সোমবার, ৪ঠা নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৯শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ।
নুরুজ্জামান,বাঘা:
আমাদের শিক্ষাঙ্গন, শিক্ষা ব্যবস্থা ,পড়া-লেখার মান এবং নীতি নৈতিকতা-সহ ছাত্র রাজনীতি নিয়ে চরম উদ্বেগ ও উৎকন্ঠার মধ্যে রয়েছেন অভিভাবক মহল-সহ সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ । তাঁরা বলছেন, দেশে যুগ-যুগ ধরে ছাত্রদের মাধ্যমে চলে আসছে ছাত্র রাজনীতি। এতে কোন বাধা নিষেধ নেই । এ জন্য বিগত দিন গুলোয় কাওকে পাশের চিন্তা করতে হয়নি। কিংবা পরীক্ষার ফলাফল বিপর্যয়ের জন্য রাস্তায় মিছিল করতে হয়নি। যা এখন হচ্ছে। এটি জাতির জন্য এক ধরণের লজ্জা এবং হাস্যজ্জলও বটে। আমরা চাই, শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার সুষ্ট পরিবেশ ফিরে আসুক।
দেশের শিক্ষাবিদরা বলেন, ছাত্রদের মৌলিক কাজ হলো লেখাপড়া করা। স্কুল জীবন শেষ করে সর্বোচ্চ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানার্জনের জন্য তাদের পদার্পণ। অনেক কষ্ট ও সাধনার পর ছাত্ররা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার জন্য উপস্থিত হয়। অভিভাবক মহল তাদের কষ্টার্জিত টাকা দিয়ে সন্তানদের মানুষ হওয়ার জন্য সর্বোচ্চ বিদ্যাকেন্দ্রে প্রেরণ করে। তাদের কাছে অভিভাবকের আকাশ-কুসুম আশা ও ভরসা থাকে। ছাত্ররা মনোযোগী হয়ে পড়ালেখা করবে। মানুষ হয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এসে দেশ-জাতি-সমাজ ও পরিবারের পাশে দাঁড়াবে । কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে আদৌও কি সেটি বাস্তবায়ন হচ্ছে ! আর যদি হয়েও থাকে তার শতকারা হার কত ?
তাঁদের মতে, ছাত্ররা গণতন্ত্র চর্চার জন্য ছাত্র রাজনীতি করবে, সেখানে কারও কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। মূল কার্যক্রম হলো -তাদের শিক্ষা সংস্কৃতি, লেখা-পড়া, খেলা-ধুলা ও মানবিক গুণাবলি অর্জন করা। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ও টার্গেট হলো একজন প্রকৃত মানবতাবাদী মানুষ হিসেবে নিজেকে তৈরি করা। যাতে করে তারা দেশ ও জাতির কল্যানে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারে।
মহাজ্ঞানী সক্রেটিসের মতানুসারে, মূল্যবান পোশাক-পরিচ্ছেদ বাইরের আবরণ মাত্র। মানুষের সত্যিকার সৌন্দর্য হচ্ছে, হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত ও পরিশুদ্ধ জ্ঞান। তিনি বলে ছিলেন, ‘জ্ঞানই সর্বোত্তম গুণ, ‘জ্ঞানই শক্তি’। শিক্ষা ও জ্ঞানের নিগূঢ় বিভাজন গর্বিত উপলব্ধিতে আনা না হলে প্রত্যয় দুটির ব্যাখ্যা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। প্রকৃত অর্থে জ্ঞান হলো শিক্ষার পরিশীলিত-পরিমার্জিত অনুধাবন। যে শিক্ষা অন্যের কষ্টে বা অন্য-হৃদয়ের রক্তক্ষরণ নিজের বিবেককে তাড়িত ও বোধকে বেদনাকাতর করে না, সে শিক্ষা কখনো জ্ঞানে রূপান্তরিত হয় না।
জ্ঞানের আরেক মহান সাধক এরিস্টটল সম্পর্কে মহাবীর আলেকজান্ডার বলে ছিলেন, ‘আমার জীবনের জন্য হয়তো আমি আমার জন্মদাতা পিতার কাছে ঋণী; কিন্তু আমাকে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য সত্যিকার মানুষ করে গড়ে তুলেছেন আমার শিক্ষাগুরু এরিস্টটল’। বিশ্বখ্যাত বরেণ্য জ্ঞানসাধক-সহ প্রায় সব মনীষীর জীবন প্রবাহের পথ পরিক্রমায় শিক্ষাই ছিল অতীন্দ্রিয় পাথেয়। ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড’ এ প্রচলিত প্রবাদ বাক্য শুধু বাচনিক প্রকরণে নয়, প্রয়োগিক বিবেচনায় সর্বকালেই সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ বাহন হিসাবে বিবেচ্য বলে তাঁরা মনে করেন। অথচ আমরা কি লক্ষ্য করছি, বিভিন্ন ইস্যুতে ছাত্ররা মিছিল নিয়ে রাস্তায় নামছে। অন্যদের দ্বারা ব্যবহার হচ্ছে। যা পিতা-মাতার কাম্য নয়।
অন্য দিকে শিক্ষার্থীরা আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক ও তথ্য প্রযুক্তি-মনন-সৃজনশীল জ্ঞানের উন্মেষই ‘মানবপুঁজি’বা সমৃদ্ধ মানবসম্পদ উৎপাদনে সুষ্ঠু ভূমিকা পালন করতে পারে বলে মন্তব্য করেন অনেকে। তাঁদের মতে, মেধাবী শিক্ষার্থী এবং রাষ্ট্রের জন্য মানবসম্পদ-সমৃদ্ধ উন্নততর পরিবেশ তৈরিতে উৎকৃষ্ট জ্ঞানসৃজন ও বিতরণে ব্যত্যয় ঘটলে জাতিকে ভবিষ্যতে কঠিন মূল্য দিতে হবে। অন্ধকারের পথ নির্ণয় ও প্রদর্শনে অপকৌশল, ছলচাতুরী, প্রতারণা, জালিয়াতি, অনৈতিক অর্থ-বিনিময়ে প্ররোচিত ঘৃণ্য ব্যক্তিদের শুধু স্বীয় বিবেকের আদালতে নয়, দেশবাসীর প্রচণ্ড ক্ষোভ-নিন্দা-ঘৃণা-আক্রোশের কাঠ গড়ায় দাঁড়ানোর দৃষ্টান্ত ইতোমধ্যেই সুস্পষ্ট হয়েছে। ছাত্ররা বিভিন্ন দাবি নিয়ে কখনো-কখনো রাস্তায় মিছিল করছে, অনেকে গুলি খেয়ে লাশ হয়েছে। আবার অনেকেই শিক্ষকদের লাঞ্চিত করছে। সর্বশেষ পরীক্ষার রেজাল্ট(এইসএসসি) পাশের জন্য রাস্তায় মিছিল করতে এসে পুলিশের হাতে আটক হয়েছে অনেকে।কিন্তু আমরা এমনটি প্রত্যাশা করিনা।
অপর দিকে সবচেয়ে বাজে ভাবে যে বিষয়টি পরিলক্ষিত হচ্ছে, সেটি হলো-আমাদের দেশে শিক্ষার্থীদের চলাফেরা ও নৈতিক শিক্ষার ঘাটতি থাকায় চরম বিব্রত বোধ করছেন সড়কে চলাচলরত অভিভাবক ও অন্যান্যরা। আধুনিকতার নামে পিতা-মাতাও অনেক সময় সন্তানদের সকলের সাথে মিশতে দিচ্ছেন। তবে অনেক অভিভাবক খোঁজ নেননা স্কুল কলেজ চলাকালীন ও ছুটির পর কোথায় থেকে সন্তানরা ঘরে ফিরছে। এদিক থেকে শহরে চলাচলরত রিক্সায় হুট উঠিয়ে এবং পার্ক গুলোতে ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় কি হচ্ছে সে কথা না-হয় বাদই দিলাম। তার পাশা-পাশি চলছে রাজনীতি। এই রাজনীতির সাথে জড়িয়ে রয়েছে অনৈতিক ভাবে অর্থ উপার্জন। ফলে এক শ্রেনীর শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন দাবি আদায়ের নামে রাস্তায় নেমে রক্তাক্ত হয়ে ঘরে ফিরছে।
একজন মোবাইল বিশেষজ্ঞ জানান, বর্তমান ইন্টারনেটের যুগে পরিবারের সাথে সময় দেয়ার চেয়ে বন্ধুদের সাথে সময় দিতে মোবাইলে সময় পার করছে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরা। ফলে ক্লাস সেভেনের পরেই অনেক শিক্ষার্থীদের হাতে দেখা মিলছে মোবাইল ফোন। সেখানেই যোগাযোগ করে দলবেধে ঘুরে বেড়ানো ছাড়াও অনেক সময় অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। এর ফলে পড়া লেখায় ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে তারা। যার ব্যত্বয় ঘটেছে সম্প্রতি প্রকাশিত এইস.এস-সির ফল প্রকাশে।
অনুসন্ধ্যানে জানা গেছে, উন্নত বিশ্বে উন্নয়নের পেছনে সব চেয়ে বেশি বিনিয়োগ হচ্ছে শিক্ষাখাতে। যাতে শিক্ষার আধুনিক ও যুগোপযোগী পাঠ্যক্রম, জ্ঞানসৃজনে সমৃদ্ধ গবেষণা, মেধাসম্পন্ন যোগ্যতর শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার যথার্থ নৈর্ব্যত্তিক মূল্যায়ন ব্যতীত গুণগত শিক্ষার বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিটি স্তর; প্রাথমিক-মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক-স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর-সহ অধিকতর উচ্চশিক্ষায় প্রতিভা-দীপ্ত ব্যক্তিদের প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের অনুশীলন নির্ভর উৎকর্ষ ফলাফলই নির্ধারণ করতে পারে গুণগত শিক্ষার মানদণ্ড।
সার্বিক বিষয়ে শিক্ষার্থী অভিভাবকরা বলেন,দেশের বর্তমান পরিস্থিতি পুরো বিশ্ববাসীকে জার্গত করেছে। আমরা এমনটি প্রত্যশা করিনি। আমাদের চাওয়া, একটি সুন্দর-স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র । আমরা চাই, সমগ্র দেশে জীবনযাত্রা দ্রুততর সময়ে স্বাভাবিক হয়ে এলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সচল রাখা সবচেয়ে বেশি জরুরি। তাঁরা শিক্ষার্থীদের সম্ভাব্য ক্ষতি পুষিয়ে নিতে প্রয়োজনে সময় বাড়িয়ে অতিরিক্ত ক্লাস-পরীক্ষা নেওয়ার প্রয়াস গ্রহণ করা যেতে পারে বলেও মন্তব্য করেন।