সর্বশেষ সংবাদ :

আদালতে আসামিকে হেনস্তা: নিরাপত্তা নিয়ে যা বলছেন আইনজ্ঞরা

সানশাইন ডেস্ক: শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের পর গত কয়েক দিনে গ্রেফতার হয়েছেন সাবেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সেনা কর্মকর্তা, বিচারপতি, সাংবাদিকসহ অনেকে। রিমান্ডের জন্য আদালতের এজলাস কক্ষে নেওয়ার পথে বিভিন্নভাবে হেনস্তার শিকার হয়েছেন অধিকাংশ আসামি। বাদ যাননি নারীরাও। আদালতের মতো স্পর্শকাতর জায়গায় পুলিশি নিরাপত্তার মধ্যে এ ঘটনা ঘটায় বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা তৈরি হয়েছে।
বিগত সরকারের আমলেও ঢাকা এবং ঢাকার বাইরের আদালতে আসামিদের হেনস্তা করার ঘটনা ঘটেছে। এমনকি জঙ্গি ছিনতাইয়ের মতো ঘটনাও ঘটেছে আদালত প্রাঙ্গণে। তখনও নিরাপত্তার বিষয়টি আলোচনায় এসেছিল। এবারের প্রেক্ষাপটটা একটু ভিন্ন হওয়ায় আসামিদের ওপর ক্ষোভটা বেশি দেখা যাচ্ছে। যদিও আদালতের মতো জায়গায় এমনটি কোনোভাবেই কাম্য নয় বলে মনে করেন আইনজ্ঞরা।
বিষয়টি নিয়ে বুধবার (২৮ আগস্ট) কথা বলেছেন অন্তর্র্বতী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুলও। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আদালত চত্বরে যে হামলা হচ্ছে, সেটি কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটি যাতে না হয়, সে বিষয়ে বিভিন্ন কৌশল ও চিন্তা করা হচ্ছে। আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, আদালতে যাওয়ার সময়ে কখনো কাউকে আক্রমণ করা উচিত নয়, কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।
সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার দনা সীমান্ত এলাকা থেকে ২২ আগস্ট রাতে আটক হন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। পরের দিন বিকেলে তাকে সিলেটের জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তোলা হয়। টেলিভিশন চ্যানেলের ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, পুলিশের গাড়ি থেকে নামার পরই সাবেক এই বিচারপতির ওপর হামলা হয়। পুলিশের নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যেই তার মাথায় আঘাত ও তার জুতা ছুড়ে মারেন অনেকে। বর্তমানে তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
কোনো আসামির ক্ষেত্রে যদি এমন হয় যে তাকে আদালতে নেওয়া যাচ্ছে না তাহলে কিন্তু বিকল্প ব্যবস্থা আছে। এখন ডিজিটাল হাজির করা যায়। আসামি যেখানে আছেন ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিয়ে সেখানে কোর্ট বসাতে পারেন। যে কোনো হেনস্তার শিকার ব্যক্তিও প্রশ্ন তুলতে পারেন বলেন মনজিল মোরসেদ।
বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ৭১ টিভির সাংবাদিক দম্পতি শাকিল আহমেদ ও ফারাজানা রুপাকে গত ২১ আগস্ট ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে আটক করা হয়। পরে উত্তরা পূর্ব থানার একটি হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয় তাদের। ২২ আগস্ট আদালতে হাজির করার সময় ফারজানা রুপাকে পুলিশি নিরাপত্তার মধ্যেই ঘুসি মারেন একজন। তার স্বামী শাকিল আহমেদ এসময় চিৎকার করে এ ঘটনার বিচার চান।
এর আগে সাবেক মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ডা. দীপু মনিকে মোহাম্মদপুর থানার একটি হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে হাজির করা হয়। আদালত এলাকায় তার ওপর চড়াও হন একদল আইনজীবী। তার ওপর ডিম নিক্ষেপ ছাড়াও, শারীরিকভাবে লাঞ্ছনার শিকার হন তিনি।
সাবেক আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানকে আদালতে হাজির করার সময়ও তারা হেনস্তার শিকার হন। আসামিদের ঘিরে বিপুল সংখ্যক পুলিশের উপস্থিত দেখা গেলেও আক্রমণ থেকে তারা রক্ষা পাননি। আর এক্ষেত্রে অভিযোগের তীর আইনজীবীদের দিকে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন আইনজীবী বলেন, ‘বিগত সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের আদালতে হাজির করার খবর পেলেই একদল আইনজীবী আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন। হাজতখানা থেকে যখন আদালতে হাজির করা হয় তখন তারা আসামিদের ঘিরে ধরে নানা স্লোগান ও কটূক্তি করেন। হেনস্তা করেন।’
তিনি বলেন, ‘তখন বিপুল সংখ্যক পুলিশ এবং আসামিদের হেলমেট ও ভেস্ট পরানো থাকলেও তারা রক্ষা পাননি। শুধু দুজন সাবেক সামরিক কর্মকর্তা ছাড়া সবাই কোনো না কোনোভাবে শারীরিক হেনস্তার শিকার হয়েছেন। এই কজনের মধ্যে শুধু সাবেক সামরিক কর্মকর্তা জিয়াউল আহসানের পক্ষে তার বোন আইনজীবী হিসেবে আদালতে দাঁড়িয়েছিলেন। তবে তিনিও দ্রুত আদালত ত্যাগ করেন।’
সংবিধান ও পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল ১৯৪৩ (পিআরবি) ধারা ১২ অনুযায়ী, এজলাসে ওঠানোর সময় কাস্টডি বা কারাগার থেকে আনা-নেওয়ার সময় আসামিদের নিরাপত্তা বিধানে পুলিশের দায়িত্ব রয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘যখন একজন গ্রেফতার হয়ে পুলিশ কাস্টডিতে থাকেন, তখন তার সমস্ত দায়-দায়িত্ব থাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর। কারণ গ্রেফতার হয়েছেন বলে তিনি নিরাপদ থাকবেন। বাইরে অবস্থান করার সময় নিরাপত্তা না থাকলেও পুলিশ কাস্টডিতে থাকার সময় তার নিরাপত্তা দেবে পুলিশ। সেখানে কখনো ব্যতিক্রম হওয়ার সুযোগ ছিল না, আইনে কখনো নেই।’
‘কিন্তু এখন এই যে ফেনোমেনা তৈরি হয়েছে, প্রায়ই দেখা যায় কাউকে গ্রেফতারের পর আদালতে নেওয়া আনার পথে হয়তো তাদের ওপর আক্রমণ করছে। হয়তো বা তাদের ওপর কারও ক্ষোভ থাকতে পারে, কিন্তু যারা আদালতে নিচ্ছেন তাদেরই দায়িত্ব সেই প্রটেকশন দেওয়া।’
তিনি বলেন, ‘কোনো আসামির ক্ষেত্রে যদি এমন হয় যে তাকে আদালতে নেওয়া যাচ্ছে না তাহলে কিন্তু বিকল্প ব্যবস্থা আছে। এখন ডিজিটাল হাজির করা যায়। আসামি যেখানে আছেন ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিয়ে সেখানে কোর্ট বসাতে পারেন। যদি সেখানে মনে হয় কোর্টের ভেতরে ওই আসামিকে নেওয়াটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী প্রটেকশন দিতে পারবে না তখন এ ধরনের বিকল্প ব্যবস্থা নিতে পারেন। যে কোনো হেনস্তার শিকার ব্যক্তি প্রশ্নও তুলতে পারেন। নিরাপত্তা দিতে হবে, এটার কোনো বিকল্প নেই। ব্যর্থতার দায় তাদের নিতে হবে।’
এ বিষয়ে মানবাধিকারকর্মী এবং সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘যাদের আদালতে আনা হয়েছে তাদের কিল-ঘুসি মারাসহ নানাভাবে হেনস্তা করা হচ্ছে। এটা খুবই দুঃখজনক যে কোনো কোনো আইনজীবী ওইসব ঘটনায় যুক্ত। নারীদের ওপরও হামলা হয়েছে। এটা দুঃখজনক এবং এর নিন্দা জানাই।’
এই আইনজীবীর মতে, ‘এখানে পুলিশ ও বিচারব্যবস্থায় যারা আছেন তাদের আদালত এলাকায় নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে। নিরাপদ করতে হবে। আবার অভিযুক্তদের তাদের আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করতে দেওয়া হচ্ছে না। এতে তো বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়।’
আসামিদের এজলাসে নেওয়ার সময় হেনস্তা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে কি না জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল জাগো নিউজকে বলেন, ‘কোনো মামলার আসামি হিসেবে ব্যক্তিকে কোর্টে তোলার সময় হেনস্তা ও হামলা করা কারও কাছে কাম্য না। কারণ এর আগে এসব ঘটনা ঘটেছিল, তার মানে এই না, কেউ আগে ডাকাতি করেছে বলে আমাকেও করতে হবে। আমাদের কথা ও কাজে সংযমী হতে হবে।’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, ‘প্রথমত গ্রেফতার ব্যক্তি বা কাউকে আদালতে যখন নেওয়া হবে তাকে মারধর করা, ঢিল মারা, হামলা করা, গালাগালি ও ডিম নিক্ষেপ করা- এসব কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমি মনে করি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য যারাই দায়িত্ব পালন করেছেন তারা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। হেনস্তার হাত থেকে রক্ষা করতে পারেননি। যাদের গ্রেফতার করে আনা হয়েছে তাদের সঙ্গে অসম্মানজনক আচরণ করা কোনোভাবেই কাম্য নয়। সেটা গ্রেফতারের সময় হোক আর আদালতে তোলার সময় হোক।’
তিনি বলেন, ‘ধরুন একজন সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি যদি অপরাধ করে থাকেন সেটা বিচারের বিষয়। কিন্তু যাকে গ্রেফতার করা হয়েছে তার সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা, খারাপ ভাষায় কথা বলা এগুলো কোনো অবস্থায় সমর্থনযোগ্য নয়। এসব আইনের শাসনের পরিপন্থি।’ ‘রাষ্ট্র সবার জন্য সমান হবে, মানবিক হবে। আসামিদের সঙ্গে কোনো ধরনের অমানবিক আচরণ করা যাবে না। আমাদের প্রশাসন তাদের যথাযথ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেনি বলে মনে করছি। সামনের দিনগুলোতে যেন আর কোনো ধরনের হেনস্তার ঘটনা যেন না ঘটে।’
আদালতে নিরাপত্তার বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির প্রসিকিউশন বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) মো. মাহবুবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আদালতে পর্যাপ্ত পুলিশ মোতায়েন থাকে। নিরাপত্তা নিয়ে কোনো শঙ্কা নেই। শুধু তাই নয়, সেনাবাহিনীও মোতায়েন থাকে। অতিউৎসাহী লোকজনেরা ঝামেলা করার চেষ্টা করে।’


প্রকাশিত: আগস্ট ৩০, ২০২৪ | সময়: ৬:৩১ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ