মঙ্গলবার, ১৮ই মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৪ঠা চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ।
নুরুজ্জামান, বাঘা ও তছলিম উদ্দীন, সাপাহার: আম প্রধান এলাকা রাজশাহীর বাঘা উপজেলা ও নওগাঁর সাাপাহার উপজেলায় বিভিন্ন বাগানে এখন মুকুলের মৌ-মৌ গন্ধ। যে কারো প্রাণ জুড়িয়ে যাবে। কোন কোন গাছ থেকে ক্ষুদ্র আকারে মুকুল বের হচ্ছে, আবার কোন-কোন গাছে পরিপুর্ণ মুকুল এসে গেছে। ফলে বাগান পরিচর্যায় এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন বাগান মালিক ও ব্যবসায়ীরা। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে আমের ভালো ফলনের আশা করছেন স্থানীয় কৃষি বিভাগ। তাদের দেয়া তথ্য মতে, গত কয়েক বছর থেকে বাঘার আম বিদেশে রপ্তানী হচ্ছে।
রাস্তার দুই ধারে সারি সারি আম বাগান আর সুস্বাদু-বাহারি জাতের আমের কথা উঠলেই চলে আসে রাজশাহী অঞ্চলের নাম।
রাজশাহী জেলাকে আমের জন্য বিখ্যাত বলা হলেও মূলত আম প্রধান অঞ্চল হিসাবে খ্যাত জেলার বাঘা-চারঘাট ও পুঠিয়া উপজেলা।
এ অঞ্চলের কৃষকরা জানান, গত বছর অধিকাংশ বাগানে ভালো আম হয়নি। ফলে এ বছর সকল বাগানে পরিপূর্ণ মুকুল বের হচ্ছে। আম চাষীদের মতে, এখন পর্যন্ত আবহাওয়ার যে অবস্থা তাতে বিগত বছরের তুলনায় এবার আমের মুকুল ভাল হবে।
বাঘার (বয়স্ক) মুরব্বি লোকজন জানান, এ উপজেলায় প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন ৫০০ বছরের পুরোনো ঐতিহাসিক বাঘা শাহী মসজিদ। এই মসজিদের শিলা লিপিতে আমের ছবি ঐতিহ্য বহন করছে। ১৫২৩-২৪ খিস্টাব্দে (হিজরি-৯৩০) হোসেন শাহ্ এর পূত্র নুসরাত শাহ শাহী মসজিদ নির্মাণ করেন। এই শাহী মসজিদে চুন-সুড়কি দিয়ে গাথা পোড়া ইটের শিলালিপিতেও আমের টেরাকোটা অংকিত আছে। যা থেকে প্রমানিত হয় বাঘার আমের সুখ্যাতি প্রাচীন আমল থেকে স্বীকৃত।
তাঁরা আরো বলেন, এই মুহুর্তে গাছে গাছে ফুটছে আমের মুকুল। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে এই মুকুলের পাগল করা ঘ্রাণ। বাতাসে মিশে সৃষ্টি করছে মৌ-মৌ গন্ধ। যে গন্ধ মানুষের মনকে বিমোহিত করছে। পাশাপাশি মধুমাসের আগমনী বার্তাও জানান দিচ্ছে আম্র কাননের।
উপজেলা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী জেলার ৯টি উপজেলার মধ্যে ৮ টিতে যে পরিমান আম বাগান রয়েছে। তার সম-পরিমান বাগান রয়েছে কেবল বাঘা উপজেলায়। এখানকার প্রধান অর্থকারী ফসল আম।
শুধু তাই নয়, বাঘার আমের খ্যাতি সারা দেশ জুড়ে। ঢাকার বাজারে অন্য যে কোন জেলা-উপজেলার চেয়ে বাঘার আমের দাম সব সময় বেশি। গত ৭-৮ বছর থেকে এখান কার আম রপ্তানী হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। আমকে ঘিরে প্রতি মৌসুমে বাঘা এলাকায় অন্তত ২৫টি ছোট-বড় আমের বাজার (হাট) বসে। এর মধ্যে বড় বাজার বসে বাঘা সদর, মনিগ্রাম, বিনোদপুর, বাউসা, আড়ানী, পাকুড়িয়া ও পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বরে। সেই হাটে পাশ্ববর্তী চারঘাট থেকেও আম যায়।
স্থানীয় লোকজন জানান, এ বছর আম পাড়ার পুর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত যদি আবহাওয়া ভাল থাকে এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্ত থাকে তাহলে এবার যে হারে গাছে মুকুল আসতে শুরু করেছে তাতে করে আম বিক্রি হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
এ অঞ্চলের আমের মধ্যে-ফজলি, খিরশাপাত, গোপাল ভোগ, ল্যাংড়ার, আড়াজম, আম্রপালি ও আশ্বিনা আমের নাম শোনা যায় সবার মুখে-মুখে।
এ ছাড়াও বৌ-ভুলানী, রানীপছন্দ, জামাইখুসি, বৃন্দাবন, লকনা, বোম্বাই খিরসা, মহনভোগ, সেনরি, ব্যানানা, ক্ষুদি খিরসা, বৃন্দাবনী ও কালীভোগ সহ প্রায় দেড়’শ জাতের আম রয়েছে। প্রতিবছর আম মৌসুমে এ উপজেলায় প্রায় লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হয়।
এ অঞ্চলের আম বাগান মালিকরা জানান, প্রতি বছর মাঘের শুরুতে আম গাছের ডালে ডালে মুকুল ফুটতে শুরু করে। এ দিক থেকে বাগান মালিক ও ব্যবসায়ীরা মুকুলের পরিচর্যা শুরু করেছেন।
তাদের মতে, এবার পরিপূর্ণ মুকুল ফুটে গুটি বের হতে ফালগুন চলে আসবে। এখানে আঞ্চলিক ভাবে প্রবাদ রয়েছে, ‘আমের আনা মাছের পাই, টিকলে পরে কে কত খাই।’ আম চাষীদের মতে, গাছে-গাছে যে পরিমাণ মুকুল আসে, তার সিকিভাগ (২৫%) টিকে গেলেও আমের বাম্পার ফলন হবে।
উপজেলার আমোদপুর গ্রামের সফল আম চাষি শামসুল হক জানান, গাছে মুকুল আসার পর থেকে আম পাড়া পর্যন্ত ৫ থেকে ৬ বার কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয়। তাতে হেক্টরে ৩৮ থেকে ৪৫ হাজার টাকার বালাইনাশক লাগে।
বাঘা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিউল্লাহ্ সুলতান বলেন, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আম চাষ করলে এর উৎপাদন যেমন বাড়বে, তেমনি সঠিক ভাবে সংরক্ষণ এবং পরিবহন, রপ্তানি-সহ বাজারজাত করলে কৃষকরা ব্যপক হারে লাভবান হবেন। তিনি উন্নত পদ্ধতিতে আম চাষ ও রক্ষনা-বেক্ষণের জন্য কৃষকদের নানা পরামর্শ দেয়ার ফলে গত ৭-৮ বছর থেকে বাঘার আম বিদেশে রপ্তানী হচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিভিন্ন জাতের আম চাষে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে নওগাঁর বরেন্দ্র অঞ্চল সাপাহার। দিন দিন এই অঞ্চলের আমের উৎপাদন বেড়েই চলেছে। চলতি মৌসুমে নওগাঁর সাপাহার উপজেলায় গাছে গাছে সবুজ পাতার ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে কৃষকের স্বপ্নের সোনালী আমের মুকুল। আমের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে মুকুল পরিচর্যায় ব্যস্ততা বেড়েছে এই অঞ্চলের আম চাষে সম্পৃক্ত সকল আমচাষীদের।
দেশের মোট উৎপাদিত আমের ৬০ শতাংশ আম এই জেলায় উৎপাদিত হয়ে থাকে। উৎপাদিত আম দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশ ও রপ্তানি হয়ে থাকে সুনামের সাথে। আমের মিষ্টতার সাধ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এগিয়ে থাকায় আমের রাজধানী হিসেবে সুপরিচিত এই অঞ্চল।
সরেজমিনে, সাপাহার সদর ইউনিয়ন সহ তিলনা ,শিরন্টি ইউনিয়নের বেশ কিছু এলাকার আম বাগান ঘুরে দেখা গেছে ইতোমধ্যেই অধিকাংশ গাছে উঁকি দিতে শুরু করেছে আমের মুকুল। কিছু কিছু বাসা বাড়ির গাছেও দেখা গেছে আমের মুকুল। আম আমাদের দেশে মৌসুমি অর্থকরী ফল হিসেবে গুরুত্ব পেলেও বর্তমানে এটি শিল্পজাত পণ্য হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। প্রাকৃতিক ও ভৌগলিক অব¯’ান এবং আম চাষের উপযোগী আবহাওয়ার কারণে এই অঞ্চলে বেড়েছে আমের উৎপাদন, এতে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও আম রপ্তানি হ”েছ।
সাপাহার সদর ইউনিয়নের আমচাষি আশরাফুল হক জানান এবছর ১৫০ বিঘা জমিতে বিভিন্ন জাতের আম চাষ করছেন তিনি, অধিকাংশ বাগানে আমের মুকুল দেখা দিয়েছে মুকুল পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় কাটা”েছন তিনি। শেষ পর্যন্ত আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে ভালো উৎপাদনের আশাও করছেন তিনি।
উপজেলার পিছল ডাঙ্গা গ্রামের আমচাষি মমিনুল হক বলেন এবার শীতের তীব্রতা কম থাকায় বাগানে ইতোমধ্যেই মুকুল দেখা দিয়েছে এবং তুলনামূলক ভাবে কিটনাশক কম ব্যবহার হচ্ছে।
সাপাহার উপজেলাল কৃষিদপ্তরের অতিরিক্ত কৃষি অফিসার কৃষিবিদ মনিরুজ্জামান টকি বলেন, চলতি বছর উপজেলায় ৯হাজার ২শত ৮০ হেক্টর জমিতে আম চাষ হচ্ছে, এখন আমের মুকুল শুরুর সময় প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি ইমিডাক্লোপ্রিড এবং ২গ্রাম কার্বেনডাজিম ছত্রাকনাশক প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করা যেতে পারে ।
সকল বাগান ও আমগাছে সম্পুর্ন মুকুল আসতে আরোও ১৫-২০ সময় লাগতে পারে বলে কৃষিবিদ ও আমচাষীরা জানিয়েছেন। ফুল ফোটার সময় মেঘলা ও কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়া থাকলে পুষ্প মুঞ্জনিরতে পাউডারি মিলডিউ অ্যানত্রাকনোজ রোগের আক্রমণ হতে পারে। এতে গাছের পাতা মুকুল ও কচি আমে কাল দাগ পড়ে সেক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করে প্রয়োজনে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কৃষি বিষয়ক যেকোনো পরামর্শের জন্য উপজেলা কৃষি অফিসে যোগাযোগের জন্য সকল আমচাষীদের পরামর্শ দেন।
উপজেলা নিবার্হী অফিসার (ইউএনও) সেলিম আহমেদ বলেন, নওগাঁর সাপাহার হতে আম রপ্তানির পথ সুগম করতে এই অঞ্চলে প্যাকিং হাউজ তৈরি বিষয়ে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে কৃষি মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে,এটি বাস্তবায়ন হলে আমচাষীদের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত হবে এবং এলাকায় অনেক কর্মসং¯’ানের সৃষ্টি হবে।