ই-পেপার
সর্বশেষ সংবাদ :

মায়ের কোল থেকে ছিঁটকে বাসের চাকায় পৃষ্ট হয়ে শিশু নিহত : নির্মাণের এক যুগেও চালু হয়নি নওদাপাড়া টার্মিনাল

স্টাফ রিপোর্টার: শিশুটির নাম মারিয়া আক্তার যুঁথি (৭)। মঙ্গলবার দুপুরে নানা’র ব্যাটারি চালিত অটোরিকশায় চড়ে মেহেরচণ্ডীর দিক থেকে এসে ভদ্রামোড়ের গোল চত্বর রিকশায় পার হচ্ছিলেন। যুঁথি তার মায়ের কোলে বসে ছিলো। রিকশার যাত্রী ছিলো আরো একজন। এসময় নগরীর তালাইমারীর দিক থেকে ছেড়ে আসা একটি বাস ওই রিকশার পেছনে ধাক্কা দেয়। এতে মায়ের কোল থেকে যুঁথি ছিঁটকে পরে সড়কে পড়ে যায়। রিকশাকে ধাক্কা দেয়া বাসটির চাকা যুঁথির শরীরের উপর দিয়ে চলে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই যুঁথির মৃত্যু হয়। নিহত যুঁথি রাজশাহী নগরীর মেহেরচণ্ডী এলাকার হাসান মোল্লার মেয়ে।
এ ঘটনায় সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতরণ হয়। সড়কের উপরে গামছা দিয়ে ঢাকা আছে যুঁথির নিথর দেহ। পাশে করে কাঁদছে মা। মানুষের মনে ক্ষোভের জন্ম নেয়। শহরের মধ্যে দিয়ে এসব দ্রুতগামী বাস চলাচলের কারণে প্রায় ঘটছে দুর্ঘটনা। প্রাণহানীর ঘটনাও ঘটছে। অথচ এমন দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য দীর্ঘদিন আগেই রাজশাহী মহানগরীর নওদাপাড়ায় নির্মান করা হয়েছে বাস টার্মিনাল। বাসগুলো যেন শহরের মধ্যে প্রবেশ না করে বাইপাস হয়ে নওদাপাড়া টার্মিনালে যায়। এতে শহরে যানজট যেমন একদিক দিয়ে কমবে অন্যদিকে দুর্ঘটনাও রোধ করা যাবে। এই কারণে ২০০৪ সালে ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নগরীর উপকন্ঠে নওদাপাড়ায় স্থাপন করা হয় কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল। ২০১১ সালে টার্মিনালটি নির্মান কাজ শেষ হয় ও হস্তান্তর করা হয়। এরপরে এক যুগের বেশি সময় হতে চলেছে। এতোদিনেও রাজশাহী মহানগরীর শিরোইল বাস টার্মিনালটি স্থানন্তর করা সম্ভব হয়নি। রাজশাহী মহানগরের ভেতর থেকে টার্মিনালটি নওদাপাড়ায় স্থানন্তর করার দাবিটি রাজশাহীবাসীর দীর্ঘদিনের। কোন এক অজ্ঞাত কারণে নওদাপাড়া টার্মিনাল নির্মানের দুই যুগ পার হলে গেলেও তা শহরের ভেতর থেকে স্থানন্তর করা সম্ভব হয়নি।
মঙ্গলবারের এই ঘটনার জেরে ক্ষুব্ধ জনতা কয়েকটি যানবাহনে ভাঙচুর চলায়। পরে এই সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। বর্তমানে ভদ্রা মোড়ের বাস কাউন্টারগুলো বন্ধ রয়েছে। সড়কের উপরে যানবাহন ভাঙ্গা কাঁচ পড়ে আছে।
এ বিষয়ে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, ওই সড়কে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। বাসটি আটক করা হয়েছে। তবে বাসের চালক পালিয়ে গেছে। এ বিষয়ে মামলা হবে। নিহতের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য রামেক হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। আইনগত ব্যবস্থাগ্রহণ শেষে মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
স্থানীয়দের কয়েক জানান, রাজশাহীর ভয়াবহ অসহনীয় যানজটের প্রধান এবং একমাত্র স্পট রেলওয়ে স্টেশনের সম্মুখভাগ। এখানে ঢাকাসহ আন্তঃজেলা বাস টার্মিনালের কারণে দিবারাত্র যানজট লেগেই থাকে। রাস্তায় দেরি করে নির্দিষ্ট সময়ে টার্মিনালে পৌঁছাতে শহরের ভেতর দিয়ে বাসগুলো ছোঁটে বুলেট গতিতে। প্রশাসন থেকে রাজনৈতিক ব্যক্তিরা সবাই বিষয়টি জানেন ও বোঝেন। তবু নেয়া হয় না কোন উদ্যোগ। এজন্য দায়ি নির্বিকার প্রশাসন এবং বাস মালিক-শ্রমিক পক্ষের অবহেলা।
ঠিক রেলস্টেশনের প্রবেশমুখে অস্থায়ী বাস টার্মিনালটির অবস্থান। সেখান থেকে পূর্বে আন্ত:জেলা বাস টার্মিনাল পর্যন্ত এবং দক্ষিণে সিরোইল দোসর মন্ডল মোড়ের কাছাকাছি রাস্তার দু’পাশে সারি সারি দন্ডায়মান বাস। বড় বড় বাসগুলো সেখানে দাঁড়িয়ে যাত্রী নামায়। অবাদে চলাচল করে। এতে ভয়ংকর যানজটের সৃষ্টি হয়। রাজশাহীবাসির তীব্র ক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মঙ্গলবার দুর্ঘটনার পরে প্রশাসন ও রাজশাহীর রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের উপরে ক্ষোভ ঝাড়েছে অনেকেই। ঘটনাস্থালে উপস্থিত আমজাদ হোসেন নামে এক বেসরকারি চাকুরিজীবী বলেন, এ ঘটনার দায়ি তাদেরও যারা ক্ষমতায় থাকার পরেও টার্মিনালটি নওদাপাড়ায় নিয়ে যেতে পারেননি। তারা শুধু ভোটের আশা করেন। মানুষের সেবা তাদের কাছে কোন মূল্য রাখে না।
রফিক নামে এক ব্যক্তি বলেন, এমন কি বড় সমস্যা লুকিয়ে আছে যে নওদাপাড়ায় বাস টার্মিনালটি নির্মানের পরে সেখানে বাসগুলোকে নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না? শহরের মধ্যে বাস টার্মিনাল নগরবাসীর জন্য হুমকি। প্রায় দিনই ঘটছে দুর্ঘটনা। যারা এ কাজটি করতে পারতেন বা এখনো পারবেন তাদের সন্তান যদি এভাবে মারা যেত তাহলে অনুধাবন করতে পারতেন।
জোবাইদা নামে এক ছাত্রী ক্ষোভ ঝেড়ে বলেন, টার্মিনালটি নওদাপাড়া নিয়ে যাওয়া জরুরি। এটি সাধারণ নগরবাসীর জীবনের নিরাপত্তার বিষয়। এসব জনকল্যাণ কাজগুলো কেউ করতে চায় না অজানা স্বার্থে। তারা শুধু কাঙ্গালি ভোজকেই জনকল্যাণমুলক কাজ মনে করে। ২০০৪ সালে ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নগরীর উপকন্ঠে নওদাপাড়ায় স্থাপন করা হয় কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল। ২০১১ সালের জুন মাসে পরিবহণ মালিকদের কাছে টার্মিনালটি হস্তান্তর করে আরডিএ। কিন্তু এক যুগেরও বেশি সময়ের মধ্যে বেশ কয়েকবার প্রশাসন, মালিক-শ্রমিকসহ সংশ্লিষ্টরা যৌথ সভা করে সিদ্ধান্ত নেয়ার পর আজও তার বাস্তবায়ন হয়নি। এমনকি ২০২২ সালের পহেলা সেপ্টেম্বরে জেলা প্রশাসন, আরডিএ, আরএমপি, সড়ক পরিবহণ গ্রুপ, জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়ন, জেলা ট্রাক ও কাভার্ড মালিক সমিতির যৌথ সভায় একমত হয়ে চূড়ান্তভাবে সিদ্ধান্ত নেয় যে, ওই বছর পহেলা নভেম্বর থেকে সবাই নওদাপাড়ায় কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে চলে যাবে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে আজো তারা সেখানে যায়নি। পরবর্তীতে বাস চলাচল আরো সহজ করতে রাসিক ভদ্রা মোড় রেলক্রসিং থেকে পদ্মা আবাসিক- পারিজাত লেক হয়ে নওদাপাড়া বাস টার্মিনাল পর্যন্ত প্রায় ৭০ কোটি ব্যয়ে ৪ লেন সড়ক এবং আলো ঝলমল করতে রাস্তার দুপাশে আরো কয়েক কোটি টাকার সড়ক বাতি লাগানো হয়েছে ২০২২ সালে। কিন্তু কোন কিছুই কাজে আসেনি। শিরোইল বাস টার্মিনালটি আগের স্থানেই থেকে গেছে। প্রাণহানী সে তো চলতেই আছে।


প্রকাশিত: অক্টোবর ৩০, ২০২৪ | সময়: ৫:২১ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ

আরও খবর