রবিবার, ২০শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৭ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ।
জুল ইকরাম ফেরদৌস: রাজশাহীর কোল ঘেঁষে বয়ে গেছে পদ্মা নদী। মহানগরীর বেড়পাড়া থেকে তালাইমারী পর্যন্ত প্রায় ৭ কিলোমিটার জুড়ে আছে পদ্মা পাড়। এ পাড়ের অনেকাংশই দখল হয়ে গেছে। যে যার মতো করে দখল করে রেস্টুরেন্ট, বাড়ি, খেলনার দোকানসহ নানা ধরনের দোকানপাট ও বিনোদনকেন্দ্র গড়ে তুলেছেন। অন্তত ৬০০ দখলদার পদ্মা নদীর পাড় এবং নদীর ভেতরের অংশও ইচ্ছেমতো ব্যবহার করছেন। নদীর মধ্যে ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে রীতিমতো রাস্তা। দখল হয়েছে শহর রক্ষা বাঁধও। এতে একদিকে যেমন পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে অন্যদিকে নদী হারাচ্ছে নাব্যতা।
রবিবার জীবন্ত সত্তা পদ্মা নদীসহ দেশের সকল নদ-নদীর সুরক্ষায় দেশের সকল (শাখা ও উপ নদ-নদীসহ) নদ-নদীগুলোকে দখল-দূষণমুক্ত করে নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে নদ-নদীগুলোর গতিপথ অপরিবর্তিত রেখে যথাযথভাবে ‘ক্যাপিট্যাল ড্রেজিং’ করে দেশের অভ্যান্তরীন ও আন্তর্জাতিক ‘নৌ পথ’ চালুর দাবি সহ ১০ দফা দাবি জানিয়েছেন তরুণরা।
‘তারুণ্যের জয় হবে নিশ্চয়ই’ এ প্রত্যয়ে এগিয়ে চলা বরেন্দ্র অঞ্চলের উন্নয়ন গবেষণাধর্মী স্বেচ্ছাসেবী ও যুব সংগঠন ‘ইয়ুথ এ্যাকশন ফর সোস্যাল চেঞ্জ-ইয়্যাস’র পক্ষ থেকে এসব দাবি জানানো হয়। দুুপুর ১২টায় রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনার ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীরকে এ বিষয়ে একটি স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। স্মারকলিপির অনুলিপি রাজশাহীর জেলা প্রশাসককে ও প্রদান করেন তারা। একই দাবি সম্বলিত পৃথক স্বারকলিপি জিইপি রেজিস্ট্রি ডাক যোগে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়’র উপদেষ্টা সৈয়দা রেজয়ানা হাসান এবং প্রধান উপদেষ্টার অবগতির জন্য প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সচিব, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে প্রেরণ করা হয়েছে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, নগরীর আলুপট্টি এলাকায় পদ্মা নদীর উত্তর পারের তীরের নিচে ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে বেশকছিু দোকানপাট। পাশেই ভরাটকৃত স্থানে আরও কয়েকজন ব্যক্তি গড়ে তুলেছেন ফাস্টফুডের দোকানপাট। নগরীর পঞ্চবটি এলাকায় শহর রক্ষা বাঁধের নিচে গড়ে উঠেছে একাধিক বাড়ি। নগরীর বড়কুঠি এলাকায় শহর রক্ষা বাঁধের নিচে বিশালাকার জায়গা ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে কয়েকটি রেস্টুরেন্ট ও ফাস্টফুডের দোকানপাট। এখানে প্রতিদিন গড়ে অন্তত ৫০টি দোকান বসে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ফাস্টফুড, আঁচার, খেলনার দোকান ইত্যাদি। যে যেমন করে পারছে নদীর পাড় তেমনভাবে দখল করে বসতি বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে।
নগরীর বেড়পাড়া থেকে তালাইমারী পর্যন্ত প্রায় ৭ কিলোমিটার জুড়ে চলছে দখল বাণিজ্য। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ি, অন্তত ৬০০ জন দখলদার পদ্মা নদীর পাড় এবং নদীর ভিতরের অংশও ইচ্ছেমতো ব্যবহার করছেন। নদীর মধ্যে ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে রীতিমতো রাস্তা। দখল হয়েছে শহর রক্ষা বাঁধও। এমনকি নদীর গতিপথও পরিবর্তন হচ্ছে বলে দাবি করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
ইয়্যাসের পক্ষ থেকে দেয়া স্বারকলিপিতে বলা হয় যে, বরেন্দ্র অঞ্চলের খরা মোকাবিলা করতে নদ-নদী, পুকুর-ডোবা, জলাশয়-জলাধার-জলাভূমি দখল-দূষণ ও ভরাট বন্ধ এবং খনন ও পূণরুদ্ধার এবং সংরক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। নদী উন্নয়নে রয়েছে সব উন্নয়নের মূলে। বিশেষকরে টেকসই ও অভিঘাত সহনশীল বৈচিত্র্যপূর্ণ, বৈষম্যহীন নগর ও পরিবেশ উন্নয়নের চাবি কাঠি। সে জন্য নদ-নদী ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণই সার্বিক উন্নয়নের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।
বরেন্দ্র অঞ্চলের নদী বাঁচলে বাঁচবে এই জনপদ। বাঁচবে এই অঞ্চলের জীববৈচিত্র্যসহ সুরক্ষা হবে এই অঞ্চলের বাস্তুসংস্থান। রাজশাহী শহরের বিভিন্ন দূষিত কঠিন, তরল, বিষাক্ত প্লাস্টিক ও মেডিকেল বর্জ্য পদ্মা, শিব-বারনই নদীসহ আশেপাশের জলাধারগুলোতে পড়ার কারণে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এখানকার জীববৈচিত্র্য এবং বাস্তুতন্ত্র। নষ্ট হচ্ছে কৃষি জমি। অন্যদিকে নদ-নদী, পুকুর-ডোবা, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, জলাশয়-জলাধার গুলোয় পানি না থাকার কারনে বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রান্তিক মানুষসহ আদিবাসীরা পানির অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। নদ-নদী, জলাধারগুলোসহ পানির উৎসগুলো নষ্ট করে এখন পানি বিক্রির প্রকল্প তৈরি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে। পানির জন্য বরেন্দ্র অঞ্চলের সমাজগুলোতে দিনে দিনে সহিংসতা ও অপ্রীতিকর ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষের জীবন জীবিকা সংকটে পড়েছে। পদ্মানদীর কোল ঘেঁষে গড়ে উঠা জনপ্রিয় একটি স্থান ‘সীমলা পার্ক’। যা পূর্বে ঐতিহাসিক বাবলা বন হিসেবে পরিচিত ছিল। সেই স্থানে ছিল প্রচুর পাখির বসবাস। এমন একটি প্রাণবৈচিত্র্য সমৃদ্ধ স্থানটি আজ দখল হয়ে গেছে। সেখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশকে ধ্বংস করে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে কংক্রিটের অবকাঠামো। সেখানে থাকা সবুজ বৃক্ষ যেখানে পাখিদের বাসস্থান ছিল সেগুলোকে কেটে ফেলা হয়েছে। পুরো এলাকাকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। শুধু সিমলা পার্ক এলাকাই নয় এভাবে রাজশাহীর দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে বয়ে চলা জীবন্ত সত্তা পদ্মার সমগ্র পাড়ে দখলদারিত্ব বেড়েই চলেছে। এই দখলদারিত্বে পিছিয়ে নেই কেউ-ই, খোদ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) পদ্মাপাড়ের একটি বিশাল স্থানে গড়ে তুলেছে বাণিজিক প্রতিষ্ঠান সীমান্ত নোঙর আর সীমান্তে অবকাশ। পদ্মার পাড়ে তারা কংক্রিট দিয়ে গড়ে তুলেছে স্থায়ী স্থাপনা। নদী দূষণের বিষয়টি তুলে ধরে স্বারকলিপিতে বলা হয় যে, যথাযথ কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না করেই নগরীর বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ময়লা-আর্বজনা, দূষিত পানি এমনকি মেডিকেল বর্জ্য সরাসরি পদ্মা নদীতে ফেলা হচ্ছে। এতে নদীর প্রাকৃতিক পরিবেশ ও পানির গুনাগুন নষ্ট হচ্ছে। নদী দূষিত হচ্ছে। যার ফলে পদ্মা নদীর পানি প্রাকৃতিক ভারসাম্য হারাচ্ছে। পদ্মা নদীজুড়ে ভেসে বেড়াচ্ছে একবার ব্যবহার্য্য (সিঙ্গেল ইউজ) প্লাস্টিক, পলিথিন (কাপ, গ্লাস, প্লেট, চামচ, চিপসের প্যাকেট ইত্যাদি)। যা পদ্মা নদীকে মারাত্মক হুমকির মুখে ফেলছে।
রাজশাহী জেলার সুশাসনের জন্য নাগরিক(সুজন) এর সভাপতি আহাম্মেদ সফিউদ্দীন বলেন, ‘এক সময়ে আমাদের রাজশাহীর পদ্মায় ইলিশ পাওয়া যেত। রাজশাহী শহরের সঙ্গে যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যম ছিল স্টিমার। কিন্তু নদী এখন মৃতপ্রায়। দখলে দখলে ধুঁকছে পদ্মা। যৌবন হারাচ্ছে পদ্মা। শুধুমাত্র বর্ষাকাল ছাড়া নদীর প্রায় অধিকাংশ চরে পরিণত হয়। নদী রক্ষার জন্য কোনো ব্যবস্থা কোনো সরকারই নেই না। ফলে দখলদাররা আরও বেপরোয়া। আর দখলের কারণে নদী বদালচ্ছে গতিপথ। ভাঙছে দুই পাড়। অনেক মানুষ নিঃস্ব হচ্ছে। আর আমরা সামান্য স্বার্থের জন্য নদীকে ধ্বংস করছি।’
তিনি বলেন, ‘পদ্মার পাড়, ও ভিতরের চর দখলের কারণে পদ্মা তাঁর স্বাভাবিক সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলেছে। পদ্মাকে রক্ষা করতে হবে আমাদের। এমনিতেই প্রতিবেশী দেশ ভারত উজানে ফারাক্কা বাঁধ করে পদ্মাকে মৃতপ্রায় করে দিয়েছে। সেখানে আমরা যদি আবার নানা প্রতিবন্ধিকতা তৈরী করি, তাহলে পদ্মা আর নদী থাকবে না।’
নদী দখল বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নাসরিন রাজিয়া আখতার জাহান বলেন, রাজশাহীর বেড়পাড়া থেকে তালাইমারী পর্যন্ত প্রায় ৭ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নদী দখল করা হয়েছে। শতশত একর জমি দখলে ৬০০ দখলদারের তালিকা আমরা করেছি। এদের উচ্ছেদের জন্য জেলা প্রশাসককে চিঠিও দেয়া হয়েছে। কিন্তু জেলা প্রশাসকের দপ্তর থেকে কোনো আশানুরূপ পদক্ষেপ দেখা যায়নি।
জানতে চাইলে এ বিষয়ে রাজশাহী সিটি করপোরেশন প্রশাসন ও রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার দেওয়ান মো হুমায়ূন কবির বলেন, ‘নদী দখলের বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করছি। নদী দখল হলে আমাদেরই ক্ষতি হবে। কাজেই দখলকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে দ্রুতই। যারা দখল করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন, তাদের আগে সময় দেয়া হবে। তার পরে কথা না শুনলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
*