রবিবার, ৮ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ।
রবিউল ইসলাম রবি, দুর্গাপুর:
ব্লেসিং এগ্রোভেট ইন্ডাস্ট্রিজের ছত্রাকনাশক স্প্রে করে প্রায় ১৫ বিঘা জমিতে থাকা ফুলকপি ক্ষেতেই পচে নষ্ট হয়ে গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে কৃষকদের প্রায় ৩৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলেও দাবি করেছেন কৃষকরা। রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার জয়নগর ইউনিয়নের চুনিয়াপাড়া এলাকার ভুক্তভোগী কৃষকরা প্রতিকার চেয়ে উপজেলা প্রশাসন ও কৃষি বিভাগে লিখিত অভিযোগ করেছেন। এদিকে, কৃষি বিভাগ থেকে ভুক্তভোগী কৃষকদের অভিযোগ ক্ষতিয়ে দেখার আশ্বাস দেয়া হলেও দায় নিতে নারাজ ব্লেসিং এগ্রোভেট ইন্ডাস্ট্রিজের (প্রেস্টিসাইড) রাজশাহী অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা।
গত সোমবার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন উপজেলার জয়নগর ইউনিয়নের চুনিয়াপাড়া এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা। লিখিত অভিযোগে কৃষকরা ৩৫ লাখ ৫২ হাজার ৫০০ টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন।
অভিযোগ পেয়ে ইউএনও সাবরিনা শারমিন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাহানা পারভীন লাবনীকে তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছেন। গত মঙ্গলবার কৃষি কর্মকর্তা সরেজমিনে ক্ষতিগ্রস্ত ফসলের ক্ষেত পরিদর্শন করেছেন। এর আগেই ওই ছত্রাকনাশক বাজারজাতকারী কোম্পানি এলাকার দোকান থেকে পণ্যটি প্রত্যাহার করে নিয়েছে। কৃষকদের অভিযোগ, ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে ওই কীটনাশক কোম্পানি কালক্ষেপণ করছেন।
ভুক্তভোগী কৃষকদের অভিযোগের পর সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, উপজেলার চুনিয়াপাড়া এলাকার ১৩ জন কৃষক অন্যের জমি লিজ নিয়ে ফুলকপি চাষ শুরু করেন। ছত্রাকের আক্রমণ থেকে রক্ষা ও ভালো ফলন পাওয়ার আশায় গগণবাড়িয়া বাজারের মেসার্স মাহামুদ এন্টারপ্রাইজ থেকে ব্লেসিং এগ্রোভেট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড কোম্পানির ‘নিউজিম ৫০ ডব্লিউপি’ ছত্রাকনাশক কিনে ফুলকপিতে স্প্রে শুরু করেন। স্প্রে শুরুর কয়েকদিন পর থেকে ফুলকপি গুলো ধিরে ধিরে ফুলের ভেতর থেকে পচন দেখা দিতে থাকে। একপর্যায়ে পুরো ফুলকপি পচে নষ্ট হয়ে যায়। পচনের এই চিত্র এখন পুরো ফসলের ক্ষেতজুড়ে।
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক শফিকুল ইসলাম বলেন, তিনি ২ লাখ ৪০ হাজার টাকায় তিন বিঘা জমি লিজ নিয়ে ফুলকপি চাষ শুরু করেন। ফুলকপি গুলো ধিরে ধিরে পরিপক্ক হয়ে উঠছিল। বাজারজাতের আগেই ছত্রাকের আক্রমণ দেখা দিলে গগনবাড়িয়া বাজারের মেসার্স মাহামুদা এন্টারপ্রাইজের স্বতাধিকারী ছাতাহার আলীর শরণাপন্ন হন। ছাতাহার আলী তাকে ব্লেসি এগ্রোভেট কোম্পানির নিউজিম নামের ছত্রাকনাশক স্প্রে করার পরামর্শ দেন। ছাতাহার আলীর পরামর্শে শফিকুল ইসলাম সহ আরও কয়েকজন কৃষক ছত্রাকনাশক ‘নিউজিম’ কিনে ফুলকপির ক্ষেতে স্প্রে করেন। স্প্রে করার ১২ ঘণ্টা পর তিনি ক্ষেতে গিয়ে দেখেন ফুলকপি গুলোতে কালচে দাগ দেখা দিয়েছে। আবার কোনটাতে পচন ধরেছে। এক সপ্তাহের মধ্যে পুরো ক্ষেতের ফুলকপি পচে নষ্ট হয়ে যায়।
কৃষক হযরত আলী বলেন, আমার ২৫ কাঠা জমিতে ফুলকপি ছিল। ক্ষতির পরিমাণ প্রায় তিন লাখ টাকা। আমি নিউজিম ছত্রাকনাশক স্প্রে করি ১২ অক্টোবর। ১৬ অক্টোবর বুঝতে পারি ফুলকপিতে সমস্যা দেখা দিয়েছে। গত ২১ অক্টোবর অভিযোগ জানাই ডিলারের কাছে। তাতে লাভ না হলে ইউএনওর কাছে লিখিত অভিযোগ করি।
সেকেন্দার আলী নামের আরেক কৃষক বলেন, এনজিও থেকে ঋণ করে দুই বিঘা জমিতে ফুলকপি চাষ করেছি। ৫ টাকা করে চারাগাছ কিনে দুই বিঘা জমিতে ফুলকপি চাষ করেছিলাম। এ পর্যন্ত আমার প্রায় ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। ফুলকপি গুলো বাজারজাতের সময় হয়ে এসেছিলো প্রায়। ভালো ফলন পাওয়ার আশায় অন্যদের দেখাদেখি আমিও নিউজিম পাউডার স্প্রে করি। এই ছত্রাকনাশক পাউডার স্প্রে করেই আমি পথে বসে গেছি। পুরো ক্ষেতের ফুলকপি পচে নষ্ট হয়ে গেছে।
শফিকুল ইসলাম, হযরত আলী ও সেকেন্দার আলীসহ অন্য ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা সবাই গগনবাড়িয়া বাজারের মেসার্স মাহামুদা এন্টারপ্রাইজ নামের একটি কীটনাশকের দোকান থেকে কার্বেনডাজিম গ্রুপের ‘নিউজিম’ নামক ছত্রাকনাশক পাউডার কিনে জমিতে স্প্রে করেছিলেন। এটি বাজারজাত করেছে ব্লেসিং এগ্রোভেট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। প্যাকেটের গায়ে প্রস্তুতকারক হিসেবে লেখা আছে চীনের জিয়াংসু লাফেং বায়োকেমিক্যাল কোম্পানি লিমিটেড। ৫০০ গ্রামের প্যাকেট ৫০০ টাকায় কিনে এই ওষুধ স্প্রে করেছিলেন কৃষকরা।
ব্লেসিং এগ্রোভেট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের স্থানীয় পরিবেশক মেসার্স মাহামুদা এন্টারপ্রাইজের স্বতাধিকারী সাতাহার আলীর সাথে কথা বলা হলে তিনি জানান, কৃষকদের এমন অভিযোগের পর বিষয়টি কোম্পানির লোকজনকে জানানো হয়েছে। তারা এসে অবিক্রীত নিউজিমের প্যাকেট গুলো নিয়ে গেছেন। এর আগেও অন্যান্য ক্ষেতে নিউজিয়াম প্রয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু কেউ এমন অভিযোগ করেননি। এবারই এমন অভিযোগ করছেন কৃষকরা।
তিনি আরও বলেন, মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার অথবা অন্য কোনো কীটনাশকের সাথে সংমিশ্রণের কারনেও এমনটা ঘটে থাকতে পারে। তবে কোম্পানি ও কৃষি বিভাগ থেকে পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। তাদের সিদ্ধান্ত পেলে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।
ব্লেসিং এগ্রোভেট ইন্ডাস্ট্রিজের রিজিওনাল সেলস্ ম্যানেজার (আরএসএম) জহুরুল হক দাবি করেন, একই প্রোডাক্ট রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলে ব্যবহার করা হয়েছে। তাছাড়া কয়েকটি প্রদর্শনী প্লট করা হয়েছে। কোনো জায়গাতেই এ ধরনের সমস্যা পরিলক্ষিত হয়নি। অভিযোগের পর অবিক্রীত প্যাকেট গুলো বাজার থেকে প্রত্যাহার করে ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর আসল কারণ জানা যাবে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাহানা পারভীন লাবনী বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত ফসলের ক্ষেত পরিদর্শন করেছি। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা যাচ্ছে কোনো কিছু স্প্রে করার ফলে এমনটি ঘটেছে। পচে যাওয়া ফুলকপির নমুনা সংগ্রহ করেছি। পরীক্ষার জন্য ল্যাবে পাঠানো হবে। ল্যাবের রিপোর্টের ভিত্তিতেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাবরিনা শারমিন বলেন, কয়েকজন কৃষক একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। কৃষি কর্মকর্তাকে অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে।