ই-পেপার
সর্বশেষ সংবাদ :

চাপের বাজেটে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশা

সানশাইন ডেস্ক: মূল্যস্ফীতি, টাকার দরপতনসহ বেশ কিছু সমস্যায় কারণে সামষ্টিক অর্থনীতির নানা সূচক যখন চাপের মুখে, তখন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ঠিক করেছেন বিদায়ী অর্থবছরের চেয়ে কমিয়ে।
বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য উত্থাপিত ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার এই বাজেট প্রস্তাবে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা ধরেছেন তিনি। নির্বাচনী বছরে গতবার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরেছিল সরকার, যা পরে নামিয়ে আনা হয়েছিল ৬ দশমিক ৫ শতাংশে। কিন্তু সেই লক্ষ্যেও পৌঁছানো যায়নি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যা ব্যুরো (বিবিএস) প্রথম সাত মাসের প্রাক্কলন অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে অর্থনীতির আকার বাড়তে পারে ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ হরে। গত কয়েক বছর আওয়ামী লীগ সরকার জিডিপি প্রবৃদ্ধির উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য ধরলেও এবার কিছুটা পিছিয়ে আসার স্পষ্ট ব্যাখ্যা বাজেট বক্তৃতায় দেননি কূটনৈতিক জীবন থেকে অবসরে গিয়ে রাজনীতিতে নামা অর্থনীতির ছাত্র মাহমুদ আলী।
তিনি বলেন, “২০০৯-১০ অর্থবছর হতে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত বাংলাদেশের গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬.৭ শতাংশ। প্রবৃদ্ধির এ গতি ধরে রাখার লক্ষ্যে কৃষি ও শিল্প খাতের উৎপাদন উৎসাহিত করতে যৌক্তিক সকল সহায়তা অব্যাহত রাখা হবে। “পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো প্রকল্পসমূহের যথাযথ বাস্তবায়ন এবং রপ্তানি ও প্রবাস আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে। আশা করছি আমাদের গৃহীত এসকল নীতিকৌশলের ফলে আগামী অর্থবছরে ৬.৭৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে এবং মধ্যমেয়াদে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৭.২৫ শতাংশে পৌঁছাবে।”
অর্থনীতিবিদদের অনেকে প্রবৃদ্ধির হারকে অর্থনীতির গতিশীলতা হিসেবে মানলেও টেকসই উন্নয়নের সূচক হিসেবে মানতে নারাজ। তারপরও অর্থনীতির এই প্রপঞ্চটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে বারবার আলোচনায় এসেছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রেকর্ড ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল বাংলাদেশ। এরপর আসে মহামারী। তার মধ্যেও ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য যখন ধরেছিলেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু অর্জিত হয় ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ, যা কয়েক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন।
মহামারীর ধাক্কা সামলে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশে। দুঃসময় কাটিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেড়ে হয় ৭ দশমিক ১০ শতাংশ। এরপর ২০২২-২৩ অর্থ বছরে অর্থনীতির আকার ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্য ধরেছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল। পরে তা সংশোধন করে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশে নামানো হলেও তা অর্জন হয়নি। বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, ওই অর্থবছর শেষে স্থির মূল্যে জিডিপি বেড়েছে ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ।
মহামারীর মধ্যে বাংলাদেশে বিনিয়োগ কমে গিয়েছিল, সেটা যখন ঘুরে দাঁড়ানো শুরু করল তখনই শুরু হল ইউক্রেইন-রাশিয়া যুদ্ধ। সেই যুদ্ধ পুরো বিশ্বকে ফের টালমাটাল করে দেয়, আবার অনিশ্চয়তার কবলে পড়ে অর্থনীতি। বিশ্বের সব দেশকেই কমবেশি এর জের টানতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে গেছে, চড়ে গেছে ডলারের বিনিময় হার। তাতে পণ্যের উৎপাদন খরচও বেড়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক নিরাপত্তায় এর বড় ধরনের প্রভাব থাকবে বলে অর্থনীতিবিদরা ধারণা দিয়েছিলেন, হয়েছেও তাই।
জানুয়ারি পর্যন্ত সাত মাসের হিসাব ধরে চলতি অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির যে প্রাক্কলন করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, তাতে দেখা যাচ্ছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে স্থির মূল্যে ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির হতে পারে। অবশ্য বিশ্ব ব্যাংকের প্রাক্কলন বলছে, বিদায়ী অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে আরও কম, ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। নতুন বাজেটে চলতি মূল্যে জিডিপির আকার ধরা হয়েছে ৫৫ লাখ ৯৭ হাজার ৪১৪ কোটি টাকা। বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে এর আকার ছিল ৫০ লাখ ৪৮ হাজার ০২৭ কোটি টাকা।
মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে
আটকে রাখার কঠিন লক্ষ্য বাজেটে
সানশাইন ডেস্ক: রিজার্ভে টান আর বিশ্ববাজারের অস্থিরতাকে সঙ্গী করে সরকার যখন আইএমএফ এর ঋণের শর্ত মেনে ভর্তুকি তুলে নিয়ে ধাপে ধাপে বিদ্যুতেরদাম বাড়াচ্ছে, সেই সময়ে গড় মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে ধরে রাখার লক্ষ্য ঠিক করে নতুন অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব সংসদে উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী।
বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী মূল্যস্ফীতির এই লক্ষ্যমাত্রা প্রস্তাব করেন। তিনি বলেন, “মূল্যস্ফীতির হার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণ করা হচ্ছে এবং রাজস্বনীতিতেও সহায়ক নীতিকৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে। মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে সাধারণ মানুষকে সুরক্ষা দিতে ফ্যামিলি কার্ড, ওএমএস ইত্যাদি কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে।
“আমাদের গৃহীত এসব নীতিকৌশলের ফলে আশা করছি আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশে নেমে আসবে। একইসাথে কর রাজস্বের পরিমাণ জিডিপি’র ১০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যে প্রশাসনিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, করজাল সম্প্রসারণ এবং কর আদায় ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনার অটোমেশন এবং হিউম্যান ইন্টারফেস কমানো ইত্যাদি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে।”
বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে অর্থনীতির অন্যতম প্রধান এই সূচককে ৬ শতাংশে বেঁধে রাখার লক্ষ্য ঘোষণা করেছিলেন আওয়ামী লীগের গত মেয়াদের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। পরে তা সংশোধন করে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়। তবে সেই লক্ষ্যও পূরণ করা যায়নি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের মে পর্যন্ত সময়ে ১১ মাসের গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশে, যা বহু বছরের মধ্যে বেশি। তাতে নিম্নবিত্ত আর মধ্যবিত্তের সংসারে তেল-নুনের হিসাব মেলাতে স্বাভাবিকভাবেই প্রচণ্ড চাপ পড়ছে। এমন বাস্তবতায় গড় মূল্যস্ফীতি কী করে ৬ দশমিক ৫ শতাংশে রাখা যাবে, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় মেলেনি।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের চাপের মুখে অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফেরাতে ২০২২ সালে আইএমএফ এর ঋণের আবেদন করেছিল বাংলাদেশ। ভর্তুকি কমানোসহ নানাবিধ শর্তে দেওয়া ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের ১১৫ কোটি ৭২ লাখ ডলার দুই কিস্তিতে পেয়েছে সরকার। এর আগে ও পরে বাংলাদেশ পরামর্শ অনুযায়ী বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি কমানোসহ আর্থিক খাতের কাঠামো ও নীতি সংস্কারে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করে।
আইএমএফের সঙ্গে আলোচনার মধ্যে ২০২৩ সালের ১৮ জানুয়ারিতে সরকারের নির্বাহী আদেশে শিল্প, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বাণিজ্যিক খাতে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়। এরপর ৩১ জানুয়ারি থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয় তিন দফা, প্রতিবার গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়ে গড়ে ৫ শতাংশ করে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ে পণ্যমূল্যে।
ভর্তুকি সমন্বয়ের অংশ হিসেবে চলতি বছরের মার্চ থেকে বিদ্যুতের দাম খুচরায় ৮ দশমিক ৫ শতাংশ এবং পাইকারিতে ৫ শতাংশ দর বাড়িয়েছে সরকার। নতুন দাম অনুযায়ী, আবাসিক গ্রাহকদের মধ্যে ৫০ ইউনিট পর্যন্ত ব্যবহারকারীদের বিদ্যুতের মূল্য এখন ৪ টাকা ৬৩ পয়সা টাকা এবং ৬শ ইউনিটের বেশি ব্যবহারকারী গ্রাহকের প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ১৪ টাকা ৬১ পয়সা।
বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, বিদ্যুতের এই মূল্যবৃদ্ধির ফলে ভারিতগড়ে পাইকারিতে প্রতি ইউনিটের দর আগের ৬ টাকা ৭০ পয়সা থেকে বেড়ে ৭ টাকা ০৪ পয়সা হয়েছে। খুচরায় ৮ টাকা ২৫ পয়সা থেকে বেড়ে ৮ টাকা ৯৫ পয়সা হয়েছে। আগে ৪২২টি পণ্যের মূল্য ধরে মূল্যস্ফীতি হিসাব করত পরিসংখ্যান ব্যুরো। আইএমএফ এর পরামর্শ মেনে গত বছরের মে মাস থেকে আরও প্রায় ৩০০ পণ্যকে ‘ঝুড়িতে’ যুক্ত করা হয়।
চলতি অর্থবছরের বেশির ভাগ সময়জুড়ে মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্ক ছুঁইছুঁই ছিল, বছর শেষে তা সরকার নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে নেমে আসার আশা অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান দেখালেও তার কোনো লক্ষণ বাজারে দেখা যাচ্ছে না।
গত এক বছরের বেশি সময় ধরে মূল্যস্ফীতি গড়ে ৯ শতাংশের উপরে রয়েছে জানিয়ে অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় বলেন, “মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে কৃচ্ছ্রসাধন কর্মসূচি সীমিত পরিসরে চালু রাখা হলেও উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ হতে নিম্ন আয়ের মানুষের সুরক্ষা প্রদান কার্যক্রমের পরিধি বাড়ানো হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসৃজন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলাসহ সরকারের অগ্রাধিকার খাতসমূহে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিতকরণ এবং ভবিষ্যৎ উন্নয়ন পরিক্রমাকে প্রাধিকার দিয়েই এই অর্থবছরের বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে।”


প্রকাশিত: জুন ৭, ২০২৪ | সময়: ৫:২৮ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ

আরও খবর