শাহ্জাদা মিলন : ক্রিকেটের উর্বর ভূমি বলা হয় রাজশাহীকে; সেই ভূমির উদীয়মান ক্রিকেটাররা কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছানোর আগেই ঝরে যাচ্ছে। বিকল্প কিছু পেলেই ছাড়ছে ক্রিকেট। নিয়মিত খেলা না হওয়া, প্রত্যাশিত পারিশ্রমিক না পাওয়া, খেলার সরঞ্জামের মূল্য বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা, একাডেমিভিত্তিক দ্বন্দ্ব, পরিবারের চাপই এর অন্যতম কারণ বলে জানা গেছে।
ফরহাদ রেজা, সাব্বির রহমান, সানজামুল ইসলাম, মুক্তার আলী, সাকলাইন সজীব, নাজমুল হোসেন শান্ত’র পর কে হাল ধরবেন রাজশাহীর ক্রিকেটের? এই প্রশ্নটা ঘুরেফিরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।
রাজশাহীর ক্রিকেটার মামুন হোসেন (২৫)। অনুর্ধ্ব-১৭ জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন নেপালে। রাজশাহীতে প্রিমিয়ার খেলেছেন ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত। ঢাকা প্রথম বিভাগ লীগ খেলেছেন ২০০৮ থেকে ২০১৪ সাল। দেশের বিভিন্ন জায়গায় খেলেছেন একসময়। বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগে সেকশন অফিসার হিসেবে চাকরি করছেন। ক্রিকেট খেলার নেশাকে পরিণত করতে পারেননি পেশায়। বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে ছুটেছেন চাকরির পেছনে।
মামুন হোসেন বলেন, রাজশাহীতে খেলার যে অবস্থা এখন! কোনো খেলায় তো হয় না। জেলা ক্রীড়া সংস্থায় যারা আছেন তারাই ভালো জানেন। এখনো একটা নতুন ছেলেকে রাজশাহী প্রিমিয়ার লীগে খেললে দেয়া হয় ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা। অনেক ছেলেকে ফ্রি খেলানো হয়। সারাবছর পরিশ্রম করা একটা ছেলেকে দুই চার হাজার টাকা হাতে ধরিয়ে দেয়া হয় রিকশার খরচ বলে। ক্রিকেটের একটা ব্যাটের দাম এখন সর্বনিম্ন ১০ থেকে ১২ হাজার। এক জোড়া স্পাইকের (জুতা) দাম তিন হাজারের বেশি। আর কতো কিছু লাগে খেলতে। সবার পরিবারের অবস্থা একরকম না। ক্লাব হাউজগুলোকে প্লেয়ারদের কষ্ট বোঝা দরকার। এভাবে প্লেয়ার তৈরি হয় করা কঠিন।
তিনি আরও বলেন, একাডেমিগুলোতে বেতন ও অন্যান্য যে সকল খরচ আছে সে হিসেব করলে বছরে পঞ্চাশ হাজার টাকা খরচ পড়ে যায় সব মিলিয়ে। অথচ আয়ের রাস্তা নাই বললেই চলে। অনেক প্লেয়ার আছে যারা এক বেলা প্র্যাকটিস করছে; আরেক বেলায় অন্য কাজ করে পেট চালাচ্ছে। প্লেয়ারদের আয়ের উৎস হচ্ছে ম্যাচ খেলা। সেটাইতো বন্ধ। প্লেয়ার টিকবে কিভাবে তাহলে?
২৫ বছর বয়সী সাগর হোসেন হেলাল। রাজশাহী প্রিমিয়ার লীগসহ ঢাকা দ্বিতীয় বিভাগ লীগ খেলেছেন পাঁচ বছর। গত বছর সুযোগ পেয়ে একটি বেসরকারি ব্যাংকে জুনিয়র অফিসার হিসেবে চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। জানালেন ক্রিকেট ছাড়ার কারন। তিনি বলেন, ক্রিকেটে ভরসার জায়গা নাই, তাই চাকরি খুঁজছিলাম। রাজশাহী জেলা টিমে প্লেয়ার বাছাইয়ের সময় নিরপেক্ষতা বজায় থাকেনা বলে মন্তব্য করে তা স্বচক্ষে দেখার আহ্বান জানান এ প্রতিবেদককে।
সাব্বির হোসেন মিঠু (২৫) নামের আরেক খেলোয়াড় ঢাকা লীগে প্রথম বিভাগে তিন বছরসহ মোট পাঁচ বছর খেলেছেন। রাজশাহী প্রিমিয়ার লীগে ২০১১ সাল থেকে খেলছেন। তবে পেট চালানোর জন্য মোবাইলের দোকানে চাকরি করছেন। একাডেমির খরচ চালানোর মতো আয় না হওয়ায় বিকল্প আয় খুঁজে বের করার কথা জানান তিনি।
মামুন, সাগর ও মিঠুর মতো জনি, সবুজ, সুমনের মত অনেক ক্রিকেটার মাঝ বয়সে খেলা ছেড়ে আয়ের রাস্তা খুঁজে ফিরছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজশাহী ডিভিশনের তিনজন সিনিয়র ক্রিকেটার জানান, প্রিমিয়ার লীগ হয় কিন্তু ম্যাচের সংখ্যা কমে গেছে। আগে প্রতিটা দল একে অপরের সাথে ম্যাচ খেলতো। দশ টিমের খেলায় প্রতিটা দল নয়টি করে ম্যাচ খেলতো। এখন দুই গ্রুপ করে ম্যাচ খেলানো হয়। দলগুলো ম্যাচ পায় পাঁচটি করে।
হতাশার সুরে জানালেন, অন্যান্য জেলায় খেললে ভালো টাকা দেয়। যদিও তাদের চেয়ে রাজশাহীর ক্রিকেটের মান অনেক ভালো। এখন সিরাজগঞ্জে ভালো টুর্ণামেন্ট হয়। দেশের নামকরা প্লেয়াররা সেখানে যায়। প্লেয়ারদের উৎসাহের জন্য টিভিতে খেলা দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়। এটা রাজশাহীর জন্য লজ্জা। কারণ এমন কোনো উদ্যোগ রাজশাহীর কেউ নিতে পারেনি আজ পর্যন্ত।
প্রত্যেকে একই সুরে বলেন, এনসিএল, বিপিএল, জাতীয় লীগ খেলে যা পাই; তাতে আমাদের প্রিমিয়ারের টাকা কতো দিলো সেটা নিয়ে ভাবি না। কিন্তু লোকাল প্লেয়াররা কোথায় টাকা পাবে যদি খেলা না হয়? সারাবছর মাঠে থেকে অনুশীলন করতে করতে বিরক্ত হয়ে সবাই চলে যাচ্ছে। চোখের সামনে কয়েকজন খেলা ছেড়ে দিয়েছে।
ক্ষোভের সাথে একজন বলেন, আগে দশ টিমের প্রত্যেকে একে অপরের সাথে খেলার সুযোগ পেতো। এখন দুই গ্রুপ করে খেলা হওয়ায় চারটা করে ম্যাচ খেলার সুযোগ পাচ্ছে। অভিজ্ঞ প্লেয়ারদের দিয়ে টিম চ্যাম্পিয়ন করার চেষ্টায় নতুনদের সুযোগ দিতে চায় না টিম ম্যানেজমেন্ট। ফলে এক থেকে দুই ম্যাচ খেলেই ওই বছরের জন্য ইতি টানতে হয় নতুনদের। এভাবে প্লেয়ার উপরে উঠবে কিভাবে প্রশ্ন রেখেছেন রাজশাহী জেলা ও প্রিমিয়ারের দায়িত্বরত ব্যক্তিদের উপরে।
এ বিষয়ে রাজশাহী প্রিমিয়ার ক্রিকেট লীগের অন্যতম সংগঠক নাম প্রকাশ না করে জানান, আমি টিম করি প্রায় পাঁচ লাখ টাকা খরচ করে চ্যাম্পিয়ন করার টার্গেটে। প্রতিবার চারটা টিমের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার প্রতিযোগিতা হয়। প্রতিযোগিতায় অন্যরা আসতে পারেনা। অথচ উচিত ছিলো চ্যাম্পিয়ন করার লক্ষ্যে ১০টি দল গঠন করা। জেলা ক্রীড়া যে টাকা অনুদান দেয় তাতে হয়না। বাড়তি টাকার জন্য আমরা ডোনার খুঁজে বেড়ায়। এখন আগের মতো স্পন্সর খুঁজে পাওয়া যায় না। সবাইতো নিজের পকেট থেকে টাকা দিয়ে দল করার আগ্রহ দেখাবে না। তাছাড়া আমি যে টাকা দেই; অন্যান্য দলের কর্মকর্তারা এটা নিয়ে আগেরবার আমার সাথে একরকম ঝগড়া শুরু করে দিয়েছিলো। এখানে বড় বড় স্পন্সর থাকলে আমার দলের খেলোয়াড়দের আরো টাকা দিতাম। এখন সবাই জেলা ক্রীড়ার সদস্যসহ ঢাকার সদস্য হতে তদবির করে, টাকা খরচ করে নিজের পদের জন্য। কিন্তু দল ভালো করতে টাকা খরচ করতে চায় না। এটা খুব খারাপ বিষয়।
প্রিমিয়ার খেলা শুরুর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ফেব্রুয়ারির দিকে একটা সম্ভাবনা আছে। ঢাকা থেকে সবুজ সংকেত পেলেই আমরা মাঠে নামতে পারবো। অন্যান্য খেলার চেয়ে ক্রিকেটের প্রতি ম্যাচের খরচ অনেক বেশি হওয়ায় চাইলেও আমরা মাঠে নামতে পারছিনা।
রেলিগেশন বিষয়ে তিনি জানান, এক বছর প্রিমিয়ার লীগে খেলা না হওয়ায় প্রথম বিভাগ থেকে দুটি দল প্রিমিয়ারে উঠে যায়। এরপর সেই জটিলতা দূর করতে প্রথম বিভাগ এক বছর বন্ধ রাখা হয়। এবার খেলা হলে রেলিগেশন চালু করা হবে।
ক্রিকেট ছাড়ছেন ক্রিকেটাররা
নভেম্বর ২৭
০৬:০৫
২০২০