শুক্রবার, ৬ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২১শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ।
স্টাফ রিপোর্টার: গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর রাজশাহীতে আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা গা-ঢাকা দিয়েছেন। রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র থেকে শুরু করে জেলার ৬টি আসনের সাবেক এমপি, জেলা, মহানগর, উপজেলার নেতৃবৃন্দ, ১৩টি পৌরসভার সাবেক মেয়র (মুণ্ডুমালা পৌরসভা ছাড়া), ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ডের সব পর্যায়ের নেতাই আত্মগোপনে চলে গেছেন। রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) বেশিরভাগ কাউন্সিলর, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান, বিভিন্ন পৌরসভার কাউন্সিলররাও এলাকা ছেড়ে পালিয়েছেন। অধিকাংশ নেতাদের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাট করা হয়েছে। তার উপরে তাদের উপরে একের পর এক দেয়া হচ্ছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের হত্যা ও হামলার মামলা। এদের বেশিরভাগই দেশের ভেতরে থাকলেও আসছেন না প্রকাশ্যে।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলির সদস্য ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন উত্তরাঞ্চলে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা তিনি। ৫ আগস্ট পর্যন্ত তাকে রাজপথে দেখা গিয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে। শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছেড়ে যাওয়ার সংবাদ আসলে তিনি গা ঢাকা দেন স্বপরিবারে। ওই দিন বিকাল সাড়ে ৪টার পর লিটনের উপশহর এলাকার তিন নম্বর সেক্টরের বাসভবনটি গানপাউডার দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। লুট করা হয় বাড়ির এসি, ফ্রিজ, সোফা, খাট, চেয়ার-টেবিলসহ সব পণ্য। এছাড়া বিক্ষুব্ধ আন্দোলনকারীরা সিটি করপোরেশন পুড়িয়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। লুট করা হয় সব পণ্য। সেই থেকে তার অবস্থান কেউ জানে না। শোনা যায়, লিটন এবং তার পরিবারের সদস্যরা ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন।
রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) আসনের সাবেক এমপি এবং জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরীও ৫ আগস্ট সন্ধ্যা পর্যন্ত মহানগরীর নিউমার্কেট এলাকায় তার ‘থিম ওমর প্লাজা’র বাসভবনে ছিলেন। ১০ তলা বিশিষ্ট এ ভবনটি রাজশাহীর অত্যাধুনিক শপিংমল। এতে রয়েছে ২৪১টি দোকান। এগুলো নির্বিচারে লুট করা হয়। মলটির ব্যবসায়ীরা বলছেন, সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে পেছনের দরজা দিয়ে এমপি ফারুক একটি গাড়িতে পালিয়ে গেছেন। এরপর থেকে তার খোঁজ নেই।
রাজশাহী-২ (সদর) আসনের সাবেক এমপি এবং রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি অধ্যক্ষ শফিকুর রহমান। ঘটনার দিন থেকে তিনিও আত্মগোপনে আছেন। রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনের সাবেক এমপি এবং জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদও আত্মগোপন করেছেন। শেখ হাসিনার পতনের দিনই তিনি রাজশাহী ছেড়েছেন। তবে পরবর্তিতে তার কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। ওই আসনের আরেক সাবেক এমপি আয়েন উদ্দিনও আত্মগোপনে আছেন।
রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনের সাবেক এমপি আবুল কালাম আজাদ এলাকায় নেই। দখল হয়ে গেছে তা লিজ নেয়া বড় বড় পুকুর। রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া-দুর্গাপুর) আসনের সাবেক এমপি ও রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াদুদ দারাও আত্মগোপনে রয়েছেন। দারা শেখ হাসিনা সরকারের পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। জানা গেছে, দারা সর্বশেষ জেলার বাঘা উপজেলায় একটি রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নেন। এরপর থেকে তার আর কোনো হদিস নেই। রাজশাহী-৬ (বাঘা-চারঘাট) আসনের সাবেক এমপি ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ৫ আগস্টের আগে থেকেই এলাকাতে নেই। তিনি ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। ৫ আগস্টের পর থেকে তার সঙ্গে নেতাকর্মীদের যোগাযোগ নেই।
এদিকে রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অনিল কুমার সরকারও রাজশাহীতে নেই। মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী কামালও আত্মগোপনে রয়েছেন। মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার, সহসভাপতি রাজশাহী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মীর ইকবাল, ডাবলুর ভাগনে সাংগঠনিক সম্পাদক মীর ইশতিয়াক লেমন, ডাবলুর ভাই মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক জেডু সরকারও পট পরিবর্তনের পরপরই রাজশাহী ছাড়েন।
রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের আরেক সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল আলম বেন্টু এলাকায় নেই। ঘটনার দিন বেন্টুর দুটি রেস্টুরেন্ট এবং রাজনৈতিক কার্যালয়ে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাট চালানো হয়। তার নয়টি ট্রাকে আগুন দেওয়া হয়। তার প্রতিবেশী দুই নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সাবেক প্যানেল মেয়র রজব আলীর একটি রেস্টুরেন্ট পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। লুট করা হয়েছে তার খামারের গরু। রজব অবশ্য ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় দর্শনা সীমান্তে বিজিবির হাতে আটক হয়েছেন। তার ভাই মহানগর যুবলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক নাহিদ আক্তার নাহানও পলাতক রয়েছেন।
এছাড়া রাজশাহী মহানগর যুবলীগের সভাপতি মনিরুজ্জামান মনির এবং সাধারণ সম্পাদক তৌরিদ আল মাসুদ রনিও এলাকা ছেড়েছেন। রনির বাড়ি এবং রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক কার্যালয়ে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করা হয়েছে। এলাকা ছাড়া রয়েছেন জেলা যুবলীগের সভাপতি মাহমুদ হাসান ফয়সাল সজল এবং সাধারণ সম্পাদক ইয়াসির আরাফাত সৈকত। মহানগর যুবলীগের সভাপতি নূর মোহাম্মদ সিয়াম এবং সাধারণ সম্পাদক ডা. সিরাজুম মবিন সবুজও রাজশাহীতে নেই। রাজশাহী সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর, উপজেলার চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র ও কাউন্সিলর, উপজেলা এবং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরাও রাজশাহী ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে গেছেন। ইতোমধ্যেই হত্যা, বিএনপির অফিস ভাঙচুরসহ বেশ কয়েকটি মামলা দায়ের করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।