ছায়া সংসদে অধ্যাপক ম. তামিম : আদানির বিদ্যুৎ ব্যবহার না করেই দিতে হয় ৪০ শতাংশ খরচ

স্টাফ রিপোর্টার: 
আদানির বিদ্যুৎ চুক্তিতে কয়লার মূল্য অনেক বেশি ধরা হয়েছে। বাকি কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রে কয়লার দাম অনেক কম। ১০০ শতাংশ ক্যাপাসিটি চার্জ তো দিতে হবেই, সেই সঙ্গে ব্যবহার না করেও ৪০ শতাংশ বিদ্যুতের দাম দিতে হয় বলে মন্তব্য করেছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ম. তামিম।

তিনি বলেন, আদানির অন্যান্য ক্ষেত্রে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ দিলেই চলে। দ্রুত বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য তেলবিদ্যুতের বিকল্প ছিল। কিন্তু ২০১২-১৩ সালের পর কুইক রেন্টাল প্রয়োজন ছিল না।

শনিবার (১৪ ডিসেম্বর) রাজধানীর এফডিসিতে বিগত সরকারের আমলে জ্বালানি ও বিদ্যুতখাতের দুনীর্তি নিয়ে আয়োজিত এক ছায়া সংসদে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ম. তামিম। ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির আয়োজনে ছায়া সংসদের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ।

অধ্যাপক ড. ম. তামিম বলেন, রাজনীতিবিদ, আমলা ও ব্যবসায়ী এই তিন পক্ষের যোগসাজশেই জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে দুর্নীতি হয়েছে। আওয়ামী লীগের শাসন আমলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিনিময় ছাড়া কোন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হয়নি। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও পিএম অফিসের একক ক্ষমতার কারণেই এসব দুনীর্তির বিস্তার হয়েছে।

 

তিনি বলেন, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করা হলে দুনীর্তি কমানো সম্ভব। এস আলম ও সামিট গ্রুপের মত প্রতিষ্ঠানগুলির দুর্নীতি অনুসন্ধানে ফরেনসিক স্ক্রুটিনি প্রয়োজন। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) দেশের সবচেয়ে অস্বচ্ছ একটি প্রতিষ্ঠান। এই অস্বচ্ছতার পিছনে বিগত সরকারের স্বার্থ জড়িত ছিলো। লস দেখিয়ে দেখিয়ে উচ্চমূল্য নির্ধারণের জন্যই প্রতিষ্ঠানটিকে অস্বচ্ছ রাখা হতো। বর্তমান সরকার এসেও এখন পর্যন্ত প্রক্রিয়াটিকে স্বচ্ছ করতে পারেনি।

অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, তিন দিনের মধ্যে কোন আলাপ আলোচনা ছাড়াই তড়িঘড়ি করে আদানির সঙ্গে বিদ্যুৎ চুক্তি করা হয়। আদানির সঙ্গে চুক্তিটি অসম। এই চুক্তিটি পুণ:বিবেচনা করা দরকার। বিদ্যুৎ ও জ্বালানী খাতে মাফিয়াদের আইনের আওতায় না আনলে মাফিয়াতন্ত্র দমন হবে না। নিজস্ব গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন না করে কমিশনের লোভেই এলএনজির দিকে ঝুঁকে পড়া ছিলো ভুল উদ্যোগ।

তিনি বলেন, জবাবদিহিতাকে এড়ানোর জন্য বিগত সরকার গণশুনানির পরিবর্তে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন এর মাধ্যমে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম নির্ধারণ করতো, যা ছিলো অস্বচ্ছ।

এ সময় সভাপতির বক্তব্যে হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, ডাকাতরা বাংলাদেশে আর্থিক খাতের মত জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতেও অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছিল। লুটেরাদের সুযোগ করে দিতে ২০১০ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বিতর্কিত ইনডেমনিটি আইন পাস করেছিল। যার মেয়াদ দফায় দফায় বাড়িয়ে দুর্নীতির ক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছিল।

তিনি বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন ছাড়াও বিতরণ, সঞ্চালন ও মিটার কেনাকাটার নামে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নেয়া হয়েছিল। যাতে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মের তথ্য মিলেছে। আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতা ও চাহিদা কতটুকু তার কোনো সঠিক হিসাব নেই। গত সাড়ে ১৫ বছরে কোনো দরপত্র ছাড়াই বেসরকারি খাতে শতাধিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। যার বেশিরভাগই কোনো কাজে আসেনি।

হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, আদানির সঙ্গে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তিটি সম্পূর্ণ একপাক্ষিক ও দেশবিরোধী। এতে বাংলাদেশের স্বার্থ সুরক্ষিত হয়নি। জনগণকে পাশকাটিয়ে গোপনীয় ভাবে আদানি গ্রুপের সঙ্গে এই চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়। চুক্তি স্বাক্ষরকারী তৎকালীন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান চুক্তির কপি না দেখেই স্বাক্ষর করেছেন বলে জানা গেছে। আদানির সঙ্গে বিদ্যুৎ চুক্তি স্বাক্ষরকারী তৎকালীন পিডিবি চেয়ারম্যানকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে জানা যাবে কোন প্রেক্ষিতে কাদের চাপে তিনি চুক্তিপত্র না দেখেই এতে স্বাক্ষর করেছেন।

কিরণ আরো বলেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদনের পূর্বেই আমরা শুনেছি এই পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৫০০ কোটি ডলার আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠেছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও ভাগনি টিউলিপ সিদ্দিকির বিরুদ্ধে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিবেশগত ঝুঁকি ও দুর্ঘটনার শঙ্কা কখনোই বিবেচনায় আনা হয়নি।

ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির এই চেয়ারম্যান আরো বলেন, সুন্দরবনে সম্ভাব্য ক্ষতির আশঙ্কা থাকার পরেও ভারতের কঠিন শর্তের ঋণে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনায় ভারতীয় কর্মকর্তাদের দাপটে পিডিবি কর্মকর্তারা কোণঠাসা থাকেন। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বাণিজ্যিক উৎপাদনে আসার পর কারিগরি ত্রুটি লেগেই রয়েছে। উৎপাদন শুরু হওয়ার পর এই পর্যন্ত বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ৭ থেকে ৮ বার বন্ধ হয়েছে।

ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি’র আয়োজনে “জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের দুর্নীতির জন্য বিগত সরকারের রাজনীতিবিদ অপেক্ষা আমলারাই বেশি দায়ী” শীর্ষক ছায়া সংসদে আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিÍবাংলাদেশ এর বিতার্কিকদের পরাজিত করে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বিতার্কিকরা বিজয়ী হয়। প্রতিযোগিতায় বিচারক ছিলেন অধ্যাপক আবু মোহাম্মদ রইস, সাংবাদিক শাহনাজ বেগম, ড. তাজুল ইসলাম চৌধুরী তুহিন, সাংবাদিক রফিকুল বাসার, সাংবাদিক রিশান নসরুল্লাহ। প্রতিযোগিতাটি আয়োজন করে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি। প্রতিযোগিতা শেষে অংশগ্রহণকারী দলকে ট্রফি, ক্রেস্ট ও সনদপত্র প্রদান করা হয়।

সানশাইন /বিদ্যুৎ/ শামি


প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৪, ২০২৪ | সময়: ৬:৩৫ অপরাহ্ণ | Daily Sunshine

আরও খবর