মঙ্গলবার, ৮ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৩শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ।
স্টাফ রিপোর্টার : বাংলাদেশ ও ভারতের নৌ প্রটোকলের আওতায় চালু হলো বহুল কাঙ্খিত রাজশাহীর গোদাগাড়ীর সুলতানগঞ্জ পোর্ট অব কল এবং সুলতানগঞ্জ-মায়া নৌপথে পণ্যবাহী নৌযান চলাচল।
পদ্মা ও মহানন্দার মোহনায় অবস্থিত রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার সুলতানগঞ্জ অংশে সোমবার সকাল ১১ টায় সুলতানগঞ্জ নৌবন্দর এবং ভারতের মুর্শিদাবাদের মায়া নৌবন্দর পর্যন্ত পণ্যবাহী নৌযান চলাচলের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন।
রাজশাহী থেকে ভারতের মুর্শিদাবাদের ধূলিয়ান ও মায়া নৌবন্দর পর্যন্ত নৌরুটে নৌযান চালু ও রাজশাহীতে আন্তজার্তিক নৌবন্দর প্রতিষ্ঠায় গত ৫ বছর নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছিলেন রাসিক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। এটি মেয়র লিটনের একটি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। সুলতানগঞ্জ নৌবন্দর চালু ও সুলতানগঞ্জ-মায়া নৌপথে নৌযান চলাচল শুরুর মাধ্যমে মেয়র লিটনের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন হলো এবং পূরণ হলো রাজশাহীবাসীর বহুল কাঙ্খিত স্বপ্ন।
এদিকে সুলতানগঞ্জ নৌবন্দর ও সুলতানগঞ্জ-মায়া নৌপথে নৌযান চলাচলের উদ্বোধন উপলক্ষে এক সূধী সমাবেশের আয়োজন করে বিআইডব্লিউটিএ। সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। বিশেষ অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র ও এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন, ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা, রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) আসনের সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী, রাজশাহী-৩ আসনের সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান আসাদ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য আব্দুল ওদুদ, রাজশাহী-৪ আসনের সংসদ সদস্য আব্দুল কালাম আজাদ।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) এর চেয়ারম্যান কমোডর আরিফ আহমেদ মোস্তফা। স্বাগত বক্তব্য দেন বিআইডব্লিউটিএ’র যুগ্মসচিব সেলিম ফকির।
নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ কারও সাথে বৈরিতা করে না সকলের সাথে বন্ধুত্ব রেখে পররাষ্ট্র নীতি তৈরি করেছেন দেশরত্ন শেখ হাসিনা। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সাথে সম্পর্ক অন্যতম উষ্ণতায় চলে গেছে। শুধু ময়া-সুলতানগঞ্জ নয় ভারতের সাথে পর্যটক পরিবহনে অভাবনীয় যায়গায় চলে গেছি। ময়া-সুলতানগঞ্জ তারই একটি নতুন মাইল ফলক।’
খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘রাজশাহীতে শুধু শিক্ষা না সমৃদ্ধশালী অর্থনীতি জোনে পরিবর্তন করা হবে। এজন্য সরকার কাজ করে চলেছেন। বাংলাদেশে আমাদের স্থলবন্দর আছে ২৪টি। একটি মিয়ানমার ও ২৩টি প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাথে। আমাদের ১৭ টি স্থলবন্দরের কার্যক্রম চলছে। ধীরে ধীরে বাকি সাতটি স্থলবন্দরও কাজ শুরু করা হবে।’
নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, ‘সোনামসজিদ স্থলবন্দর নিয়ে আমরা নতুনভাবে ভাবছি। এই স্থলবন্দর আরও কীভাবে আমাদের জীবন-জীবিকা ও ব্যবসা বাণিজ্য প্রসার ঘটানো যায় সেভাবে আমরা কাজ করবো। সিল্কসিটি রাজশাহীকে ব্যবসা বাণিজ্যে তুলে আনা যায় তা কাজ চলছে। প্রধানমন্ত্রী রাজশাহীকে নিয়ে অনেক প্রকল্প গ্রহণ করেছেন। সেগুলো বাস্তবায়ন করা হবে। শিক্ষানগরীকে অর্থনৈতিক জোনে পরিণত করা যায় সেভাবে সরকার কাজ করে যাচ্ছে।’
আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, ‘২০১৯ সালে ঢাকা থেকে কলকাতা পর্যন্ত ক্রুজ সার্ভিস উদ্বোধন করেছি। আমাদের নয়টি ও ভারতে চারটি ক্রজ অতিক্রম করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের সীমানায় প্রায় ১২০০ কিলোমিটার পথ আছে। বেনারশ থেকে হিব্রুগড় পর্যন্ত গেছে। সেখানে ২৮ জন ইউরোপিয়ান পর্যটক বাংলাদেশের অপার সৌর্ন্দর্য্য তারা উপভোগ করেছে। তারা শুধু অপার সৌন্দর্য্য উপভোগ করিনি বদলে যাওয়া বাংলাদেশকে তারা দেখেছে। শেখ হাসিনার উন্নয়ন ছড়িয়ে পরেছে।’
অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও রাসিক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের ধূলিয়ান থেকে নৌপথটি গোদাগাড়ীর সুলতানগঞ্জ, রাজশাহী ও পাকশী হয়ে আরিচাঘাট পর্যন্ত গেছে। দীর্ঘদিন এটির ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ ছিল না। আমি গত পাঁচ বছর বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া, লেখালেখি ও ডিও লেটার দিয়েছি। ফলে এটা গতিশীল হয়েছে। অবশেষে প্রথম পর্যায়ে সুলতানগঞ্জ-মায়া নৌপথে নৌযান চলাচলের শুরু হলো। পরবর্তীতে এটি রাজশাহী হয়ে আরিচা পর্যন্ত চালু হবে। রাজশাহী নগরীতে নৌবন্দর স্থাপন করা হবে। এর মাধ্যমে রাজশাহীর অর্থনীতি গতিশীল হবে, অনেক কর্মসংস্থান হবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমরা আজ অত্যন্ত আনন্দিত। পিছিয়ে পড়া রাজশাহীতে নৌবন্দর চালু হলো। এটির মাধ্যমে রাজশাহীর ব্যবসা বাণিজ্য বাড়বে। আমরা অনেক দিক দিয়ে উপকৃত হবো।’
প্রসঙ্গত, সুলতানগঞ্জ বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, উদ্বোধনের দিন সোমবার বাংলাদেশ থেকে মোট ১৫ টন গার্মেন্টস তুলা রপ্তানি হয়েছে এবং ভারত থেকে আমদানি হয়েছে এক হাজার ৬০০ টন পাথর। তিনটি ভেসেলে এসব পণ্য আনা-নেয়া হয় বলে জানান সুলতানগঞ্জ বন্দরের ইনচার্জ ওয়াকীল আহমেদ। এদিকে বিআইডব্লিউটিএ’র তথ্যমতে, ভারত থেকে স্থলবন্দর দিয়ে প্রতি টন পাথর আনতে খরচ পড়ে ১৩ মার্কিন ডলার। সমুদ্র পখে এই খরচ ২০ ডলার। সুলতানগঞ্জ নৌবন্দর দিয়ে পাথর আমদানি করতে খরচ পড়বে মাত্র ৯ থেকে ১০ ডলার। এছাড়া বাংলাদেশের কার্গো বা জাহাজে পাথর আনা যাবে। বিল দেওয়া যাবে আন্তঃদেশীয় মুদ্রায়। ফলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে। সৃষ্টি হবে বহু কর্মসংস্থান।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মায়া বন্দর থেকে নৌপথে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার সুলতানগঞ্জ নৌবন্দরের দূরত্ব মাত্র ২০ কিলোমিটার। সুলতানগঞ্জ থেকে রাজশাহীর দূরত্ব ৩৬ কিলোমিটার। রাজশাহীর সঙ্গে পাবনা, সিরাগঞ্জ, বগুড়া, নওগাঁ, জয়পুরহাট, রংপুর, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, খুলনা ও যশোর এমনকি ঢাকার সাথে সড়কপথে সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। ফলে দেশের স্থলবন্দর বা সমুদ্রবন্দরের চেয়ে অনেক সাশ্রয় হবে নতুন করে চালু হওয়া সুলতানগঞ্জ-মায়া নৌপথ।
বাংলাদেশে মোট পাঁচটি আন্তর্জাতিক নৌপথ চালু আছে জানিয়ে বিআইডাবলুটিএর বৈদেশিক পরিবহন শাখার উপ-পরিচালক শর্মিলা খানম জানান, এগুলোর মধ্যে সুলতাগঞ্জ থেকে মায়া বন্দরটি সবচাইলে স্বল্প দূরত্বের। নদীর নব্য বৃদ্ধি করতে পারলে এই রুট আরিচা পর্যন্ত দীর্ঘ হবে, যা অনুমোদন হয়ে আছে।
চালু হওয়া নতুন বন্দরের সুবিধার বিষয়ে রাজশাহী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি মাসুদুর রহমান রিংকু বলেন, ‘সোমবার এই রুট চালু হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে বছরে দুই হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য সম্ভব হবে।’ তিনি বলেন, ‘রাজশাহী শহরের কোল ঘেষে রয়েছে পদ্মা নদী। নৌপথটি চালু হওয়ায় একদিকে যেমন কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে তেমনি হুহু করে শহরের উন্নতি হবে। সারা বিশ্বেই বন্দরনগরীগুলো উন্নত। বাংলাদেশের অন্যতম আদি অঞ্চল রাজশাহীতে একাধিক দর্শনীয় স্থান, পুণ্যস্থান ও ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে। ফলে পর্যটনশিল্পের সমৃদ্ধি দেখতে পাচ্ছি।’
নতুন চালু হওয়া এই নৌবন্দরে আমদানি পণ্যের তালিকায় রয়েছে গবাদিপশু, মাছের পোনা, তাজা ফলমূল, গাছগাছরা, বীজ, গম, পাথর, কয়লা, সার, চায়না ক্লে, টিম্বার, কাঠ, চুনাপাথর, পেয়াজ, মরিচ, রসুন, আদা, বল ক্লে ও কোয়ার্টজ। এছাড়া রপ্তানি হবে বাংলাদেশের সকল পণ্য। এতে রাজশাহীর অর্থনীতি গতিশীল হবে এবং ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে।