সোমবার, ৪ঠা নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৯শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি: ৩৭ বছরের যুবক আব্দুল হান্নান। চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের পাহাড়পুরের সায়েদ আলীর ছেলে। ১৩ দিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে অবশেষে হার মানেন ১১ অক্টোবর। আব্দুল হান্নানের মৃত্যু নিয়ে তৈরি হয় রহস্য। কারণ বৃষ্টিভেজা এক রাতে মারাত্মক জখম অবস্থায় পাওয়া যায় তাকে। পরবর্তীতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে আব্দুল হান্নানের। পুলিশের তদন্তেও উঠে এসেছে একই তথ্য। এমনকি দুর্ঘটনাকবলিত যানটির চালক ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন আদালতে। তবে আব্দুল হান্নানের ভাই তার মৃত্যু নিয়ে হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় ৫ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাত আরও ৭-৮ জনকে আসামি করা হয়। যদিও আসামিদের পরিবারের দাবিÑ ‘মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো’ হয়েছে তাদের। আব্দুল হান্নানের মৃত্যুর রহস্যের জট খুলতে এলাকায় অনুসন্ধান চালান প্রতিবেদক। গত মঙ্গলবার সকাল থেকে টানা বিকেল পর্যন্ত ঘটনাস্থল ও তার আশেপাশে চালানো অনুসন্ধানে অনেক মানুষের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। যার অডিও-ভিডিও রেকর্ড ধারণ করা রয়েছে। এ সময় আগের ধারণ করা কয়েকটি অডিও ও ভিডিও ক্লিপও আসে প্রতিবেদকের হাতে। যেগুলো অনুসন্ধানে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
কি ঘটেছিল সেদিন : ২৮ সেপ্টেম্বর, রাত ৯টা। কিছুক্ষণ আগেও বজ্রসহ মুষলধারে বৃষ্টি হয়েছে। গ্রামের সড়কে তেমন যানবাহন নেই। পাড়ার দোকানগুলোতে চায়ের আড্ডা তখনও জমজমাট। মমিনের মোড় থেকে পাহাড়পুরে নিজ বাড়ি যাওয়ার জন্য পায়ে হেঁটে রওনা হন আব্দুল হান্নান। আব্দুল হান্নান এলাকায় গ্রাম্য চিকিৎসক হিসেবে পরিচিত। পাশাপাশি মমিনের মোড়ে তার একটি কাপড়ের দোকান ছিল। কিছুক্ষণ পর মমিনের মোড় থেকে ৩০০ মিটার দূরে সাইফুদ্দিনের বাড়ির সামনে রক্তাক্ত-জখম ও অজ্ঞান অবস্থায় দেখা যায় তাকে। ‘বিকট শব্দ’ শুনে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসেন ঘটনাস্থলের পাশের বাড়ির পানু ইসলাম নামে এক ব্যক্তি। এরপর তিনি দেখেন তিনজন ব্যক্তি একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার নিচ থেকে টেনে বের করার চেষ্টা করছেন আব্দুল হান্নানকে। তাদের সঙ্গে যোগ দেন পানুও।
পানু ইসলাম প্রতিবেদককে বলেন, আমি আসার পর দেখি একটি দোলনার (ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা) নিচে পড়ে আছেন আব্দুল হান্নান। দোলনার চালক আব্দুর রাজ্জাক ও দুজন যাত্রী তাকে বের করার চেষ্টা করছেন। আমি তাদের সহযোগিতা করে আব্দুল হান্নানকে উদ্ধারের পর একটি বাড়ির সামনে নিয়ে সেবাযত্ন করি। পরে আব্দুল হান্নানের বাড়ির লোকজনকে খবর দিই। তিনি বলেন, পরবর্তীতে একটি অটোরিকশাতে করে আব্দুল হান্নানকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। আব্দুল হান্নানের স্বজনদের নিয়ে হাসপাতালে যান ‘দুর্ঘটনাকবলিত’ অটোরিকশাচালক আব্দুর রাজ্জাক।
পানু ইসলামের সঙ্গে কথা বলার সময় সেখানে আসেন গ্রামের আরেক বাসিন্দা একবর আলী। তিনি প্রত্যক্ষদর্শী নন, তবে ঘটনা সম্পর্কে অবহিত। তিনি বলেন, ঘটনার পর যখন আব্দুল হান্নান হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তখন মৃত্যু নিয়ে কেউ কোন কথা বলেনি। সবাই জানে যে, সড়ক দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে যখন শুনলাম এ ঘটনায় হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে তখন খুব অবাক হয়েছি। আমরা ধারণা করতেই পারিনি ঘটনাটি এভাবে বদলে দেয়া হবে। কি উদ্দেশ্যে মৃত্যুর কারণ বদলে দেয়া হয়েছে তা আমাদের জানা নেই। মমিনের মোড়, বাঁশবাড়ি, পাহাড়পুরের ১৫-১৬ জনের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রতিবেদক। এদের বেশিরভাগই শুনেছেন দুর্ঘটনাতেই আব্দুল হান্নানের মৃত্যু হয়েছে।
আসামিরা ছিলেন চায়ের দোকানে : আব্দুর রশিদের মামলায় আসামি করা হয়েছে পাহাড়পুর-বাশবাড়ির জাব্বার আলীর ছেলে বাচ্চু আলী, মৃত মেজাদ্দি ভোলার ছেলে মো. এত্তার আলী, মৃত লালচানের ছেলে রহমান, মৃত মনসুরের ছেলে মো. জোহরুল ইসলাম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের হুজরাপুরের মৃত মঞ্জুর হোসেনের ছেলে মুরশেদ চৌধুরী। ঘটনার সময় উল্লেখ করা হয়েছে রাত ৯টা। কিন্তু ওই সময় মামলার ২ নম্বর আসামি এত্তার আলী বাঁশবাড়ি এলাকার একটি চায়ের দোকানে ছিলেন। এই দাবি করেছেন ওই চা দোকানের মালিক শরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, বৃষ্টির মধ্যে কোথাও যেতে না পেরে এত্তার আলী আমার দোকানেই বসেছিলেন। তার অদূরে আরেকটি দোকানে বসেছিলেন রহমান ও জোহরুল ইসলাম। স্থানীয় তরুণ জিহাদ আলীও দাবি করেন, ওই দিন রাত ৯টার সময় চায়ের দোকানেই বসে থাকতে দেখেছেন কয়েকজনকে। যাদের মামলায় আসামি করা হয়। আর ৫ নং আসামি মুরশেদ চৌধুরীকে সারাদিনই দেখেননি এলাকাতে। কাজেই আব্দুল হান্নানের মৃত্যুর সঙ্গে আসামিরা কোনভাবেই জড়িত থাকার কথা নয়। একই দাবি করেছেন পাহাড়পুরের মুদি ব্যবসায়ী খাইরুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমার দোকানের কিছু দূরেই ঘটনাটি ঘটে। রাতে ঘটনার সময় এই সড়কে তেমন কাউকে চলাচল করতে দেখিনি। মামলায় যাদের কথা বলা হয়েছে তাদেরও এলাকায় দেখা যায়নি।
আব্দুর রশিদের মামলায় ৫ জনের নাম উল্লেখসহ আরও ৭/৮ জন অজ্ঞাত ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। সবমিলিয়ে কমপক্ষে ১২ জন লোকের উপস্থিত হওয়ার কথা ঘটনার সময়। কিন্তু ওই রাতে এত লোককে গ্রামে দেখতে পায়নি গ্রামবাসী এমনই দাবি করেছেন প্রতিবেদকের কাছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, আব্দুল হান্নানের সঙ্গে এজাহারনামীয় আসামিদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। এমন অবস্থায় তাকে হত্যা করার কোন মোটিভ খুঁজে পাচ্ছেন না তারা।
এজাহারের সঙ্গে বাদীর বক্তব্যের অমিল : আব্দুর রশিদের দায়ের করা মামলার এজাহারে বলা হয়েছেÑ আমার ভাই আব্দুল হান্নান ও আমার ভাতিজা মেরাজকে পিকনিকের নাম করে ডাকে আসামিরা। পিকনিক না হওয়ায় ভাই ও ভাতিজা বাড়ি আসার পথে পূর্বশত্রুতার জের ধরে আসামিরা পথরোধ করে। ৫ নং আসামির হুকুমে ১ নং আসামি শাবলের ধারালো অংশ দিয়ে সজোরে আঘাত করে। এতে তার মাথার ভেতরে ঢুকে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে রক্তক্ষরণ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। অন্য আসামিরা এলোপাথাড়ি আঘাত করে শরীরের বিভিন্ন স্থানে লীলাফোলা জখম করে। ভাতিজা মেরাজকেও এলোপাথাড়ি মারধর করে লীলাফোলা জখম করে। আমার ভাই ভাতিজা চিৎকার দিলে আশেপাশের লোকজন আসার সঙ্গে সঙ্গে আসামিরা ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। পরে স্থানীয় লোকজন আব্দুল হান্নানকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়।
এজাহারে এলোপাথাড়ি মারধরের কথা বলা হলেও আব্দুল হান্নানের শরীরের দুটি স্থানে আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে। একটি মাথায় অপরটি পিঠে। আর কোথাও কোন আঘাতের চিহ্ন নেই বলে জানিয়েছেন খোদ মামলার বাদী আব্দুর রশিদ। তিনি বলেন, ময়নাতদন্তের পর মরদেহ দাফনের জন্য ধোয়ার সময় আমি দেখেছি দুটি স্থানে আঘাত। আর কোথাও আঘাত নেই। একই কথা বলেন মরদেহ ধোয়ানোর কাজে নিয়জিত তার চাচাত ভাই এত্তাব আলীও। এজাহারের বর্ণনা অনুযায়ী স্থানীয় লোকজন আব্দুল হান্নানকে হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু বাদী আব্দুর রশিদ প্রতিবেদককে বলেন, তিনিসহ তার পরিবারের সদস্যরা হাসপাতালে নিয়েছিলেন। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসার পর পাঠানো হয় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
অনেক প্রশ্নের উত্তর মেলেনি : মামলার বাদী আব্দুর রশিদকে প্রশ্ন করা হয়, আসামিরা কিভাবে, কোন যানবাহনে এসেছিলেন? বিদ্যুৎহীন (বাদীর বক্তব্য অনুযায়ী) রাতের অন্ধকারে আসামিদের কিভাবে চিনলেন বাদী ও অন্যরা? মারধর যদি হয়ে থাকে তখন আব্দুল হান্নান চিৎকার, চেচামেচি করেননি কেন? আব্দুল হান্নানের সঙ্গে থাকা তার ভাতিজা চাচাকে রক্ষা না করে পালিয়ে গেলেন কেন? মৃত হান্নানের সঙ্গে আসামিদের বন্ধুর মতো সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও কেন তাকে মারা হলো? এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি তিনি। তবে আব্দুল হান্নানের সঙ্গে থাকা তার ভাতিজা মেরাজ বলেছেন, তিনি ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। তাকে হাত দিয়ে শুধু একটি আঘাত করা হয়। যদিও এজাহারে লেখা হয়েছে মেরাজকেও এলোপাথাড়ি মারধর করা হয়েছে।
সন্দেহজনক তিন ব্যক্তি আড়ালে : ঘটনার সময় যারা সশরীরে উপস্থিত ছিলেন বলে দাবি করা হচ্ছে তাদের দুজন হলেন পাহাড়পুরের বাসিন্দা কবির আলীর ছেলে সোহাগ আলী ও মৃত আফজাল হোসেনের ছেলে নাসিম আহমেদ। আব্দুর রশিদের মামলা দায়েরের পর থেকে তারা এলাকায় নেই। অথচ মামলায় তাদের কোন সম্পৃক্ততা নেই।
স্থানীয়রা বলছেন, তাদের ভয়-ভীতি দেখিয়ে এলাকার বাইরে রাখা হয়েছে। কারণ তারা জবানবন্দি দিলে অনেক বিষয় পরিস্কার হয়ে যাবে। তখন আর মামলার এজাহার টিকবে না। অনুসন্ধানকালে ওই দুই যুবককে খোঁজার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তাদের সন্ধান করতে পারেনি। পুলিশের তদন্তে উঠে আসে আব্দুর রাজ্জাকের অটোরিকশার ধাক্কায় মারা যান আব্দুল হান্নান। প্রথমে বিষয়টি গোপন করে আব্দুর রাজ্জাকের পরিবার। কিন্তু পরবর্তীতে এলাকার অনেকের সামনেই আব্দুর রাজ্জাকের পিতা টানু বলেছেন তার ছেলের অটোরিকশার ধাক্কায় মারা গেছে আব্দুল হান্নান। কিন্তু তিনিও সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেননি। তবে অনুসন্ধানকালে একটি অডিও ক্লিপ পেয়েছেন প্রতিবেদক। সেখানে এক ব্যক্তিকে বলতে শোনা যাচ্ছেÑ ‘আমার ছেলের গাড়িতেই মারা গেছে সে’। স্থানীয়রা দাবি করেছেন ওই কণ্ঠস্বরটি টানুর।
১৬৪ ধারায় জবানবন্দি ও পুলিশের ভাষ্য : হত্যা মামলার দায়েরের পর পুলিশ ২ নং আসামি এত্তার আলীকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠায়। এরপর গভীরতর তদন্তে নামে পুলিশ। তদন্তে ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততা পায় অটোরিকশা চালক আব্দুর রাজ্জাকের। পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে ওই মামলায়। পরে আব্দুর রাজ্জাক আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও নাচোল থানার এসআই দেওয়ান আলমগীর হোসেন এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, ঘটনার পর (২৮ সেপ্টেম্বর) আব্দুর রশিদ একটি অভিযোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে হত্যার কথা বলা নেই। শুধু বলা হয়েছিল তার ভাইকে জখম অবস্থায় পেয়েছে তারা। এরপর বারবার তাকে বলা হয়েছিল এজাহার দিয়ে যেতে। কিন্তু সে এজাহার দিতে আসেনি। পরে ১১ অক্টোবর আব্দুল হান্নান মারা যাওয়ার পর হত্যা মামলার এজাহার দেন। এজাহারনামীয় একজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়। পরে মামলার তদন্তে গিয়ে অটোরিকশা চালকের সম্পৃক্ত পায় পুলিশ। পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়েছে বলেও তদন্তে উঠে আসে। পরিপ্রেক্ষিতে আব্দুর রাজ্জাককে গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করা হয়। আদালতে সে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ২য় আদালতের বিচারক ঈশিতা শবনম তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন। এসআই দেওয়ান আলমগীর হোসেন জানান, এখনও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া গেলে বিষয়টি খোলাসা হয়ে যাবে।