মঙ্গলবার, ৮ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৩শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ।
রাবি প্রতিনিধি:
দুইদিন ক্লাস পরীক্ষা স্থগিতের পর আগামীকাল মঙ্গলবার থেকে ক্লাস পরীক্ষা চলবে বলে জানিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার। আজ দুপুরে শিক্ষার্থীদের ওপর স্থানীয়দের হামলার বিষয়ে সাংবাদিকদের সাথে ব্রিফিংকালে তিনি এ কথা বলেন। এদিকে দীর্ঘ ত্রিশ ঘণ্টা পর স্তিমিত হয়েছে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। অনশন ভেঙেছেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীরা বলছেন, আমাদের দাবিসমূহ আমরা লিখিতভাবে উপাচার্য স্যারকে দিয়েছি। তিনি আশ্বাস দিয়েছেন। আমরা সেই আশ্বাসে আন্দোলন সাময়িক স্থগিত করেছি।
আজ সোমবার ক্যাম্পাস ঘুরে দেখা যায়, সকাল থেকেই ক্যাম্পাস অনেকটা ফাঁকা ছিল। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদেরকেও ক্যাম্পাসে দেখা যায়নি। ক্যাম্পাসের দোকানগুলো বন্ধ ছিল। পরিবেশ স্থিতিশীল রাখতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেইট ও বিনোদপুর গেইটে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন ছিল।
এদিন সকালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনায় বসেন বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার। আলোচনা শেষে দুপুর দেড়টার দিকে সার্বিক বিষয়ে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন তিনি। এসময় উপাচার্য বলেন, স্থানীয়দের সঙ্গে ছাত্রদের সংঘর্ষের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী আহত হয়। এসময় অনেক বিভাগে পরীক্ষা ছিল। ফলে আমরা দুইদিন ক্লাস পরীক্ষা বন্ধ রাখার সিন্ধান্ত নেই। আগামীকাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল কার্যক্রম আবার যথারীতি চলবে।
উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, আগামীকাল রাজশাহী মেস মালিক সমিতি এবং গণ্যমান্য যারা আছেন তাদের সাথে বসবো। আমার ছাত্ররা আছে বলেই তাদের ব্যবসাগুলো চলছে। তাদের কাছে অনুরোধ করব, তারা যেন ছাত্রদের প্রতি সহমর্মী হয়। আমরা চাই, ছাত্র-শিক্ষকদের সঙ্গে স্থানীয়দের একট মেলবন্ধন গড়ে উঠুক।
তিনি বলেন, ‘উদ্ভুত পরিস্থিতির কারণে দুইদিন ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ রাখা হয়। আগামীকাল থেকে আবার সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চলবে। এছাড়া ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে রেজিস্টার বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ৫০০ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা করা হয়। এই মামলায় আসামীদের ধরাও শুরু হয়েছে। এছাড়া ঘটনার পরিস্থিতি, কতজন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন, ছাত্রদের উপর কেন গুলিবর্ষণ করা হলো সবকিছু খতিয়ে দেখার জন্য পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে প্রশাসন। সাত দিনের ভেতরে তাদেরকে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।’
এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম ও অধ্যাপক হুমায়ন কবীর, প্রক্টর অধ্যাপক আসাবুল হক, জনসংযোগ দপ্তরের প্রশাসক অধ্যাপক প্রদীপ কুমার পাণ্ডে, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ইলিয়াছ হোসেন প্রমুখ উপস্থি ছিলেন।
বহিরাগত প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা
এদিকে ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন। আজ সোমবার বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দফতরের প্রশাসক স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। এ বিষয়ে উপাচার্য বলেন, ‘আমরা দেখছি, বর্তমানে ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে। এটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। আমরা চাই এখানে বাইরের মানুষ আসুক। সৌন্দর্য উপভোগ করুক। কিন্তু সৌন্দর্য উপভোগ করতে এসে তারা বিভিন্ন অনৈতিক কাজের সাথে জড়িয়ে পড়ছে এবং শিক্ষার্থীদের বিভিন্নভাবে হেনস্তা করছে। আমরা সন্ধ্যার পর বহিরাগতদের ক্যাম্পাসে অবস্থান করতে দেব না।’
আন্দোলন স্থগিত
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আশ্বাসে চলমান আন্দোলন স্থগিত করেছেন শিক্ষার্থীরা। আগামীকাল মঙ্গলবার তাদের সাথে আলোচনায় বসবেন উপাচার্য। আলোচনায় সন্তোষজনক ব্যাখ্যা না পেলে আবার আন্দোলন শুরু করবেন তারা। এ বিষয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও রাকসু আন্দোলন মঞ্চের সমন্বয়ক আব্দুল মজিদ অন্তর বলেন, গতকাল আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ৬টি দাবি জানিয়েছি। তারা আমাদেরকে আশ্বাস দিয়েছেন। সেই আশ্বাসে আমরা আন্দোলন সাময়িক স্থগিত করেছি। আগামীকাল আমাদের সাথে প্রশাসন আলোচনায় বসবেন। সেই আলোচনায় যদি আমাদের দাবি দাওয়া ও এ ঘটনার সন্তোষজনক ব্যাখ্যা আমরা না পাই তাহলে আমরা আবার আন্দোলন চালিয়ে যাব।
যান ও রেল চলাচল স্বাভাবিক
এদিকে সোমবার সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে আন্দোলনকারীদের রাখা গাছের গুঁড়ি সরিয়ে ফেলা হয়। এতে রাজশাহী-ঢাকা মহাসড়কে ছোট যানবাহনের চলাচল শুরু হয়। অপরদিকে গতকাল দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে রাজশাহীর সাথে সারা দেশের ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনের ব্যবস্থাপক আব্দুল করিম।
পুলিশের মামলা
সংঘর্ষের সময় সাতজন পুলিশ সদস্য আহত হওয়ায় এবং পুলিশ বক্সে আগুন দেওয়ার কারণে নগরীর মতিহার থানায় একটি মামলা করেছে পুলিশ। এতে অজ্ঞাতনামা ২৫০ থেকে ৩০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করে মতিহার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাফিজুর রহমান বলেন, ‘থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আমানত উল্লাহ বাদি হয়ে গতকাল রোববার রাত সাড়ে ১১টার দিকে এ মামলা করেছেন। এই মামলায় এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। হামলার সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করা হবে।’
আহতদের চিকিৎসার ব্যয়ভার গ্রহণ
এ ঘটনায় আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা ব্যয় বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন বহন করবে বলে জানিয়েছে উপাচার্য। সেই সঙ্গে গুরুতর আহত শিক্ষার্থীদের উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনে ঢাকা পাঠানোর ব্যবস্থাও করবে তারা। এ বিষয়ে উপাচার্য বলেন, এ ঘটনায় বিশ^বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীর চিকিৎসা ব্যয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বহন করবে। বর্তমানে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৯ জন শিক্ষার্থী চিকিৎসাধীন রয়েছে। তাদের মধ্যে ৩জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাদেরকে প্রয়োজনে আমরা উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠাবো।
তদন্ত কমিটির সদস্য বৃদ্ধি
ঘটনা তদন্তে গতকাল রোববার সন্ধ্যায় তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেবিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। আজ সেই কমিটির সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে তারা। সেই সঙ্গে কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য ৭ কার্যদিবস সময় বেধে দেওয়া হয়েছে। কমিটিতে আহ্বায়ক হিসেবে রয়েছেন সহ-উপাচার্য অধ্যাপক হুমায়ুন কবীর। বাকি সদস্যরা হলেন- সাবেক প্রক্টর ও রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক তারিকুল হাসান, অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আব্দুর রশিদ সরকার, সিন্ডিকেট সদস্য শফিকুজ্জামান জোয়ার্দার ও সহকারী প্রক্টর আরিফুর রহমান।
উপাচার্যের বাসভবনের নামফলক উধাও
এদিকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ভবনের নামফলক খুঁজে পাওয়া যা”েছ না। উপাচার্য ভবনের প্রহরী সাদেম মিয়া জানান, গতকাল উপাচার্য অবরুদ্ধ থাকার সময় শিক্ষার্থীরা বাসভবনের দিকে ইট পাটকেল ছুড়তে থাকেন। এরপর থেকেই নামফলকটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
শতভাগ আবাসিকতার দাবিতে শিক্ষার্থীর অবস্থান
শতভাগ আবাসিকতার দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের সামনে অবস্থান নিয়েছেন এক শিক্ষার্থী। ওই শিক্ষার্থীর নাম আবু হামজালা। তিনি হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য ব্যবস্থা বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। ওই শিক্ষার্থী বলেন, গতকাল আমি ছিনতাইকারীর কবলে পরেছি। আমরা মেসে নিরাপদ না। আমি আমার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীদের আবাসিকতা চাই।
স্থানীয়দের মারধরের শিকার আরেক শিক্ষার্থী
স্থানীয়দের সাথে রাবি শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই স্থানীয়দের হাতে মারধরের শিকার হয়েছেন আরেক শিক্ষার্থী। আজ সোমবার সকালে বিনোদপুর সংলগ্ন আমজাদের মোড় এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। ওই শিক্ষার্থীর নাম মাহমুদ হৃদয়। তিনি গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী বলেন, আজ সকাল ১০ টার দিকে যখন মেস থেকে বের হই তখন কয়েকজন স্থানীয় ছেলে আমাদের ডাক দেয়। জিজ্ঞেস করল রাবিতে পরি কিনা, আমি হ্যাঁ বলার পর তারা বলে ‘তোদের জায়গা ক্যাম্পাস পর্যন্ত বাইরে ঘুরস এত সাহস কেন?’ তারপর তারা আমার কলার ধরে চড় মারে।
এই বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর অধ্যাপক আসাবুল হক বলেন, এই ঘটনা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমি পুলিশকে জানিয়েছি।
সানশাইন/ শামি