রবিবার, ২৬শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ।
স্টাফ রিপোর্টার :
সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ পর্যায়ে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন ঘটে। সংসদ সদস্য, মেয়রসহ জনপ্রতিনিধিরা নিজ নিজ এলাকায় রীতিমতো জমিদার বনে যান। যার ফলে আওয়ামী লীগের আমলে স্থানীয় সরকার অকার্যকর হয়ে পড়েছিল বলে মন্তব্য করেছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান ড. রেহমান সোবহান। শনিবার বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) চারদিনব্যাপী বার্ষিক এবিসিডি সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশনে ‘এজেন্ডা ফর ইকোনমিস অ্যান্ড সোশ্যাল রিফর্ম’ শীর্ষক পাবলিক লেকচার প্রদানকালে তিনি এসব কথা বলেন।
বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। রাজধানীর গুলশানের একটি অভিজাত হোটেলে সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। রেহমান সোবহান বলেন, যেভাবে ঋণখেলাপিরা সুবিধা পেয়েছেন, সরকারের এ-জাতীয় নীতি দেশে অসমতা বৃদ্ধি করেছে। অসমতা পরিমাপের ক্ষেত্রে শুধু খানা আয়-ব্যয় জরিপের পরিসংখ্যান ব্যবহার করা হচ্ছে; এর বাইরে কেউ যাচ্ছে না। তাঁর মত, এ ক্ষেত্রে আয়করের বিবরণী গুরুত্বপূর্ণ আকর।
এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘খানা আয়-ব্যয় জরিপে শীর্ষ আয়ের মানুষের যে মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয়েছে, তা হলো ১০ লাখ টাকার সম্পদ ও মাসিক ৩০ হাজার টাকা আয়। এ সম্পদ এবং আয় গুলশান ও বারিধারার বেশির ভাগ গাড়িচালকেরই আছে। তাঁর মত, এই মানদণ্ড বিচার করা হলে আমাদের মতো অনেক মানুষই পরিসংখ্যান থেকে হারিয়ে যাবে।’ ফলে গবেষকেরা যা করছেন, তা মূলত আলংকারিক ও ব্যক্তিগত পর্যায়ের বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, আমাদের দেশে কাঠামোগত সমস্যা রয়েছে। এজন্য প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করা না গেলে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব হবে না। আমাদের রফতানি খাত শুধু পোশাক নির্ভর হলে চলবে না। রফতানিতে বৈচিত্রায়ন আনতে হবে। আমাদের নির্মাণ শিল্প ও সিরামিক শিল্পসহ অন্যান্য শিল্পগুলো যখন বাজার কাজ করে না তখন রাষ্ট্রকে হস্তক্ষেপ করতে হবে। কিন্তু এখানে রাষ্ট্রই কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না।
বিগত সরকারের প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান ও গুণগত মান নিয়ে অনেক বিতর্ক থাকলেও সেই সময় দেশে দারিদ্র্য বিমোচনের গতি ভালো ছিল বলে মন্তব্য করেন রেহমান সোবহান। দারিদ্র্যের বহুমুখী সূচকেও বাংলাদেশ ভালো করেছে। মানব উন্নয়নেও ভালো করেছে।
শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদনে বিষয়টি উলেস্নখ করা হয়েছে। এ প্রতিবেদনেও দারিদ্র্যবিমোচনের বিষয়টি নিয়ে কেউ চ্যালেঞ্জ করেনি। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন উলেস্নখযোগ্য। দারিদ্র্যের হার ৫৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশে নিয়ে আসা কোনো বিচারে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করেন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান।
পুষ্টিমান, শিশুমৃত্যু, পড়াশোনার সময়, পানের পানির প্রাপ্যতা, আবাসন-এসব ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের অগ্রগতি উলেস্নখযোগ্য বলে মনে করেন রেহমান সোবহান। এ বাস্তবতায় তাঁর মত, গবেষকদের কাজ হবে বাংলাদেশ প্যারাডক্সের নতুন রূপের সন্ধান করা। এত দিন সুশাসনের অভাবের মধ্যে কীভাবে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তা নিয়ে ছিল বিস্ময়। এখন দেখতে হবে, এ ধরনের অসম সমাজ ও অপশাসনের মধ্যে কীভাবে দারিদ্র্যবিমোচন ও মানবসম্পদ উন্নয়নে এতটা ভালো করল বাংলাদেশ। তাঁর বিশ্বাস, এই গবেষণা করতে গিয়ে অর্থনীতিবিদেরা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেন।
সম্মেলনে বর্তমান সরকারের শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, মানুষের টাকা ব্যাংকে আছে, কিন্তু ব্যাংকের সব টাকা বাইরে চলে গেছে। সেই টাকা তো মানুষের। এখন ব্যাংকগুলোর এই মানুষের টাকার জন্য রিসোর্স দরকার।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের ব্যালেন্স শিটে এখন দেখা যাচ্ছে যে অনেক টাকা আছে, কিন্তু আসলে দেশের ভেতরে কোনো রিসোর্স নেই। তাদের ওয়েজ দিতে হবে। ৩০ হাজার, ৪০ হাজার বা ১ লাখ শ্রমিককে একদিনে বিদায় দেওয়া যায় না। সেটা অনেক বড় অসন্তোষের সৃষ্টি করবে, যেটা এখন দেখা যাচ্ছে।
উপদেষ্টা আরও বলেন, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য দ্বিপাক্ষিক এবং আঞ্চলিক বাণিজ্য সম্প্রসারণের দিকে কৌশলী হতে হবে। তাহলে কোথা থেকে এই টাকা আসবে? তার মধ্যে যদি এখন বলা হয় যে আমাদেরকে আরও ইক্যুয়াল সোসাইটির দিকে যেতে হবেÍ যার অর্থ জনস্বাস্থ্য, শিক্ষা, মানবসম্পদ তৈরি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আরও রিসোর্স বিল্ড করতে হবে।
তার মতে, মার্কেট ইকোনমিকে ইক্যুয়াল করতে হলে অনেকে এখন বলে, অর্গানাইজেশনাল ডেমোক্রেসি লাগবে। প্রান্তিক কৃষক বলি বা শ্রমিকের কথা বলি, তাদের অর্গানাইজেশনাল স্ট্রেন্থ খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের চরের জমি দখল হয়ে যায়। হাওর অঞ্চলে অনেক জলাভূমি পড়ে আছে সেগুলোর ব্যবস্থাপনা দরকার। রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরা এগুলো দখল করে নিয়ে যায়। স্থানীয়ভাবে এটা যদি শক্তিশালী থাকতÍঅর্গানাইজেশনাল ডেমোক্রেসি, গ্রাসরুট ডেমোক্রেসি থাকত, তাহলে এখান থেকে অনেক রিসোর্স আসতো। এটা যদি গরীবদের কাছে যেতো, তাহলে অনেক লাভ হতো।
ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, আমরা স্বল্পকালীন সময়ের জন্য এসেছি। তাই সব কিছুৃ করা সম্ভভ হবে না। আমরা এখন সম্পদের সংকটে আছি। ফলে বিভিন্ন খাতে কাঙ্খিত বরাদ্দ নিশ্চিত করতে পারছি না। কিন্তু আমাদের দেশে বৈষম্য দুর করতে হলে গরীব মানুষদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। তেমানি ধনীদের কাছ থেকে কর আদায় বাড়াতে কর নীতিমালায় সংস্কার আননেত হবে।
তিনি বলেন, আমরা ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণ করবো। কেউ বলছে এলডিসি থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। আবার কেই বলছেন এখনই নয়। আমরা যে অবস্থায় আছি এতে এলডিসি উত্তরণের বিকল্প নেই। তবে আমরা যেটি করতে পারি সেটি হলো এলডিসি থেকে বেরিয়ে গেলেও উন্নত দেশগুলোকে বলতে পারি আমরাদেও সক্ষমতা এখনো বাড়েনি। তাই রপ্তানি ক্ষেত্রে বিভিন্ন সুযোগ এবং জিএসপি প্ল্যাস সুবিধা যেন দেওয়া হয়।
সম্মেলনে বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ইন্দরমিত এস গিল অনুষ্ঠানে বলেন, মধ্যম আয়ের ফাঁদ থেকে বের হতে বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির ওপর মনোযোগ দিতে হবে। তিনি জানান, উদ্যোক্তা তৈরি এবং প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। এ জন্য মানবসম্পদ উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক।
ইন্দরমিত বলেন, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক বাণিজ্য সম্প্রসারণে কৌশলী হওয়ার পাশাপাশি সেবা ও উৎপাদিত পণ্যের মূল্য সংযোজন বাড়াতে বাংলাদেশকে উদ্যোগ নিতে হবে। গিল আরও বলেন, বাংলাদেশের উচিত ম্যানুফ্যাকচারিং এবং সেবা খাতের মধ্যে নির্বাচনের মধ্যে না গিয়ে, উভয় ক্ষেত্রের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা।
এছাড়া, শক্তির খাতে তিনি বাংলাদেশের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি, যেমন শক্তি উৎসের উৎস (জীবাশ্ম জ্বালানি বা নবায়নযোগ্য শক্তি) নিয়ে আলোচনা করেছেন।
তিনি বলেন, প্রকৃত উদ্বেগ হওয়া উচিত দেশের শক্তির ব্যবহার কতটা দক্ষতার সঙ্গে হয়, কারণ যদি শক্তির ব্যবহার অদক্ষ হয়, তবে এটি উচ্চ কার্বন নিঃসরণ ঘটাবে।
সেমিনারে আগামীতে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা সাজানোর পরামর্শ দেয় বিশ্বব্যাংক।
বিনায়ক সেন জানান, চারদিনে বিভিন্ন অধিবেশনে প্রায় ৩০টি গবেষণাপত্র এবং ১২টি পাবলিক লেকচার অনুষ্ঠিত হবে। তিনি বলেন, জুলাই-আগস্টের ছাত্র আন্দোলনের মধ্যদিয়ে বৈষম্যবিরোধী মনোভাব আরও বড় হিসেবে তৈরি হয়েছে। সেই স্প্রিটকে সামনে রেখে বৈষম্য দূর করতে সম্পদেরও সুষম বণ্টন নিশ্চিত করতে হবে। আগামী মঙ্গলবার এ সম্মেলন শেষ হবে।
সানশাইন / বিদ্যুৎ/শামি