোস্তারা খাতুনসহ ২, মাতৃত্ব তালিকায় ছেলের বৌসহ ৪ আত্মীয়ের নাম রয়েছে। এছাড়া ভাস্তের স্ত্রী আইরিনের নামে ভিজিডি, ১০ টাকা কেজির চাল এবং মাতৃত্ব ভাতাভোগের অভিযোগ রয়েছে।
বিভিন্ন সুত্র জানায় গত ১৯-২০ অর্থবছরের ৪০ দিনের অতি দরিদ্রদের কর্মসংস্থান কর্মসূচি প্রকল্পে ৮ নং ওয়ার্ড সদস্য তরিকুল ইসলাম চরপাঁকার মৃত নজরুল ইসলামের ছেলে রবিউল ইসলামের নামে দিনমজুর হিসেবে নিয়োগ দিয়ে তার অনুকূলে শিবগঞ্জ উপজেলা সদরের রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকে একাউন্ট খুলে ৮ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেন। এনিয়ে তদন্ত হলে রবিউল লিখিত ভাবে এ বিষয়ে কিছুই জানেনা বলে জানিয়েছে তদন্ত কমিটিকে।
এদিকে ১ নং ওয়ার্ড সদস্য নজরুল ইসলাম মেহেদী তার ভাই আশরাফুল হককে তদবীর করে ১০ টাকা কেজি চালের ডিলারসিপ নিয়ে দেয়ার পাশাপাশি তার নামে অতি দরিদ্রদের কর্মসংস্থান কর্মসূচি প্রকল্পে নাম তালিকাভুক্তির পাশাপাশি ৬ নিকট আত্মীয়ের নাম তালিকাভুক্ত করেন।
অপরদিকে ৯ নং ওয়ার্ড সদস্য গোলাম মোস্তফার তদবীরে অতি দরিদ্র কর্মসূচির তালিকায় ছেলে লালবর আলী, ভগ্নিপতি খলিলুর রহমান, ভাগ্নে শহিদুলসহ ১০ আত্মীয়ের, ভিজিডির তালিকায় ৩ আত্মীয় এবং মাতৃত্বকালিন ভাতার তালিকায় ২ নিকট আত্মীয়ের নাম রয়েছে।
অনিয়মে পিছিয়ে নেই মহিলা ওয়ার্ড সদস্যরাও। ৩ জন মহিলা ওয়ার্ড সদস্যদের সবার ঐ তিনটি প্রকল্পে রয়েছে নিকট আত্মীয় ও অবিবাহিত মহিলার নাম।
তালিকা যাঁচাই করে দেখা গেছে ১, ২ ও ৩ নং সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ড সদস্য মেরিনা খাতুনের ভিজিডি ভাতা ভোগীর তালিকায় ২ এবং মাতৃত্বকালীন ভাতার তালিকায় ৪ জন নিকট আত্মীয়ের নাম রয়েছে। শুধু তাই নয় তিনি তার মেয়ের বিয়ে সদর উপজেলার নারায়নপুর ইউনিয়নে বিয়ে দেয়ার পরও নিজ ইউনিয়নে ১৭-১৮ অর্থ বছরে মেয়ের নামে মাতৃত্বকালীন ভাতায় ভাতা তুলেছেন। পাশাপাশি অবিবাহিত সন্ধ্যা রানীর (২৯), নাম মাতৃত্বকালিন ভাতা ভোগীর তালিকায় দিয়ে ভাতা ভোগ করেছেন। নিজ ছেলের বৌ ২ (৩১,৩২) জনের, নিজ ভাগ্নে বৌ এর নাম (৩০) ৪, ৫ ও ৬ নং সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ড সদস্য সুফিয়া বেগম ৩ জনের নাম ভিজিডির এবং তিনজনের নাম মাতৃত্বকালীন ভাতাভোগীর তালিকায় তুলেছেন। এছাড়াও অতি দরিদ্র পকল্পের তালিতায় স্বামী হোসেন আলী, তিন মেয়ে মেয়ে আমেনা মৌসুমি সালমা ও ছেলে রাকিবুলের নামে ভাতাভোগ করেছেন।
এছাড়াও ৭, ৮ ও ৯ সংরক্ষিত ওয়ার্ড সদস্য শাহনাজ বেগম হত দরিদ্র তালিকায় তার স্বামী লালবর, নারায়নপুর আদর্শ কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আবুল কালাম সহ ৬ নিকট আত্মীয়ের নাম সংযুক্ত করলেও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ তদন্ত কমিটির কাছে ভাতা প্রাপ্তির বিষয়ে কিছুই জানেনা বলে লিখিতভাবে অস্বীকার করেন।
অনিয়মের ব্যাপারে নজরুল ইসলাম জানান, রাজনীতি করতে গেলে এক একটু অনিয়ম হয়। তদন্তে তার ভায়ের ১০ টাকা কেজি চালের ডিলারসিপ বাতিল হয়েছে। তবে অন্যন্য প্রকল্পে তিনি কোন অনিয়ম করেননি বলে দাবী করেন। আর রমজান আলী কোন ধরনের অনিয়মের সাথে জড়িত নয় বলে দাবী করেন।
এছাড়াও তরিকুল ইসলামকে ফোনে না পাওয়া যাওয়ায় এবং অন্যান্য অভিযুক্তদের মোবাইল ফোন নম্বর বন্ধ থাকায় তাদের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাকিব আল রাব্বি জানান, ২০১৯-২০ অর্থ বছরের হতদরিদ্র প্রকল্পের বিভিন্ন অনিয়ম নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাকে নিয়ে তদন্ত হয়েছে তার কার্যালয়ে। তদন্ত প্রতিবেদন জেলা প্রশাসকের কাছে প্রেরণ করা হলে তিনি স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রনালয়ে পাঠিয়েছেন। প্রেক্ষিতে ২৯ নভেম্বর উপসচিব ইফতেখার আহম্মেদ চৌধুরি স্বাক্ষরিত এক পত্রে কি পরিমান অর্থ আত্মসাৎ হয়েছে এবং এর সাথে কারা জড়িত তার পুর্ণাঙ্গ বিবরণ চেয়ে জেলা প্রশাসককে চিঠি দেয়া হয়। সে মোতাবেক সকল তথ্যাদি জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে মন্ত্রনালয়ে পাঠানো হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, অন্যান্য প্রকল্পের ব্যাপারে এখনও কোন অভিযোগ পাওয়া যায়নি। তবে অভিযোগ পাওয়া গেলে সেগুলোর ব্যাপারেও যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
২০১৬ সালের ৭ মে নির্বাচন পাঁকা ইউনিয়নের নির্বাচন হবার পর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা এসব প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম আরম্ভ করে।
শিবগঞ্জে প্রকল্প নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ
ডিসেম্বর ২৬
০৬:৫৫
২০২০