সর্বশেষ সংবাদ :

রাজশাহীতে ৭২০ কোটি টাকার গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ উৎপাদনের সম্ভবনা 

স্টাফ রিপোর্টার : 
দেশে পেঁয়াজের ঘাটতি কমিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি করার তাগিদে সারাদেশে সরকার কৃষি প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় সার, উন্নত জাতের পেঁয়াজ বীজ ‘এন-৫৩’ ও নগদ অর্থ প্রদান করে আসছে। প্রথমদিকে এই পেঁয়াজ চাষে কৃষকেরা কিছুটা সমস্যার সম্মুখীন হলেও তিন বছরের মাথায় এসে এই বিশেষ জাতের পেঁয়াজ চাষে সাফল্য পেয়েছে রাজশাহীর কৃষি দপ্তর। এদিকে বাম্পার ফলন ফলিয়ে বাজিমাত করেছেন রাজশাহীর পেঁয়াজ চাষিরা। চলতি অর্থ বছরে প্রায় ৭২০ কোটি টাকার পেঁয়াজ উৎপাদনের সম্ভাবনা আছে বলেও দাবি করছে রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।

 

রাজশাহী কৃষি তথ্য সার্ভিসের আঞ্চলিক কৃষি তথ্য কর্মকর্তা ও কৃষিবিদ মো. আব্দুল্লাহ হিল কাফি জানান, ‘এন-৫৩’ হচ্ছে গ্রীষ্মকালীন উন্নত জাতের পেঁয়াজ বীজ। এটি দেশের কোন উদ্ভাবিত জাত নয়; এই বীজ ভারতের মহারাষ্ট্র প্রদেশের দেহরাদুন থেকে গত তিন বছর যাবত আমদানি করে কৃষকদের প্রণোদণাস্বরূপ প্রদান করা হচ্ছে। চলতি অর্থ বছরে আট হাজার ৫০০ কেজি পেঁয়াজ বীজ সাড়ে আট হাজার কৃষককের মাঝে বন্টন করা হয়েছে। ‘এন-৫৩’ জাতের পেঁয়াজের আকার ও ওজন দুটোই ভালো। মাত্র ৫-৬ টি পেঁয়াজেই এক কেজি ওজন হয়। প্রতিটি পেঁয়াজের ওজন প্রায় ১৫০ থেকে ২৫০ গ্রাম। সেক্ষেত্রে বিঘা প্রতি গড়ে প্রায় ২০০ মণ ফলন পাওয়ার সম্ভবনা আছে। বর্তমানে কমপক্ষে ১২-১৪ হাজার বিঘা জমিতে এ জাতের পেঁয়াজের আবাদ হচ্ছে। প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের থেকে ভালো ফলনও পেয়েছে চাষিরা।

 

বর্তমানে মাঠেই কৃষকেরা এই পেঁয়াজ বিক্রি করছেন ৩০০০ টাকা মণ। আর ফড়িয়া ও মধ্যস্বত্বভোগীরা বিক্রি করছেন ৪০০০-৪৫০০ টাকায় এবং খুচরা বাজারে ক্রেতারা কিনছেন ১২০-১৩০ টাকায়। ইতিমধ্যে রাজশাহীর অনেক হাটে-বাজারে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ গাছসহ বিক্রি হচ্ছে। এতে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন কৃষকেরা। গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজে ভালো লাভ দেখে অন্যান্য কৃষকেরাও এই জাতের পেঁয়াজ চাষে আগ্রহী হচ্ছেন।

 

 

তিনি বলেন, এখনো দ্বিতীয় পর্যায়ে লাগানো চারা থেকে উত্তোলিত না হওয়ায় পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট মেলেনি। কিন্তু আমাদের জানা আছে রাজশাহী জেলায় প্রায় ১২-১৪ হাজার বিঘায় গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের আবাদ হয়েছে বা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে বিঘা প্রতি গড়ে ২০০ মণ ফলন হলে ১২ হাজার বিঘায় ফলন হবে ২৪ লাখ মণ। বর্তমানে এই পেঁয়াজ কৃষকেরা মাঠ থেকেই ৩০০০ টাকা মণ বিক্রি করছেন। সে হিসেবে প্রায় ৭২০ কোটি টাকার পেঁয়াজের বাণিজ্য হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে।

 

 

অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে বাজারে যখন শীতকালীন পেঁয়াজের সরবরাহ কম থাকে, তখন ‘এন-৫৩’ জাতের এই পেঁয়াজ মানুষের চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এছাড়া মাসের জুলাই-আগস্টে এ বীজ বপণ করে ২৫-৩০ দিন বয়সের চারা রোপণ করতে হয়। চারদিকে ছয় ইঞ্চি দূরত্বে লাগাতে হয় এই চারা। এতে মাত্র ৯০ দিনের মধ্যে এই জাতের পেঁয়াজ সংগ্রহযোগ্য হয়ে ওঠে জানান এই কৃষিবিদ।

 

 

রাজশাহীতে প্রথম ‘এন-৫৩’ জাতের পেঁয়াজের চাষ শুরু হয় ২০২১-২২ অর্থ বছরে। ওই অর্থ বছরে দুই পর্যায়ে রাজশাহী মোট নয়টি উপজেলায় চার হাজার কৃষকের মাঝে এ বীজ প্রদান করা হয়। প্রণোদণার বীজ সহ পেঁয়াজ চাষের জন্য প্রত্যেক কৃষককে নগদ দুই হাজার টাকা, ২০ কেজি ডিএপি ও ২০ কেজি এমওপি সার প্রদান করা হয়। ২০২২-২৩ অর্থ বছরেও সমপরিমাণ পেঁয়াজ বীজ, সার ও অর্থ প্রদান করা হয়।

 

 

২০২৩-২৪ অর্থ বছরে প্রথম পর্যায়ে সাড়ে তিন হাজার কৃষককে ও ২য় পর্যায়ে পাঁচ হাজার কৃষককে প্রণোদনার সার, বীজ ও নগদ অর্থ প্রদান করা হয়। গেলো দুই বারের তুলনায় চলতি মৌসুমে এই পেঁয়াজ চাষে কৃষকেরা বেশি সাফল্য লাভ করেছে। গেলো বছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে উৎপাদন ছিল কম। তবে চলতি অর্থ বছরে পেঁয়াজ চাষের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে উৎপাদনে বাজিমাত করেছে রাজশাহীর পেঁয়াজ চাষিরা।

 

জেলার নয়টি উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজের আবাদ হয়েছে বাগমারায়। ১১০০ বিঘায় পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে দুই লাখ ২০ হাজার মণ। দ্বিতীয় অবস্থানে  থাকা গোদাগাড়ী উপজেলায় ১০২০ বিঘা জমিতে আবাদ করে উৎপাদন হয়েছে দুই লাখ চার হাজার মণ। এছাড়া পুঠিয়া, দুর্গাপুর, পবাসহ বাকি সাতটি উপজেলায় এক থেকে দেড় লাখ মণ। জেলাজুড়ে প্রায় আট হাজার ৫০০ বিঘা জমিতে মোট উৎপাদন হয়েছে ২৪ লাখ মণেরও বেশি পেঁয়াজ যা প্রত্যাশার চেয়েও বেশি বলে জানান কৃষিবিদ আব্দুল্লাহ হিল কাফি।

 

গোদাগাড়ী উপজেলার দামকুড়াহাট এলাকার পেঁয়াজ চাষি মনিরুল ইসলাম। গত তিন বছর যাবত করেছেন গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের চাষ। জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার জমি ছিল ১৫ কাঠা । প্রথমবার (২০২১-২২) ১৫ কাঠায় পায় ৮০ মণ পেঁয়াজ। ওই সময় পেঁয়াজের দাম থাকায় এক হাজার টাকা মণ প্রতি বিক্রি করি। পরের বছর (২০২২-২৩) ১৭ কাঠা জমিতে আবাদ করি। ফলন হয় প্রায় ১০৫ মণ। সেই বারেও এক হাজার টাকা মণে বিক্রি করি। তবে চলতি অর্থ বছরের প্রথম পর্যায়ে ১০০ মণ পেঁয়াজ উৎপাদন করেছিলাম। সেগুলো হাটে ৩০০০ টাকা মণ দরে ২০ দিন আগে বিক্রিও করেছি। দ্বিতীয় পর্যায়ে আবারো পেঁয়াজ বুনেছি। পুরনো অভিজ্ঞতা ও মাঠে পেঁয়াজের চারা দেখে আশা করছি, এবার ১৭ কাঠা জমিতে পেঁয়াজ আসবে ১১০-২০ মণ।

 

 

আরেক প্রণোদণার পেঁয়াজ চাষি শফিকুল ইসলাম। বাড়ি পবা উপজেলার নওহাটা পৌরসভার নামোপাড়ায়। গত দুবছর ধরে চাষ করছেন গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ। গেলো মৌসুমে আড়াই বিঘা জমিতে বুনেছিলেন দুই কেজি পেঁয়াজের বীজ। তাতে ফলন এসেছিল প্রায় ৫০০ মণ পেঁয়াজ। এবারো ওই একই জমিতে লাগিয়েছেন পেঁয়াজ। তুলবেন আরও ১৫-২০ দিন পর। তবে এবার আষাঢ়ের বৃষ্টিতে বেশকিছু চারা পচে যাওয়ায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে তার। বৃষ্টিতে চারা পঁচে যাবার পরও প্রায় ৪০০-৫০০ মণ ফলন আশা করছেন। ক্ষতি না হলে পেতেন ৬০০ থেকে ৭০০ মণ পেঁয়াজ।

 

শফিকুল বলেন, ‘এই পেঁয়াজে খরচ মেলায়। জমিতেও প্রচুর পরিচর্যা করা লাগে। তবে ফলন হয় খুব ভালো। ৪-৫ টা পেঁয়াজেই এক কেজি ওজন হয়। বাজারে এবার দামও ভালো। ৪০০ টাকা পাল্লা বিক্রি হচ্ছে, মণ যাচ্ছে ৩২০০ টাকা দরে। পেঁয়াজের গাছই (ফুলকা) বিক্রি হচ্ছে ২০-২৫ টাকায়। গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষে বিঘা প্রতি খরচ হয় ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা কিন্তু ফলন ভালো হওয়ায় পুষিয়ে যায়। আর ১৫ থেকে ২০ দিন অপেক্ষা করবো। তারপর বিক্রি শুরু করব বলে জানান তিনি।

 

গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষের সম্ভাবনার ব্যাপারে কৃষিবিদ মো. আব্দুল্লাহ হিল কাফি বলেন, গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষে আমাদের ব্যাপক সম্ভবনা রয়েছে। বিশেষ করে পাহাড়ি অঞ্চল ও বরেন্দ্র এলকার উচু জমিতে। ইক্ষু, আদা, হলুদ, মরিচ, ভুট্টা ও মুখিকচুর সাথী ফসল হিসেবেও এই পেঁয়াজ চাষের যথেষ্ট সম্ভবনা আছে। এছাড়াও দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে ওঠা ছাদ বাগান অথবা বসতবাড়ির আঙ্গিনায় এক মিটারের ৪টি ট্রেতে ৭০-৮০ দিন পর আড়াই থেকে তিন কেজি পেঁয়াজ উৎপাদন করে ৪-৫ জনের একটি পরিবারের মাসিক চাহিদা মেটানো সম্ভব। সবমিলিয়ে এটি একটি সম্ভবনাময় ফসল।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মোজদার হোসেন বলেন, বিগত বছরগুলোতে আমাদের দেশে বছরে প্রায় ১১-১২ লক্ষ টন পেঁয়াজের ঘাটতি ছিল। এ পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানি ব্যয় হয়েছে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা। তবে গত তিন বছরে এই পেঁয়াজ চাষে কৃষকেরা যেমন লাভবান হয়েছে, তেমনি কমেছে আমদানি নির্ভরতা।

 

তিনি বলেন, গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষ কিছুটা কষ্টসাধ্য। তবে বেশ লাভজনক। কৃষকরা বর্তমানে এর সুফল পা”েছ। গত তিন বছর যাবত তাদের পাশে থেকে সরকারি প্রনোদণাসহ প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ প্রদান করেছি। বর্তমান সরকারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যেই ছিল পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া। আমরা তাতে সফলকাম হয়েছি। রাজশাহীতে ৯টি উপজেলায় এ পেঁয়াজের বাম্পার ফলনই তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

সানশাইন / শামি


প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৩, ২০২৩ | সময়: ৯:৪৯ অপরাহ্ণ | Daily Sunshine