শনিবার, ৫ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২০শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ।
রাবি প্রতিনিধি: প্রায় সাড়ে ছয় বছর পর আজ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) শাখা ছাত্রলীগের বহুল প্রত্যাশিত ২৬ তম বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে সম্মেলকে ঘিরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবাস বাংলাদেশ মাঠে মঞ্চ বানানোসহ সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি গোলাম কিবরিয়ার সভাপতিত্বে এই সম্মেলনের উদ্বোধন করবেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন। শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ রুনুর সঞ্চালনায় এতে প্রধান অতিথি থাকবেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন।
এছাড়াও সম্মেলনে প্রধান বক্তা থাকবেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান। বিশেষ অতিথি থাকবেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক, জাতীয় সংসদের হুইপ ও জয়পুরহাট-২ আসনের সংসদ সদস্য আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও রাজশাহী-৬ আসনের সংসদ সদস্য শাহরিয়ার আলম। সম্মানিত অতিথি থাকবেন রাজশাহী-৩ আসনের সংসদ সদস্য আয়েন উদ্দিন ও বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জনসংখ্যা বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য ডা. আনিকা ফারিহা জামান অর্ণা।
পাশাপাশি সম্মেলনে বিশেষ বক্তা থাকবেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ হীল বারী, উপ-গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন রনি, উপ-কর্মসংস্থান বিষয়ক সম্পাদক সাব্বির হোসেন এবং সহ-সম্পাদক আদনান হোসেন।
এদিকে সম্মেলনে শীর্ষ পদ পেতে জীবনবৃত্তান্ত জমা দিয়েছেন ৯৪ জন প্রার্থী। পদে আসতে ক্যাম্পাসে মিটিং-মিছিলের পাশাপাশি নিয়মিত স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় নেতাকর্মীদের কাছে ধরণাও দিচ্ছেন তারা।
ছাত্রলীগ সূত্রে জানা যায়, এই সম্মেলনে আলোচনায় রয়েছেন বর্তমান কমিটির সহ-সভাপতি কাজী আমিনুল হক লিংকন ও মেজবাহুল ইসলাম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শাহিনুল ইসলাম সরকার ডন ও ফয়েজ আহমেদ, সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান মিশু, গনযোগাযোগ ও উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান বাবু, প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক আসাদুল্লা-হিল-গালিব, উপ-ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক তাওহীদ দূর্জয়, কার্যনির্বাহী সদস্য আল মুক্তাদির তরঙ্গ, কর্মী অনিক মাহমুদ বনি, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সদস্য সাকিবুল হাসান বাকি এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি নিয়াজ মোর্শেদ, বঙ্গবন্ধু হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি কাবিরুজ্জামান রুহুল, রহমতুন্নেছা হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না আকতার তন্নি ও হবিবুর রহমান শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আশিকুর রহমান অপুসহ অনেকে।
তবে নেতৃত্বের দৌঁড়ে এগিয়ে থাকা এসব নেতাদের অধিকাংশের ছাত্রত্ব শেষ হয়েছে অনেক আগেই। অনেকে হয়েছেন ড্রপআউট। আবার অনেকে রাজনীতিতে দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় থাকার পর সম্মেলনকে ঘিরে হয়েছেন সক্রিয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আসন্ন সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী আসাদুল্লাহ-হিল-গালিব তার জীবনবৃত্তান্তে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে স্নাতক করার বিষয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো তথ্য প্রদান করেননি। জীবনবৃত্তান্তে উল্লেখ করেছেন, তিনি গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী। এবিষয়ে তিনি গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. মুসতাক আহমেদ স্বাক্ষরিত একটি প্রত্যয়নপত্র সংযুক্ত করেছেন। প্রত্যয়ন পত্র অনুযায়ী, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষার্থী না, বরং সান্ধ্যকালীন মাস্টার্সের শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্নের বিষয়ে জানতে আসাদুল্লাহ-হিল-গালিবের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন দেয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেন নি।
আরেক পদপ্রার্থী মেহেদী হাসান মিশুর জীবনবৃত্তান্ত অনুযায়ী, তার সর্বশেষ শিক্ষাগত যোগ্যতা ‘স্নাতক চলমান’। যদিও তিনি ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী, একজন শিক্ষার্থীকে ৬ বছরের মধ্যে স্নাতক সম্পন্ন করতে হবে। এছাড়াও এই নেতার বিরুদ্ধে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে সিট বাণিজ্যসহ শিক্ষার্থীকে জিম্মি করে চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে।
তার ছাত্রত্বের বিষয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. বিজয় কৃষ্ণ বণিক বলেন, এটা অনেক আগের কাহিনী। এখন তার ছাত্রত্ব আছে বলে মনে হয় না। এ বিষয়ে মেহেদী হাসান মিশুর ফোনে একাধিকবার ফোন দেয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
আসন্ন সম্মেলনে পদপ্রার্থী গণযোগাযোগ ও উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান বাবু বিশ^বিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি ২০১৮ সালে স্নাতক এবং পরের বছর স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। তার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ক্যাম্পাস রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় থাকার এবং বিতর্কিতদের নিয়ে মিটিং মিছিল ও শোডাউন দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব আদার ল্যাংগুয়েজেজ এ ইংরেজী ভাষা শিক্ষায় ভর্তি আছি। আমি দীর্ঘদিন রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় ছিলাম না। করোনাকালীন সময়ে আমি নিষ্ক্রিয় ছিলাম। বিতর্কিত কর্মীদের বিষয়ে তিনি বলেন, আমার সাথে অনেক কর্মী আছে। এখন তাদের ব্যক্তিগত কর্মকান্ডের দায়ভারতো আমি নিতে পারিনা।
সভাপতি পদপ্রার্থী কাজী আমিনুল ইসলাম লিংকন বিশ^বিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি ২০১৮ সালে স্নাতক শেষ করেছেন এবং ২০২১ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। তার বিরুদ্ধে ছাত্রত্ব না থাকার অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি বর্তমানে মার্কেটিং বিভাগের একটি সান্ধ্যকালীন কোর্সে ভর্তি আছি।
একই শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক শাহিনুল ইসলাম সরকার ডন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগ থেকে ২০১৬ সালে স্নাতক এবং ২০১৮ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। তিনিও ইংলিশ অ্যান্ড আদার ল্যাংগুয়েজেজর জার্মান ভাষার সংক্ষিপ্ত কোর্সে ভর্তি রয়েছেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী আমি এখনো সংগঠনে থাকার যোগ্য। এ বিষয়ে অনেকে গুজব ছড়ানোর চেষ্টা করছে।
আরেক পদপ্রার্থী মেজবাহুল ইসলাম বিশ^বিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি ২০১৯ সালে স্নাতক এবং পরের বছর স্নাতকোত্তর শেষ করেন। তার পরিবার বিএনপি-জামায়াতপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে ক্যাস্পাসে প্রচার আছে। তবে অভিযোগের বিষয়ে মেসবাহুল ইসলাম বলেন, আমি বিশ^বিদ্যালয়ের ইংলিশ এন্ড আদার ল্যাংগুয়েজ এর ইংরেজি ভাষা শিক্ষা কোর্সে ভর্তি আছি। আমার ৮ বছরের রাজনীতিতে বিশ^বিদ্যালয় ছাত্রলীগের অনাদর্শিক ও অসাংগঠনিক কার্যকলাপে জড়িত থাকার সুস্পষ্ট প্রমাণ কেউ দিতে পারলে আমি ছাত্রলীগের ক্যান্ডিডেটশিপ ও সহ-সভাপতি পদ থেকে আমি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করবো।
এছাড়াও আলোচনায় থাকা সাকিবুল হাসান বাকি বিগত সাত বছর ক্যাম্পাসে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না, কিন্তু সম্মেলনকে ঘিরে রাজনীতির মাঠে সক্রিয় হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে তার সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।
আলোচনায় থাকা আরেক নেতা অনিক মাহমুদ বিরুদ্ধে রয়েছে ছিনতাইয়ের অভিযোগ এবং এই অভিযোগে তিনি একমাস জেল হাজতেও ছিলেন। এছাড়া তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ড্রপআউটও বলে জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে বনি বলেন, এই অভিযোগ এবং মামলা পুরোপুরি প্রতিহিংসা এবং ষড়যন্ত্রমূলক। সেই মামলাটি ইতোমধ্যে নিষ্পত্তিও হয়েছে। আর বিভাগে আমার ইয়ার গ্যাপ আছে তবে আমি এখনও নিয়মিত শিক্ষার্থী।
ছাত্র সংশ্লিষ্ট সংগঠনের নেতৃত্বে আসার প্রথম শর্তই হল ছাত্রত্ব থাকা বলছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামী পন্থী শিক্ষকরা। এ বিষয়ে বিশ^বিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থী শিক্ষক ও রাবি শিক্ষক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আশরাফুল ইসলাম খান বলেন, ছাত্রলীগের নেতৃত্বের ব্যাপারে একেবারেই সুস্পষ্ট যে, যারা আন্দোলন সংগ্রাম করার পাশাপাশি যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শ লালন করে সে রকম ছাত্রই আসলে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে আসা জরুরী। এই বৈশিষ্ট্যগুলো যাদের মধ্যে নেই, তাদের মধ্যে ছাত্রলীগের কেউ নেতৃত্বে আসুক, এটা আমার প্রত্যাশা না। আর ছাত্রলীগ শুধু নয়, ছাত্র সংশ্লিষ্ট যেকোনো সংগঠনের নেতৃত্বে আসতে হলে প্রথম শর্তই হল তাকে ছাত্র হতে হবে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করব একটি বিতর্ক বিহীন রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় ছাত্রলীগের নতুন কমিটি উপহার দিতে। এ বিষয়ে আমরা অবশ্যই সচেষ্ট এবং আমরা সর্বোচ্চভাবে ইচ্ছুক যে কোন প্রকার বিতর্ক আমাদের এই কমিটি নিয়ে না হয়।’