রবিবার, ৮ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ।
চারঘাট প্রতিনিধি :
বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য বহনকারী মাটির তৈরি সামগ্রীর চাহিদা কমতে থাকায় প্রাচীনকাল থেকে বংশানুক্রমে গড়ে ওঠা গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প আজ বিলুপ্তির পথে। আধুনিক জিনিসপত্রের ভিড়ে মাটির দাম বৃদ্ধিসহ নানা সংকট এ শিল্প হারিয়ে যেতে বসেছে বলে জানান মৃৎশিল্পীরা।
এদিকে সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে জায়গা করে নিচ্ছে আধুনিক প্লাস্টিক, সিরামিক, সিনথেটিক, ধাতব, কাচ ও ম্যালামাইনের বিভিন্ন সামগ্রী। যার কারণে মাটির তৈরি তৈজসপত্রের চাহিদাও দিনকে দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে।
চারঘাট উপজেলার খোর্দ গোবিন্দপুর , নন্দনগাছী, পরান পুর, রাওথা গ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য মৃৎশিল্পীদের বাসস্থান। যা সহজেই যে কারোর মনকে পুলকিত করে। একসময় এ গ্রামগুলো মৃৎশিল্পের জন্য খুবই বিখ্যাত ছিল। বিজ্ঞানের জয়যাত্রা, প্রযুক্তির উন্নয়ন ও নতুন নতুন শিল্পসামগ্রীর প্রসারের কারণে এবং প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও অনুকূল বাজারের অভাবে এ শিল্প আজ বিলুপ্তির পথে
সরে জমিনে গিয়ে দেখা যায়,নিত্য ব্যবহার্য হাড়ি-পাতিল, ঘটি-বাটি, শানকি, কলসি, পোড়া মাটির পুতুল, মাটির মূর্তি, অলংকৃত পোড়ামাটির ফলক, মাটির প্রদীপ, ফুলদানি, খোলা, কড়াই, কয়েলদানি, এস্ট্রে, মগ, কলস, ব্যাংক, দৈ এর পাত্র ইত্যাদি সব তৈজসপত্র। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় রুটি বানানো খোলা, কড়াই ও দৈ রাখার পাত্র। শীতকালে ফুলদানি, ফুলের টব ওকলসি বিক্রি হয় ভালো। এছাড়া একেক সময়ে এক ধরনের জিনিস বিক্রি হয়। তবে দুই যুগ পূর্বে এ শিল্পতে যে প্রাণ ছিল, তা আজ নেই বললেই চলে। এনিয়ে নানান সমস্যার কথা তারা তুলে ধরেন,প্রতিদিনের বাংলাদেশের প্রতিবেদকের নিকট।
কাঠের গোল চাকতির ওপর মাটি রেখে তা ঘুরিয়ে সুনিপুণ হাতে ফুলের টব তৈরিতে ব্যস্ত ছিলেন সরদহ ইউনিয়নের পালপাড়ার মৃৎশিল্পী খিতেন কুমার পাল। তিনি জানান, মৃৎশিল্পের জন্য পর্যাপ্ত মাটি আহরণ ও সংরক্ষণের সমস্যা, বাড়তি খরচ, উন্নত প্রশিক্ষণ, উন্নত যন্ত্রপাতির অভাব ও প্লাস্টিক-সিরামিকসহ ধাতব দ্বারা তৈরি আসবাবপত্রের দৌরাত্ম্যর কথা।
এমন সঙ্কট নিরসনে তার দাবি- উন্নত কলাকৌশলের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, সহজ শর্তে ক্ষুদ্র ঋণ ও উন্নত যন্ত্রপাতির। আধুনিক কলাকৌশলসহ উন্নত হিট মেশিন ও নকশা করার যন্ত্রপাতি পেলে দ্রুত সময়ের মধ্যেই অনেক উন্নতমানের সিরামিক্সের মতো নিত্য প্রয়োজনীয় মাটির পণ্য তৈরি সম্ভব। এতে আবারো মৃৎশিল্পের হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাওয়া সম্ভাবনাও রয়েছে বলে দাবি মৃৎশিল্পী খিতেনের।
চারঘাট আলহাজ্ব এমএ হাদি ডিগ্রী কলেজের অবসরপ্রাপ্ত প্রভাষক বাসুদেব পাল বলেন, সভ্যতা ও সংস্কৃতির সাথে তাল মেলাতে হলে দেশের ঐতিহ্যবাহী ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পগুলো বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন। প্রয়োজন ওই সমস্ত শিল্পের সাথে জড়িতদের সরকারি সহযোগিতার। যেমনটি করছে ভারত, চীন, থাইল্যান্ড, নেপালসহ অন্যান্য দেশগুলো। তারা তাদের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও উন্নত কলাকৌশল এবং প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে তাদের স্বীয় ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রেখেছে। এমনকি তাদের ঐতিহ্যবাহী ক্ষুদ্রশিল্পের পণ্যগুলোকে আরও আকর্ষণীয় করে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে, অথচ আমরা তাতে পুরোপুরি ব্যর্থ।
অন্যথায়, অচিরেই ঐতিহ্যবাহী মাটির এ শিল্পটি মাটির সাথেই চিরতরে মিশে যেতে পারে। যদি এমনটি হয়, তবে আমাদের আগামীর প্রজন্ম চিনবে না- কুমার, কামার বা পাল কাদের বলে, তাদের কাজ কি ছিল?
সানশাইন/সোহরাব