রবিবার, ৮ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ।
আব্দুল্লাহ আল মারুফ:
যেতে নাহি দিব, হায়, তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়। কথাগুলো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। তবে যদি কথাগুলো আজ কারো সাথে মিলে যায়, তাহলে তিনি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের অন্যতম সেরা নক্ষত্র, ফরহাদ হোসেন। ৩৭ বছরের জীবনে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে একটু একটু করো দারুণ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের সাথে। আজ সেই সম্পর্কের ইতি টেনেছেন দেশের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে পঞ্চম সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক ফরহাদ। বয়স বা কারো চাপে নয়, বরং নতুনদের সুযোগ করে দিতেই গত ম্যাচে নার্ভাস নাইন্টিজে আউট হওয়া ফরহাদের এমন সিদ্ধান্ত।
রাজশাহী তথা এ দেশের ক্রিকেটাঙ্গনে নিদান ভদ্রলোক দের খোঁজ করলে যে নামটি প্রথমেই ভেসে উঠবে, তিনি হয়তো ফরহাদ হোসেন। ঠোঁটের কোনে সব সময়ই হাসি লাগিয়ে রাখা, আর চুপচাপ স্বভাবের জন্য সবার কাছে প্রিয় নামটিও ফরহাদ! ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং এ তিন বিভাগেই দ্যুতি ছড়িয়ে বেড়ানো ক্রিকেটারটিও ফরহাদ! আবার, জাতীয় দলের দুয়ারে প্রায় প্রতিটি বছর মাথা ঠুকে বেড়ানো দুর্ভাগা ক্রিকেটারটির নামও বুঝি এই ফরহাদ!
প্রথম শ্রেণি হতে শুরু করে সব পর্যায়ের ক্রিকেট খেলা ফরহাদ, মূলত তাঁর কুল হেডেড ক্রিকেট দিয়েই ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট সকলকে মুগ্ধ করে রেখেছেন প্রায় দেড় যুগ। কখনো ব্যাটে, আর কখনো বা বলে, কোথায় নেই তিনি? বাংলাদেশ ‘এ’ দলে প্রতিনিধিত্ব করা ফরহাদ দীর্ঘদিন ধরে খেলছেন এনসিএল, বিসিএল, বিপিএল, ডিপিএল সহ দেশের সমস্ত এলিট শ্রেণির ক্রিকেট!
বাংলাদেশের ক্রিকেট আকাশ তন্নতন্ন করে খুঁজে হাতে গোনা যেসব নক্ষত্র পাওয়া যাবে, সেই সকল নক্ষত্রদের একজন ফরহাদ হোসেন! যার প্রমান স্মৃতিতে আজও তরতাজা! ২০১৭ সালের ৬ মার্চ, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে দেশের মাত্র পঞ্চম ক্রিকেটার হিসাবে সাত হাজার রানের মালিক বনে যান ফরহাদ!
১৬১টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলা ফরহাদের রান নয় হাজারের অধিক। যেখানে রয়েছে ১৮টি সেঞ্চুরি! আছে ডাবল সেঞ্চুরিও। এক ইনিংসে ২১৬ রান এই ফরম্যাটে তাঁর সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত সংগ্রহ! করেছেন ৪৬ টি অর্ধশতক। এসবের পাশাপাশি বোলিং-ফিল্ডিংয়েও সমান উজ্জ্বল ছিলেন ফরহাদ! সমান সংখ্যক ম্যাচে ১৬৫টি উইকেট আছে তাঁর ঝুলিতে! যেখানে এক ইনিংসে ১৪রান খরচায় ৬ উইকেট প্রাপ্তি তাঁর সেরা বোলিং নৈপুণ্য! এ পর্যন্ত দুই শতাধিক ক্যাচ তালুবন্দী করেছেন ফরহাদ!
বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণি ও লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটের রেকর্ডের পাতা উল্টালে যে নামটি অনেক উজ্জ্বল দেখা যায়, যে নামটি সবচেয়ে বেশী জ্বলজ্বলে, তিনিই ফরহাদ হোসেন। কেনোই-বা নামটি উজ্জ্বল দেখা যাবেনা? আর কেনোই-বা জ্বলজ্বল করবেনা? স্বীকৃত ক্রিকেটে বারো হাজারের অধিক রান ও দুই শতাধিক উইকেট যার ঝুলিতে, তার নামটি-ই তো উজ্জ্বল দেখা যাওয়ার কথা সবচেয়ে বেশী! প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে, রাজশাহীর সর্বোচ্চ রান ও সেঞ্চুরির মালিক যিনি, তাঁর নামটিই তো সবচেয়ে বেশী জ্বলজ্বল করার কথা!
লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটেও বেশ সফল ফরহাদ! এখানেও তাঁর রয়েছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার রান এবং ৩০ টির অধিক উইকেট! মাত্র ১৬ রান দিয়ে ৫ উইকেট শিকার, যেখানে তার সেরা সাফাল্য! এখানেও ফরহাদ হোসেনের রয়েছে ক্যাচের অর্ধশতক!
প্রথম শ্রেণি ও লিস্ট-এ ক্রিকেটে দুর্দান্ত খেলা ফরহাদের টি-টোয়েন্টি খেলার সুযোগ তেমন মেলেনি। মাত্র ৩৫টি টি-টোয়েন্টি’র ২৮ ইনিংসে ব্যাট করা ফরহাদ ব্যাট হাতে রান করেছেন সাড়ে তিনশ’র অধিক এবং বল হাতে হাত ঘুরিয়ে উইকেট পেয়েছেন ৯ টি, যেখানে সেরা সাফল্য মাত্র ১১ রানের বিনিময়ে ৩ উইকেট! এই ফরম্যাটে ক্যাচও নিয়েছেন ১৩টি!
বিপিএলে রাজশাহী কিংস ও বরিশাল বার্নার্সের হয়ে মাঠে নামা ফরহাদ খেলেছেন দেশের বয়স ভিত্তিক দলে এবং সফর করেছেন বিশ্বের বহু দেশ! ইন্ডিয়া ট্যুর দিয়ে যে যাত্রা শুরু হয়েছিলো! পরবর্তীতে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৫, ১৭, ১৯ ও ‘এ’ দলের হয়ে অস্ট্রেলিয়া, মালোয়েশিয়া সাউথ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড, ওয়েস্টইন্ডিজ, আয়ারল্যান্ড, শ্রীলংকা, ও দুবাই সফর করেন ফরহাদ।
সর্বশেষ ঢাকা প্রিমিয়ার লীগেও বেশ উজ্জ্বল ছিলেন ফরহাদ। করেন দুই শতাধিক রান! বিভিন্ন সময়ে রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন দলের হয়ে টস করতে নামা ফরহাদ বেশ শক্ত হাতেই সবসময় নিয়ন্ত্রণ করেছেন নিজ দলকে। কেবল বাংলাদেশ ‘এ’, প্রথম শ্রেনী কিংবা লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটের বৃত্তেই আটকে থাকেননি ফরহাদ হোসেন!
১৯৮৭ সালে রাজশাহীতে জন্ম নেওয়া এই কৃতি ক্রিকেটার দুর্দান্ত প্রতাপে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন পুরো বাংলাদেশ। নিজেকে সব সময়-ই ক্রিকেটের মাঝে ডুবিয়ে রাখতে খেলেছেন রাজশাহীসহ দেশের প্রায় সকল বিভাগ ও জেলার লীগ ও টুর্নামেন্ট! প্রথম স্তরের মত এই সকল স্তরেও বেশ সফল ফরহাদ!
এত এত মুগ্ধতার পরশ বুলিয়ে যাবার পরও কোন এক অজানা কারনেই জাতীয় দলের দরজাটা অধরা রয়ে গেছে তাঁর কাছে! ব্যাটিং, বোলিং বা ফিল্ডিং দিয়ে দেশের সকল পর্যায়ের ক্রিকেটে সমান উজ্জ্বল, সেই সাথে এত এত সব রেকর্ডের মালিক ফরহাদের হয়তো ভাগ্য দোষেই আর ছোঁয়া হয়নি স্বপ্নের বাংলাদেশ জাতীয় দলে প্রবেশের স্বার্ণালী চাবি।
তবু স্বপ্ন দেখতে ক্ষতি কি? ক্ষতি কি শেষ চেষ্টা করতে। হয়তো ফরহাদও সেই পথেই হাঁটতে চেয়েছিলেন। কারন শত আশাভঙ্গের বেদনা আর হতাশার গল্পের মধ্যে সম্ভাবনা বলে একটা শব্দ তো অভিধানে থেকেই যায়! আর সেসব ক্ষুদ্র সম্ভাবনাগুলোকে সাথী করেই এগিয়ে যেতে চেয়েছিলেন ফরহাদ! চলতি মৌসুমেই দাঁড়াতে চেয়েছিলেন নতুন করে, নতুন স্বপ্নকে বুকে লালন করে শুরুটাও করেছিলেন দারুন। দু’শ তম ক্যাচ, ৯ সহস্রাধিক রানের মাইলফলক, প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে দেশের পঞ্চম সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক সহ আরো নানান রেকর্ড নিজের করে নিয়েছিলেন। সর্বশেষ ম্যাচে ৯২রান করে হয়তো জানান দিতে চেয়েছিলেন, অবিচল থাকতে চান ততদিন, যতদিন শরীর কথা বলবে, যতদিন দেহের রক্ত গুলোতে স্বপ্নের বারতা বয়ে যাবে, যতদিন ক্রিকেটের প্রতি আত্মনিবেদন ও ভালোবাসাটা বুকের বাঁ-পাশের মাংশপিন্ডে অক্ষুন্ন থাকবে। কিন্তু না, তেমনটা হলোনা। দুর্দান্ত সেই ইনিংসটি দিয়ে তিনি তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষরটা কেবল ২২গজে রেখে গেলেন। নিজের স্বপ্ন সফল করার লক্ষ্যে ছুটলেও ফরহাদ যেন ভেতরে ভেতরে অন্য একটা অংক-ও কষছিলেন। যে অংক বহু বছর আগে সুকান্ত ভট্টাচার্য তাঁর ছাড়পত্রে লিখেছিলেন, ‘এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান’!
সত্যিই তো, বয়স যেভাবে এগুচ্ছে, আর দেশের ক্রিকেট যে নীতিতে এগিয়ে চলছে, তাতে সবখানেই দ্যুতি ছড়ানো এই প্রতিভার সুযোগ যে আর মিলবেনা, তা তো এখন বলে দেওয়াই যায়।
অনেক জল্পনা-কল্পনা শেষে অবশেষে ঘোষণাটা দিয়েই দিলেন ফরহাদ। দেশের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট ইতিহাসের সফলতম অলরাউন্ডারকে এরপর আর খেলতে দেখা যাবে না প্রথম শ্রেণির ম্যাচে!
বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে অপ্রাপ্তি একটাই, টেষ্ট/ওয়ানডে ক্যাপ! আর প্রাপ্তি? অনেক অনেক, হাজারে হাজার! যার মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তির নাম হয়তো নিজ দেশের ক্রিকেট বোর্ড থেকে পাওয়া অবহেলা আর অনাদর! প্রাপ্তি সুখের, প্রাপ্তি আনন্দের! তবে ফরহাদের প্রাপ্তি একটু ভিন্ন, ‘আক্ষেপ এর’!
সানশাইন / শাহজাদা