
স্টাফ রিপোর্টার: পাতকুয়ার সুফল পাচ্ছে রাজশাহীর পবার চর মাঝারদিয়াড়। গৃহস্থালির কাজ থেকে শুরু করে জমিতে সেচ দিচ্ছেন এই পাতকুয়া থেকে। সেচের জন্য ভাবনাহীনভাবেই চাষাবাদ করছেন চরাঞ্চলের চাষিরা। বিশেষ করে সবজি চাষে সেচকাজে পাতকুয়ার পানি আশীর্বাদ।
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের কৃষি হুমকির মুখে পড়েছে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে চরাঞ্চল ও বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষিতে। সেজন্য ভূ-উপরিস্থ পানি ও পাতকুয়ার মতো পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষিতে নতুন আলোর সন্ধানে উদ্যোগি হয়েছে বরেন্দ্র বহুমূখি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ।
হাতকল আসার আগে বরেন্দ্র অঞ্চলসহ রাজশাহীর গ্রামে সুপেয় পানির নির্ভরযোগ্য আধার ছিল পাতকুয়া। বরেন্দ্র এলাকায় হাত, সাবমার্সিবল পাম্প, গভীর ও অগভীর নলকূপ আসার পর পাতকুয়া হারিয়ে যায়। নতুন প্রজন্মের অনেকে পাতকুয়া দেখেইনি। তবে জলবায়ু ও সময় পরিবর্তন এবং প্রকৃতির বিরূপ প্রভাবে ও ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমাতে পাতকুয়ার প্রয়োজন অনুভব করছেন বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) প্রকৌশলীরা। আগে বালতি ও রশি দিয়ে পানি উত্তোলন হতো শুধু পানের ও গৃহস্থালীর কাজে। এখন সৌর প্যানেলে যান্ত্রিকভাবে সেচকাজে ব্যবহার হচ্ছে এই পাতকুয়ার পানি।
বর্তমানে বরেন্দ্র অঞ্চলে ও পদ্মার চরে চাষাবাদ করা কঠিন। তাই সেচ সুবিধা নিশ্চিত করতে কর্মসূচি গ্রহণ করেছে সরকার। যার মধ্যে পাতকুয়া একটি। এরই ধারাবাহিকতায় বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ রাজশাহীর পবা উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের চর মাঝারদিয়াড়ে পাতকুয়া ও সোলার প্যানেল স্থাপন করেছে। ফলে জলাবদ্ধতা নিরসন ও পানির প্রাপ্যতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় এখানে পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত হয়েছে। পাতকুয়া ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের নিচ পর্যন্ত গোলাকার আকৃতিতে মাটি খনন করে চারপাশ থেকে চুয়ানো পানি ধরে রাখার আধার। আর পাতকুয়া থেকে এই চুয়ানো পানি সৌর প্যানেলের সৌর শক্তিকে ব্যবহার করে যন্ত্রের মাধ্যমে সেই পানি যাচ্ছে ঘর-গৃহস্থালী ও সেচকাজে।
এই সেচ সুবিধায় আওতায় জমিতে চাষ হচ্ছে আলু, টমেটো, রসুন, পিঁয়াজ, বরবটি, মুলা, কপি, লাউ, শিম, বেগুন, শিম, গম, সরিষাসহ সব ধরণের সবজি ও রবি শস্য।
রসুন ক্ষেতে নিরানি (আগাছা পরিস্কার) দিচ্ছেন চরের কৃষক সোহেল রানা চান্দু। তিনি বলেন, পাতকুয়া থেকে পানি নিয়ে সব ধরণের সবজি করছে চাষিরা। সেচ সুবিধা পাওয়ায় জমি আর কেউ ফেলে রাখে না। ফলনও ভাল হয়। সেচ দিয়ে চাষাবাদ করায় চাষিরা লাভবান হচ্ছে। অনেকেই স্বাবলম্বি হচ্ছে।
তিনি আরো জানান, পাতকুয়ার আওতায় প্রতি ৫০ হাত পর পর ট্যাপ বসানো আছে। সেখান থেকে রাবার পাইপ দিয়ে চাষিরা ইচ্ছামত পানি নিয়ে সেচ কাজ চালায়। এমনকি চরের ছোট ছোট পুকুরেও এই সরবরাহ হয়।
হরিপুর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান বজলে রেজবি আল হাসান মুঞ্জিল বলেন, পাতকুয়ার আওতায় জমিতে শতভাগ সবজি আবাদ হচ্ছে। চাষিদের জীবন যাত্রার মানও বেড়েছে। চরাঞ্চলে রাস্তার বেহাল দশা। তিন-চার কিলোমিটার পাকা রাস্তা হলে এরাও নগর জীবন-যাপন করতে পারবে।
বিএমডিএর প্রকল্প পরিচালক নজরুল ইসলাম জানান, রাজশাহীর পবা উপজেলার চর মাঝারদিয়াড়ে সেচ কাজে পানির নিশ্চয়তায় এলএলপি (নদী থেকে পানি উঠানো) দুইটি এবং চারটি স্থানে সোলার প্যানেলের মাধ্যমে পাতকুয়া থেকে পানি উত্তোলন করা হচ্ছে। প্রতিটি সোলার প্যানেল ও পাতকুয়ায় ব্যয় হয় ১৩ লাখ টাকা। এতে পানির লাইন আছে এক একটিতে ৩৬০ মিটার ভূগর্ভস্থ পর্যন্ত।
পবা বিএমডিএর সহকারি প্রকৌশলী এসএম দেলোয়ার হোসেন জানান, পাতকুয়াটি চরাঞ্চলে বসানোর ফলে সুফল পাচ্ছেন এলাকার মানুষ। এই পানি ব্যবহার করছে সাত থেকে আট হাজার মানুষ। ফলে স্বল্প খরচে পদ্মার চরে কৃষির সেচ কাজে পানির নিশ্চয়তা ও খাদ্য এবং সবুজায়ন সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছে। পাককুয়া ব্যবহারের সুফল অনেক। এটি ব্যবহারে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমায় কারণ এ অঞ্চলে যত বেশি গভীর নলকূপের ব্যবহার কমানো যায় ততই মঙ্গল। এছাড়া খরার সময় খরাপ্রবণ এলাকায় স্বল্প সেচের ফসল উৎপাদন ধরে রাখা যায়। বিশেষ করে আগাম শিম, লাউ, চালকুমড়া, মিষ্টিকুমড়া, বেগুন, পেঁপে, বাঁধাকপি, ফুলকপি, টমেটো, আলু, করলা, শসা এসবের আবাদের জন্য।
এছাড়া ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার রোধ করে জলবায়ু পারিবর্তনজনিত বিরূপ প্রভাব রোধ করা সম্ভব। আর বেশি বৃষ্টির সময় বৃষ্টির পানি ভূগর্ভে প্রবেশ করানোর মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি করানো এবং সংরক্ষণ করা যায়। পাতকুয়া ব্যবহারে আর্সেনিকমুক্ত বিশুদ্ধ খাবার পানি ব্যবহার করা সম্ভব। আর এর সাথে স্থানীয় জনসাধারণের জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন করানো সম্ভব। যেহেতু পাতকুয়ার পানি উত্তোলন কাজে বিদ্যুৎ শক্তির পরিবর্তে সৌরশক্তি ব্যবহার হয় সেহেতু এটি পরিবেশবান্ধব এবং নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারে সহায়ক।