ই-পেপার

মৌসুমের শুরুতেই শুকিয়ে গেছে পদ্মা

সাইফুল ইসলাম, গোদাগাড়ী: ভারত আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে গঙ্গাসহ অভিন্ন নদী গুলোর পানি একতরফাভাবে সরিয়ে নিচ্ছে। ফলে নদীতে পানি প্রবাহ কমে গিয়ে গতিপথ পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে।
ফলে জল রাশির অপর সৌন্দর্য হারিয়ে পদ্মা এখন ধুধু মরুভূমি। শুষ্ক মৌসমের শুরুতেই শুকিয়ে এমন পরিণতি হয়েছে একসময়ের খরশ্রোতা এই নদীটি। তাই বেড়েছে চরের বিস্তৃতি। যতদূর চোখ যায় করে শুধু বালুরাশি। পদ্মার প্রবেশদ্বার রাজশাহী গোদাগাড়ী উপজেলার এমন অবস্থা বিরাজ করছে। পানি সংকটের কারনে ফারাক্কার প্রবেশদ্বারে আরো তিন নদীর অস্তিত্ব এখন প্রায় বিলীন।
পদ্মার এই করুণ পরিনতিতে শুকিয়ে গেছে বরেন্দ্র অঞ্চলের খাল বিল নদী নালা। একই সঙ্গে দ্রুত নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। পদ্মা পানি শুন্য হওয়ার পাশাপাশি ও ভূগর্ভের পানির স্তরও নামেছে নিচে। ঠিকমতো পানি মিলছে না গভীর নলকূপে। দেখা দিয়েছে সেচ পানীয় জলের সংকট। এ অবস্থায় পদ্মা নদী ডেজিং করে পদ্মায় পানি প্রবাহ নিশ্চিত করার দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহলে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, স্রোত না থাকায় প্রতিবছর লাখ লাখ টন পলি এসে জমেছে পদ্মার বুকে। বাড়ছে বালুচরের বিস্তৃৃতি আর ঘনত্ব। গত ৪৮ বছরে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে বালুচরের উচ্চতা বেড়েছে ২০ মিটার। বর্ষা মৌসুমে মাস তিনেকের জন্য নদীতে পানি থাকলেও বছরের নয় মাস জুড়ে তলানিতে থাকছে পানি। ফলে পদ্মা মরে যাবার সাথে সাথে এর শাখা-প্রশাখা নদ-নদীগুলোর অস্তিত্বও প্রায় বিলীন।
শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গা নদীর পানির ভাগাভাগির লক্ষ্য ১৯৯৬ সালে ভারত সরকারের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদী পানি চুক্তি করে বাংলাদেশ। চুক্তিতে ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ শে মে পর্যন্ত সময়কে অবহিত করে প্রতিটি মাসকে তিনচক্রে ভাগ করা হয়েছে। কোন চক্র কি পরিমান পানি পাবে তা চুক্তি উল্লেখ করেছে। চুক্তির নামে প্রতারণা করে ঠিকমতো পানি বন্টন হচ্ছে কি-না তা দেখার জন্য বিগত সরকারের আমলে যৌথ নদী কমিশনের সদস্যরা প্রতিবছর নামে মাত্র বাংলাদেশ-ভারত সফর করেন। চুক্তি মোতাবেক শুকনো মৌসুম শুরু হবার পর হঠাৎ করে যৌথ নদী কমিশন শোরগোল তুলে জানান দেয়, পদ্মায় বিগত বছরগুলোর তুলনায় প্রচুর পানি এসেছে। কিন্তু বাস্তবে গিয়ে পদ্মা সে পানি দেখা যায়নি। পানিহীন পদ্মা নদীতে দেখা গেছে শুধু বালুচর।
রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছেন, গত কয়েক বছর থেকে পদ্মায় পানির গভীরতা ১৩ থেকে ১৪ মিটারে উঠানামা করে। পরিবেশবিদরা বলছেন, ঠিকমতো পানি পাওয়া গেলে পদ্মার এমন করুণ দশা হতো না। পানি না পাওয়ার কারণে এখন বর্ষার সময় কিছু পানি থাকলেও সারা বছর থাকে শুকনো। নদীতে নৌকা নয়, চলে চাষাবাদ, ফুটবল খেলা।
এ অবস্থায় বর্তমানে বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর পড়ে যাচ্ছে ১০০ ফুট নিচে অবস্থান করছে। দিন দিন তা আরো নিচের দিকেই যাচ্ছে। তাই এ অঞ্চলের হাজার হাজার গভীর ও গভীর নলকূপ অকেজে হয়ে পড়ছে। ভূগর্ভের পানের নিচে চলে যাওয়ায় পানি সংকট দেখা দিচ্ছে কৃষিকাজেও। চাষাবাদে বাড়ছে খরচ।
এদিকে বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সূত্রে জানা যায়, চলিত মৌসুমে বরেন্দ্র অঞ্চলের ৮ টি উপজেলার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নামছে আশঙ্ক জনক হারে। এতে আগামীতে বোরো ধান উৎপাদনে অনিশ্চয়তার শঙ্কা করেছে বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। এই অবস্থায় বরেন্দ্র অঞ্চলের আটটি উপজেলায় ইরি ধান চাষে নিরুৎসাহিত করছে বিএমডিএ কর্তৃপক্ষ।
নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, ভারত আন্তর্জাতিক নিয়মের তোয়াক্কা না করে উৎস্য উজানে গঙ্গার উপর অসংখ্য প্রকল্প নির্মাণ করে পানি সরিয়ে নিচ্ছে। যার ফলে ফারাক্কা পয়েন্টে যথেষ্ট পানি পৌছতে পারছে না। এসব প্রাণঘাতী প্রকল্প অপসারণ করা ছাড়া গঙ্গা পদ্মায় স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনার অন্য কোন বিকল্প নেই।
রাজশাহীর পদ্মা নদী বাঁচাও আন্দোলনের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট এনামুল হক বলেন, ভারত আন্তর্জাতিক আইন রীতিনীতি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন করে গঙ্গাসহ অভিন্ন নদী গুলোর পানি এক তরফা ভাবে সরিয়ে নিচ্ছে। এতে নদীতে পানি প্রবাহ কমে গিয়ে গতিপথ পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব ও খনি বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর চৌধুরী সারোয়ার জাহান বলেন, পানির প্রবাহ ঠিক থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ। পানি প্রবাহ ঠিক না থাকলে নদীর দুইপাশে ভাঙ্গল চলতে থাকবে। আর আমরা প্রতিনিয়ত দুরবস্থার সম্মুখীন হব। এজন্য পানি প্রবাহ বাড়াতে হবে।
রাজশাহী কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর জহুরুল ইসলাম বলেন, এমনিতেই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সম্প্রীতিক সময়ে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমেছে। আবার পর্দায় পানি প্রবাহ ঠিকমতো না থাকায় ভূ-গর্ভস্থ উপর চাপও পড়েছে। ফলে পানির লেবেল নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। এতে ভূ-পৃষ্ঠের উষ্ণতা বেড়ে যাচ্ছে। এভাবে যদি ভূ-পৃষ্ঠের উষ্ণতা বাড়তেই থাকে তাহলে একসময় মরুকরণের ধাবিত হতে পারে এই অঞ্চল। তাই এখানেই পদ্মার পানির প্রবাহ নিশ্চিতের কোন বিকল্প নেই।


প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৯, ২০২৫ | সময়: ৬:৩০ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ