এনায়েত করিম : সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম আব্দুস সোবহান ও তাঁর নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের বিরুদ্ধে ’অনিয়ম ও দুর্নীতি’র অভিযোগ তদন্ত করে প্রতিবেদন দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) গঠিত তদন্ত কমিটি। ওই প্রতিবেদনে ২৫টি অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। একইসঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে কিছু সুপারিশও। এনিয়ে রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়সহ সারা দেশে শুরু হয় ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। এর প্রেক্ষিতে সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ, বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন, জ্যেষ্ঠ শিক্ষক ও সংশ্লিষ্ট মহলের দেয়া বক্তব্য ও তথ্যপ্রমাণে ইউজিসি’র ওই তদন্ত প্রতিবদনের ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে, যার অধিকাংশই সরেজমিন প্রতিবেদনের প্রথম পর্বে উঠে এসেছে। বাকি অভিযোগগুলোর মধ্যে ’বাড়ি দখলে রাখা’র বিষয়টি অন্যতম। ইউজিসির তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন ও সুপারিশের প্রেক্ষিতে দুই পর্বের সরেজমিন প্রতিবেদনের দ্বিতীয় তথা শেষ পর্বে আজ বৃহস্পতিবার এই বিষয়টিসহ বাকিগুলো উঠে আসবে।
বাড়ি ‘দখলে রাখা’র অভিযোগ: রাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম আব্দুস সোবহান ও তাঁর নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের বিরুদ্ধে ইউজিসির গঠিত তদন্ত কমিটি যে ২৫টি অনিয়ম-দুর্নীতির কথা বলেছে তার মধ্যে ১২ নম্বরে রয়েছে ’উপাচার্যের বাড়ি ভাড়া নিয়ে দুর্নীতি’। এই অভিযোগের ব্যাখ্যায় উপাচার্য নানা অজুহাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি ১৮ মাস ধরে নিজের দখলে রাখেন বলে উল্লেখ করা হয়। একইসঙ্গে উপাচার্যসহ সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে বাড়ি ভাড়া বাবদ ৫ লাখ ৬১ হাজার ৬০০ টাকা আদায়ের সুপারিশও করা হয় তদন্ত প্রতিবেদনে।
এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল ও হিসাব দপ্তরসহ সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে ও ফাইল ঘেটে জানা যায়, অধ্যাপক ড. এম আব্দুস সোবহান দ্বিতীয় মেয়াদে রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান ২০১৭ সালের ৭ মে। কিন্তু তিনি উপাচার্য বাস ভবনে উঠেন ওই বছরেরই ২৬ জুন। নিয়োগ পাওয়ার পর দেড় মাসেরও বেশি সময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ একজন অধ্যাপক হিসেবে আগেই যে বাড়িটি বরাদ্দ পেয়েছিলেন, সেখানেই বসবাস করছিলেন। তবে উপাচার্যের বাসভবনে উঠার দিনই (২৬ জুন ২০১৭) ওই বাড়িটি ছেড়ে দেনর্ অধ্যাপক ড. এম আব্দুস সোবহান। প/২৮ নম্বর বাড়িটি ছেড়ে দেওয়া ও উপাচার্য বাস ভবনে উঠা সংক্রান্ত চিঠি এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। তাতে দেখা যায়, বিশ^বিদ্যালয়ের হিসাব পরিচালক বরাবর পাঠানো প্রধান প্রকৌশলী স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ’উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুস সোবহানের নামে বরাদ্দকৃত প/২৮ নং বাসার দখল তিনি গত ২৬/০৬/২০১৭ তারিখে ছেড়ে দিয়েছেন এবং উক্ত ২৬/০৬/২০১৭ তারিখ হতে উপাচার্য বাস ভবনে বসবাস করছেন।’
অবগতি ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ওই বছরের (২০১৭ সাল) ৩ আগস্ট চিঠিটির অনুলিপি বিভিন্ন দপ্তরে পাঠানো হয়।
এছাড়া ২০১৭ সালের ৩১ জুলাই উপাচার্য দপ্তরের সচিব মীর শাহ্জাহান আলী স্বাক্ষরিত প্রধান প্রকৌশলী বরাবর পাঠানো অপর একটি চিঠিতে বলা হয়, ’মাননীয় উপাচার্যের নামে বরাদ্দকৃত প/২৮ বাসাটি গত ২৬/০৬/২০১৭ তারিখে ছেড়ে দিয়ে তিনি উপাচার্য ভবনে অবস্থান করছেন। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আদিষ্ট হয়ে অনুরোধ করছি।’ পত্রগুলো গ্রহণ করারও প্রমাণ রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের প্রকল্প বাস্তবায়নে অনীহা, বাধা ও অবমাননার অভিযোগ : রাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম আব্দুস সোবহান ও তাঁর নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের বিরুদ্ধে ইউজিসি গঠিত তদন্ত কমিটির প্রমাণ করা ২৫টি অভিযোগের মধ্যে ২১ নম্বরে রয়েছে, ’মুক্তিযুদ্ধের প্রকল্প বাস্তবায়নে অনীহা, বাধা এবং অবমাননা।’ এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ, বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক-বর্তমান শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সংশ্লিষ্ট অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১/১১ তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের (নিবন্ধিত) নির্বাচিত আহ্বায়ক হিসেবে অধ্যাপক ড. এম আব্দুস সোবহান আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুক্তির আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে রিমান্ডসহ ১০৪ দিন কারাভোগ করেন। এছাড়া ২০০৯ সালে প্রথমবারের মতো রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব নিয়েই নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, শিক্ষা, গবেষণা, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ক্যাম্পাসকে প্রাণবন্ত করে তুলেন। এতে তার সময় রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় নানা ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্বের স্বাক্ষরও রাখতে শুরু করে।
আবার ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্রথম মেয়াদে দায়িত্ব পালনকালে উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুস সোবহানের নেতৃত্বে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে বঙ্গবন্ধুর একটি নান্দনিক ম্যূরাল, শহীদ ড. শামসুজ্জোহা হলে তার অবক্ষ ভাস্কর্য সম্বালিত স্মৃতিফলক ’স্ফুলিঙ্গ’, শহীদ ড. হবিবুর রহমান হলে তার অবক্ষ ভাস্কর্য সম্ভলিত স্মৃতিফলক কলম, শহীদ অধ্যাপক মীর আব্দুল কাইয়ুম-এর নামে ৪তলা বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক ডরমিটরি নির্মাণ করা হয়। এছাড়া বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা (৬তলা) বিশিষ্ট ছাত্রী হলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন ও নির্মাণ কাজ শুরু এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ’বঙ্গবন্ধু কমপ্লেক্স’ ও প্রধানমন্ত্রীর নামে ’জননেত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রী হল’-এর স্থান নির্ধারণ করে সিন্ডিকেটে অনুমোদন করেন উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুস সোবহান।
একইসঙ্গে অসমাপ্ত শহীদ হবিবুর রহমান হলের নির্মাণ কাজ ও অসমাপ্ত চারুকলা একাডেমিক ভবনের নির্মাণ কাজও প্রথম মেয়াদেই সম্পন্ন করেন তিনি।
এদিকে, ২০১৭ সালের ৭ মে বিশ^বিদ্যালয়ের ইতিহাসে রেকর্ড গড়ে দ্বিতীয় মেয়াদে আবারও উপাচার্যের দায়িত্ব পান অধ্যাপক ড. এম আব্দুস সোবহান। প্রথম মেয়াদে উপাচার্য হিসেবে সততা, একাগ্রতা, দক্ষতা ও নিষ্ঠার পরিচয় দেয়ায় তার উপর আবারও আস্থা রাখে সরকার। সেই আস্থাকে সম্মান দেখিয়ে ও প্রথম মেয়াদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বিশ^বিদ্যালয়কে ঢেলে সাজাতে শুরু করেন উপাচার্য। এতে বিশ^বিদ্যালয়ের ইতিহাস ও ঐতিহ্য যেমন ফুটে উঠে তেমনি ক্যাম্পাসের সৌন্দর্যও বৃদ্ধি পায় বহুগুণে। এছাড়া নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি তরুণ প্রজন্মের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতেও বিভিন্ন পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করেছেন উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুস সোবহান। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে-বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা হলের অসমাপ্ত কাজের সমাপ্তকরণ; চারতলা বিশিষ্ট সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী ভবনের অসমাপ্ত ৫০ শতাংশ নির্মাণ কাজ সমাপ্তকরণ; চারতলা বিশিষ্ট কৃষি অনুষদ ভবনের অসমাপ্ত ৫০ শতাংশ নির্মাণ কাজ সমাপ্তকরণ; রবীন্দ্র ভবনের ৩টি ব্লকের মধ্যে দুইটি ব্লকের ৫ম তলা নির্মাণ, জাতীয় তিন নেতার স্মরণে বিভিন্ন ভবনের নামকরণ-(ক) শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রশাসন ভবন (পূর্বের নাম প্রশাসন ভবন-১), (খ) শহীদ তাজউদ্দিন আহমদ সিনেট ভবন (পূর্বের নাম সিনেট ভবন), (গ) শহীদ ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী প্রশাসন ভবন (পূর্বের নাম প্রশাসন ভবন-২); এছাড়া শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামানের নামে ছাত্রদের জন্য দশ তলা বিশিষ্ট হলের নির্মাণ কাজ চলছে (হলটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে রাষ্ট্রপতি)।
এছাড়া বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নামে বিভিন্ন ভবন ও স্থাপনার নামকরণও করেন উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুস সোবহান ও তার নেতৃত্বাধীন প্রশাসন।
নিয়োগের আগেই অনিয়ম প্রমাণ ইউজিসির : ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল সায়েন্সের শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম প্রমাণিত হয়েছে বলে ইউজিসি কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ১০ নম্বরে উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ ওই সেখানে এখনও পর্যন্ত কোনো নিয়োগই হয়নি বলে সরেজমিনে তথ্য পাওয়া গেছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুস সোবহান বলেন, উপাচার্য পদে আসীন হওয়ার স্বপ্নে বিভোর কয়েকজন বিপথগামী শিক্ষক মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযোগ করে নোংরামি করছে। বাড়ি দখলে রাখার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ’বিষয়টি সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর। যখন উপাচার্যের বাসভবনে উঠেছি, তখনই ওই বাড়িটি ছেড়ে দিয়েছি। অথচ ষড়যন্ত্রকারীরা মিথ্যা অভিযোগ করেছে, যেটা পুরোপুরি মিথ্যা ও ভিত্তিহীন এবং উদ্দেশ্যেপ্রণোদিত। এ নিয়ে অভিযোগকারীদের দেয়া ভুল তথ্যই ইউজিসি তুলে ধরেছে। যেটা তদন্ত পক্ষপাতের অন্যতম দৃষ্টান্ত।’
শেষ পর্ব : রাবি ভিসির বিরুদ্ধে বাড়ি দখলে রাখার অভিযোগ ও সরেজমিন
নভেম্বর ২৬
০৫:০৬
২০২০