বাঘায় বাড়ছে বাল্যবিয়ে

নুরুজ্জামান, বাঘা: রাজশাহীর বাঘায় আশংকাজনক হারে বেড়েছে বাল্য বিয়ে। এসব বিয়েতে কখনো পিতা-মাতার সম্মতিতে চলছে আনুষ্ঠানিকতা ও ভুরিভোজ। আবার কখনো-কখনো পরিবারের সম্মতি না থাকায়, অপ্রাপ্ত বয়সের ছেলে-মেয়েরা বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করছে। এক্ষেত্রে মেয়ের চেয়ে-ছেলের বাবার অবস্থা দুর্বল হলেই দায়ের করা হচ্ছে অপহরণ মামলা। এসব বিষয় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সমাজের অভিজ্ঞ মহল ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা।
তাদের মতে, প্রশাসনের নজরদারি কমে যাওয়ায় বাল্য বিয়ের প্রবনতা দিন-দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক পরিসংখ্যানে দেখো গেছে, গত ৬ মাসে উপজেলার ৭ টি ইউনিয়ন এবং ২ টি পৌরসভা মিলে প্রায় দেড় শতাধিক বাল্য বিয়ের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে চকরাজাপুর ইউনিয়নে বাল্য বিয়ের শিকার হয়েছে ৪০ জন শিক্ষার্থী। এর প্রধান কারণ, অল্প বয়সে পালিয়ে বিয়ে করা, দারিদ্রতা এবং বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক পরকীয়া।
সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বি.বি.এস)এর জরিপ এবং বাঘা সদরে অবস্থিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্রাক (এনজিও) এর দেয়া তথ্য-প্রতিবেদনে এসব চিত্র উঠে এসেছে।
এক পরিসংখ্যান বলছে, দেশে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার ২০২১ সাল পর্যন্ত ছিল ১০ শতাংশ। পরবর্তী কোভিড (করোনা) প্রাদুর্ভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ওই দুই বছর এই বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার দাড়ায় প্রায় ২৭ শতাংশ। যা এখন এসে ঠেকেছে এলাকা ভেদে ১৫ থেকে ২০ এর মধ্যে।
লোকজন বলছেন, স্থানীয় প্রশাসন বিভিন্ন সভা-সেমিনারে বড়-বড় বক্তৃতা করলেও কার্যক্ষেত্রে তাদের ভুমিকা নিরব। এ কারণে অসংখ্য শিক্ষার্থী মাধ্যমিকের গন্ডি পার করতে পারছে না। তাদের মতে, যারা এই বাল্য বিয়ের শিকার হচ্ছে তাদের পড়া-লেখা ষষ্ট থেকে নবম শ্রেণির মধ্যে।
তারা অভিযোগ করেন, বাল্য বিয়ে প্রতিরোধের জন্য সরকারি ভাবে উপজেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরকে দায়িত্ব অর্পন করা হলেও তাদের কাছে এ বিষয়ে কোন পরিসংখ্যান নেই।
খোজ নিয়ে জানা গেছে, বাঘায় মাধ্যমিক পর্যায়ে ৫২ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীদের গোপনে বাল্য বিয়ে দেয়া সহ পালিয়ে বিয়ে করার হিড়িক পড়েছে। বিশেষ করে উপজেলার সীমান্তবর্তী দুর্গম পদ্মার চরাঞ্চল নিয়ে গঠিত চকরাজাপুর ইউনিয়নে এর ব্যবকতা বেড়েছে সব চেয়ে বেশি। অপরদিকে সমতল এলাকার হেলালপুর, তেথুলিয়া, চন্ডিপুর, মনিগ্রাম, তুলশীপুর, বাউসা, পীরগাছা, খায়ের হাট ও মীরগঞ্জ এলাকায় বাল্য বিয়ে রেকর্ড ভঙ্গ করেছে।
উপজেলার হেলালপুর এমএইচ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল খালেক বলেন, তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে গত এক বছরে সপ্তম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত মোট ২০ শিক্ষর্থীর বাল্য বিয়ে দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে তিনি চেষ্টা চালিয়ে উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে দুটি বিয়ে বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছেন। তার মতে, দেশ ব্যাপি নারী এবং শিশুদের প্রতি যে সামাজিক নির্যাতন চলছে এর কয়েকটি কুফলের মধ্যে বাল্য বিয়ে অন্যতম।
এদিকে চরাঞ্চলের শিক্ষক গোলাম মোস্তফা ও লাইলী বেগম জানান, সরকার শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যাপক সুযোগ-সুবিধা দেয়ার পরেও গোপনে বাল্য বিয়ে হচ্ছে। এটি কোন ভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না। তারা আক্ষেপ করে বলেন, গত ৬ মাসে চরাঞ্চলের ২ টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ৪০ জন শিক্ষার্থী বাল্য বিয়ের শিকার হয়েছে।
বাঘা উপজেলার একটি বে-সরকারি প্রতিষ্ঠান ব্রাক বর্তমানে কাজ করছে পারিবারিক সহিংসতা, বাল্য বিয়ে প্রতিরোধ ও দাম্পত্য কলহ নিয়ে। তাদের জরিপে দেখা গেছে, গত এক বছরে শালিশী বৈঠকের মাধ্যমে প্রায় চার শতাধিক পারিবারিক কলহ নিরসন করেছেন তারা। একই সাথে সকল দেনা-পাওনা মিটিয়ে তিন শতাধিক ছেলে-মেয়ের বিবাহ বিচ্ছেদ করিছেন। এ সকল বিচ্ছেদের প্রধান কারণ বাল্যবিয়ে, পরকিয়া, পারিবারিক কলহ এবং দারিদ্রতা।
সার্বিক বিষয়ে বাঘা উপজেলা নির্বাহী অফিসার তরিকুল ইসলাম বলেন, একজন শিশুর পেট থেকে আরেকজন শিশুর জন্ম হবে এটা আমাদের কাম্য নয়। সরকারি ভাবে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে দিতে বারণ এটা সকলের জানা। তার পরও অতি গোপনে শুধু বাঘার চরাঞ্চল নয়, দেশের বিভিন্ন এলাকাতে এর কম-বেশি প্রভাব রয়েছে। আর এসব কারণে অকালে অনেক সংসার ভেঙ্গেও যাচ্ছে। এজন্য অশিক্ষা, কুশিক্ষা, দারিদ্রতা আর সামাজিক অবক্ষয়ের কারণ অন্যতম বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি আরো বলেন, এটি প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজন জনসচেতনা। তিনি এ বিষয়ে সুশীল সমাজ, জনপ্রতিনিধি, এলাকার অভিজ্ঞ মহল, ইমাম এবং শিকক্ষদের বাল্য বিয়ের কুফল সম্পর্কে বেশি-বেশি করে বক্তব্য উপস্থাপনের আহবান জানান। একই সাথে কোন এলাকায় বাল্য বিয়ে হচ্ছে, এমনটি খবর পেলে তিনি দ্রুত আইনী ব্যবস্থা নিবেন বলেও উল্লেখ করেন।


প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২৪ | সময়: ৭:০৫ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ