সর্বশেষ সংবাদ :

এনা কাহিনী

মাহফুজুর রহমান প্রিন্স, বাগমারা: রাজশাহী-৪ বাগমারা আসন থেকে ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক বিগত তিন তিন বার নৌকার প্রতীক পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও হেভিওয়েট এই প্রার্থী এবার স্বতন্ত্র হিসেবে ভোট করে ভরাডুবির শিকার হলেন তিনি। এবার নৌকা প্রতীক ছিনিয়ে নিয়েছিলেন তাহেরপুরের পৌর মেয়র আবুল কালাম আজাদ। তিনি বিপুল ভোটে এ আসনে বিজয়ী হয়েছেন। ৫৪ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হলেন দাপুটে এমপি এনামুল হক। বিপুল ভোটে তাঁর এই পরাজয়কে ‘নির্মম ভরাডুবি’ হিসেবেই দেখছেন এলাকার চিন্তক ব্যক্তিরা।
চিন্তকরা বলছেন, এনামুল হক নৌকা প্রতীক পাবেন না এমন কথা স্বপ্নেও কল্পনা করেননি। বড়জোর হয়তো ভেবে থাকতে পারেন তিনি নৌকা প্রতীক পাবেন, কিন্তু প্রতিপক্ষ হতে পারেন তাহেরপুরের মেয়র আবুল কালাম।
এ ধারনা থেকে নির্বাচনের কিছুদিন আগে তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের এক সভায় বঙ্গবন্ধু কমপ্লেক্সে দলীয় নেতাকর্মীদের নৌকার পক্ষে ভোট দেওয়া ও কাজ করার জন্য শপথপাঠ করিয়েছিলেন তিনি। বিষয়টি তাঁর জন্য ‘হিতে-বিপোরিত’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এবার নৌকা প্রতীক না পেয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক। বিষয়টি ভাইরাল হয়েছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। অন্যদিকে এই কান্নার মাধ্যমে তিনি বাগমারাবাসীর সহানুভূতি আশা করেছিলেন, কিন্তু বাস্তবে তাঁর কান্নায় বিগলিত হয়নি বাগমারাবাসীর হৃদয়।
অবশেষে তিনি চেষ্টা করেছিলেন জননেত্রী শেখ হাসিনার দোহাই দিয়ে নির্বাচনে নেমেছিলেন কাঁচি প্রতীক নিয়ে। আবার নিজেকে বাগামারাবাসীর মনোনীত প্রার্থী হিসেবে প্রচারণা চালিয়েছেন। বলেছিলেন, ‘বাগমারাবাসী আমাকে ভালবাসে, তাদের ভালবাসার টানেই আমি প্রার্থী হয়েছি। নির্বাচিন যদি শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ হয় আমি জয়লাভ করবো। কিন্তু শেষমেশ কাজে তাঁর আসেনি এসব কৌশল। বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজয়ের শিকার হলেন তিনি।
স্থানীয় চিন্তক ব্যক্তিরা বলছেন, এনামুল হকের যেভাবে উত্থান হয়েছিল সেভাবেই তাঁর পতন হলো। তাঁরা বলছেন, ‘টিট ফর ট্যাট’ অথবা প্রবাদ অর্থে বলছেন ‘কাঁদালে কাঁদিতে হয়’।
২০০৮ সালে সরদার আমজাদ হোসেনের নৌকা তিনি যেভাবে ছিনিয়ে নিয়েছেন। ২০২৪ সালে এসে একই পরিনতি ভোগ করতে হলো তাঁকে। এছাড়া তার দাবী অনুযায়ী এবারের নির্বাচনে তার নেতা কর্মীর ওপর আবুল কালামের কর্মীদের যে হামলা-দমনপীড়ন ঘটেছে, তদ্রুপ ২০১৮ সালে তাঁর সন্ত্রাসী বাহিনী এরচেয়ে কয়েকগুণ অত্যাচার নির্যাতন চালিয়ে নির্বাচনী মাঠ থেকে উৎখাত করেছিল তৎকালীন ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী আবু হেনাকে। এনামুল বাহিনী তাঁর গাড়ি ভাংচুর করে ও পানজাবি ছিড়ে তুলে দিয়েছিল নির্বাচনী মাঠ থেকে। নির্বাচনের মাঠ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন আবু হেনা। তাঁর সেই বাহিনীই এবার বদলে দিলো মাঠের চিত্র। মাদারীগঞ্জে নির্বাচনী গণসংযোগে গিয়ে একই কর্মফল ভোগ করতে হয়েছে তাঁকে। নিজের পোষা সর্প দংশনের পরিণতিই ভোগ করতে হলো তাঁকে।
বাগমারাবাসী তাকে কেন প্রত্যাখ্যান করলেন, এ নিয়ে যত্রতত্র চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। তিনি জণগণের প্রাথী দাবী করেছিলেন, ভেবেছিলেন মানুষের সেবা করেছি। ঈদ-পূজায় শাড়ি লুঙ্গি দিয়েছি। সবাইকে ভুরি ভোজ করিয়েছি। বাগমারার আওয়ামী লীগ বিএনপি জামায়াত সবাই আমাকে ভোট দিবে। কিন্তু ঘটলো না তা বাস্তবে। ভোট বর্জনেই থাকলো বিএনপি-জামায়াত। সাধারণ মানুষও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
বলা যায়, বাগমারায় এবারের নির্বাচনে অর্থ ও পেশি শক্তি মূল নিয়ামক হিসাবে কাজ করেনি। ভোটররা নতুনের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। এর সাথে রয়েছে এনামুল হকের নানান হটকারি সিদ্ধান্ত, অদূরদর্শী চিন্তা, অনিয়ম ও দুর্নীতি। বটবৃক্ষতুল্য হেভিওয়েট এনামুল হকের ব্যাপক ভরাডুবির অসংখ্য কারণ ও ঘটনা থাকলেও সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে বেশ কিছু কারণ। এসবের অন্যতম হলো:
নিয়োগ বানিজ্য ও স্বজনপ্রীতি: ২০০৮ সালে এমপি নির্বাচিত হয়ে ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক এলাকার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দপ্তরী কাম নৈশ প্রহরী নিয়োগে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতিতে ডুবে যান। এসব প্রতিষ্ঠানে তার অযোগ্য আত্মীয় স্বজন ও এনা প্রপার্টিজের কর্মচারীদের সভাপতি বানিয়ে ব্যাপক লুটপাট, নিয়োগ বানিজ্য, নির্যাতন, হয়রানী ও চাঁদাবাজিতে মেতে ওঠেছিলেন।
মনোনয়ন বানিজ্য: ২০০৮ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বেশ কয়েকটি ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এসব নির্বাচনে ইউপি মেম্বার থেকে শুরু করে একাধিক চেয়ারম্যান প্রার্থীর কাছে শুরু করেন মনোনয়ন বানিজ্য। বাগমারা থেকে পাচার হয় কোটি কোটি টাকা। নিস্ব হয় এলাকার সহজ সরল মানুষ।
কামিটি বানিজ্য: আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগি বিভিন্ন সংগঠনের থানা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ের সকল কমিটি গঠনে শুরু হয় ব্যাপক বানিজ্য। পদ-পদবী কেনা বেচা হয়। সুবিধাভোগি বিএনপি-জামায়ত এই সুযোগে আওয়ামী লীগ ঢুকে পড়ে। ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক উপাধী পান ‘হাইব্রীড আওয়ামী লীগের ডিপো’ হিসাবে।
মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলা: বিগত ১৫ বছরে বাগমারার মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে শুরু হয় ব্যাপক ছলচাতুরী ও তামাশার খেলা। এখানে অর্থের বিনিময়ে রাতারাতি রাজাকার হয়ে যায় মুক্তিযোদ্ধা। আর প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাকে ঘুরতে হয় পথে পথে।
বিষবৃক্ষ অনীল সরকার, মালেক মেয়র ও লেদা চেয়ারম্যান: অনীল সরকার, মালেক মেয়র ও লেদা চেয়ারম্যান এই তিন বিষবৃক্ষ এনামুলের ভরাডুরি জন্য অনেকটা অবদান রেখেছে বলে বাগমারার সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করছে। ‘বিয়ে ও জমির পাগল’ খ্যাত মালেক মেয়র, জন্ডিসের রোগির ভান ধরে মীর জাফরী করে অনিল সরকারের উপাধী হয় ‘অলাইন সরকার’ এবং এক স্ত্রীকে ১০ বার তালাক ও ১০ বার বিয়ে করে রেকর্ড গড়েছেন লেদা চেয়ারম্যান।
দলের নেতা-কর্মীদের অপমান-লাঞ্চনা: সরদার আমজাদ, আবু হেনার মৃত্যুর পর নিজেকে বাগমারাবাসীর ভাগ্য বিধাতা মনে করতেন ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক। এই অহংকারে তিনি নিজ দলের নেতা কর্মীদের ব্যাপক অপমান, অবমূল্যায়ন শুরু করেছিলেন। ফলে অসন্তোষ জন্ম নেয় তৃণমূল আওয়ামী লীগে। শেষপর্যন্ত তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতা হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন আবুল কালাম আজাদ। অবশেষে তৃণমূল আওয়ামী লীগের কর্মীরা তাদের ত্রাণকর্তা জ্ঞান করে আবুল কালামকে এমপি নির্বাচিত করে দিলেন।
পরকীয়া ও নারী সঙ্গ: পরকীয়া ও নারী সঙ্গের ভাইরাল কেলেঙ্কারী ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হকের রাজনৈতিক জীবনে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে বলেও এলাকার সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করছে। তিনি একাধিক নারীসঙ্গ ও পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন। তাঁর নিজের লোকরাই ভাইরাল করে দিয়েছিল ওইসব পর্ণ ছবি ও অশ্লীল ভিডিও। এসব ভিডিও দেখে সাধারণ মানুষ তাঁকে ‘কুমারীভোগী’ এমপি বলে ভৎসনা করতেন। তাঁর এসব কর্মকান্ডে তিনি মানুষের ভালোবাসা হারিয়েছেন বলেও মন্তব্য করছেন অনেকে।
টিআর, কাবিখা আত্মসাত: শুধু টিআর কাবিখাই নয়। সরকারি বিভিন্ন দান অনুদান আত্মসাতে মেতে ওঠেন ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক। ১৫ বছরে এই আত্মসাতে রেকর্ড গড়েন তিনি।
সর্বহারা ও চরমপন্থী লালন-পালন: একই ধারাবাহিকতায় ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক নিজের অন্যায় অপকর্মের প্রতিবাদকারীদের হাত ভেঙ্গে দিতে শুরু করেছিলেন চরমপন্থী লালন পালন কার্যক্রমের মাধ্যমে। চিহ্নিত চরমপর্ন্থীদের আশ্রয় দেন ও পদপদবী দিয়ে তাদের প্রতিষ্ঠিত করেন। যা বাগমারাবাসীর মনে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি করে।
প্রশাসনকে অবজ্ঞা ও ঝুাড়ু মিছিল: ২০২১ সালের ইউপি নির্বাচনে এমপির অযোগ্য সাধারণ সম্পাদক গোলাম সারোয়ার আবুল চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়ে নানা ভাবে আচরন বিধি লঙ্গন করলে তার কিছু নির্বাচনী অফিস ভেঙ্গে ফেলে উপজেলা প্রশাসন। ওই ঘটনায় সেসময় ইউএনওর বিরুদ্ধে ঝাড়ু মিছিল করে এমপির অনুগত বাহিনী, যা প্রশাসন তাদের প্রতি চরম অবজ্ঞা ও অপমান বলে গণ্য করে। এবারের নির্বাচেন ওই ঘটনারও প্রভাব ছিল লক্ষ্মনীয়।
সর্বোপরি রাজনীতির এক উজ্জল দৃষ্টান্ত হয়ে রইলেন ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক। সরদার আমজাদ ও আবু হেনার মতো নেতাকেও তিনি ইতিহাসের সাক্ষী করে রাখলেন। তবে তার এনা প্রপার্টিজ ও বিশাল অর্থ সম্পদ রইলো তাঁর হাতে। কিন্তু এসব প্রপার্টিজ ও অর্থ-সম্পদ তাঁর এই ধাক্কা কাটিয়ে সামলে নেবে, নাকি রাজনীতি থেকে চির বিদায় নিতে হবে তাঁকে- এর উত্তর জানতে বাগমারাবাসীকে অপেক্ষা করতে হবে আগামী পাঁচ বছর।
এখন আবুল কালাম আজাদ নতুন এমপি। তিনি মেয়র থেকে হলেন এমপি, তাহেরপুরের এমপি, নদীর ওইপার থেকে নির্বাচিত এমপি অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ। আগামী ৫ বছরে তিনি কী কী করবেন, তাঁর কর্ম তাঁরও মূল্যায়ন করবে আগামীর ইতিহাস। তাঁর প্রতি অশেষ প্রত্যাশা বাগমারাবাসীর।


প্রকাশিত: জানুয়ারি ১১, ২০২৪ | সময়: ৭:৫৭ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ