শনিবার, ১২ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৭শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ।
লাবু হক, রাবি: শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, বইয়ে, কন্টেন্টে যদি ভুল থাকে, কাগজ এবং ছাপানো যদি নিম্নমানের হয় তাহলে নিশ্চয়ই লোকে কথা বলবেন কিন্তু মিথ্যাচার নয়। মিথ্যাচার কোনো ক্ষেত্রেই গ্রহণযোগ্য নয়। আর যারা এটি নিয়ে আপত্তি করছেন, দুঃখজনক হলেও তারা তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আমাদের জাতীয় শিক্ষাক্রমের কোনও বই পড়ান না। আর যারা পড়ান তারা কিন্তু এই মিথ্যাচারগুলোর সঙ্গে যুক্ত নন।
গতকাল সোমবার দুপুরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তনে আয়োজিত কৃতী শিক্ষার্থী স্বর্ণপদক প্রদান অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন তিনি।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে শিক্ষামন্ত্রী আরও বলেন, নতুন বইগুলোর ভুল সংশোধনের উদ্দেশ্যে আমরা ইতোমধ্যে বিশেষজ্ঞ এবং কর্মকর্তাদের নিয়ে দুটি কমিটি গঠন করে দিয়েছি। সারাদেশ থেকে যে কেউ কোনো অভিযোগ বা পরামর্শ দিলে তারা সেগুলো যাচাই-বাছাই করে যেখানেই যুক্তিযুক্ত কিছু থাকবে, সেগুলো গ্রহণ করবে। কোন ভুল থাকলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে সংশোধন করে দিয়েছি, দিচ্ছি এবং আগামীতেও দিব। বইয়ের ভুলগুলো ইচ্ছাকৃত ছিল কিনা সেটি দেখার জন্যও আমরা আরেকটি কমিটি গঠন করে দিয়েছি।
নতুন পাঠ্যক্রমের বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, আমরা চাইছি শিক্ষা শ্রেণীকক্ষের চার দেওয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। শিক্ষার্থী তার পরিবেশ থেকে শিখবে, সব জায়গা থেকে শিখবে। আমাদের মূল লক্ষ্যগুলোর একটি হল শিক্ষা হবে আনন্দময়। আমরা এর আগে পরীক্ষার জন্য পড়েছি, পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের জন্য পড়েছি। শুধুমাত্র জ্ঞানভিত্তিক এমন শিক্ষা এ যুগের জন্য অচল। শিক্ষাব্যবস্থা দিয়ে যে শিক্ষার্থী তৈরি করতে হবে তাকে এ যুগে এবং ভবিষ্যতে চলতে পারতে হবে এবং সমস্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারতে হবে। এজন্য একজন শিক্ষার্থীকে জ্ঞানের সঙ্গে দক্ষতা অর্জন করতে হবে, মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ হতে হবে এবং তার সৃজনশীলতা থাকতে হবে। অচল নাগরিক দিয়ে আমাদের সোনার বাংলা হবে না
ইউজিসির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়া খুব শীঘ্রই শুরু করা হবে জানিয়ে শিক্ষমন্ত্রী বলেন, প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং যে সকল কলেজে উচ্চশিক্ষা দেয়া হয় সে সকল প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ হয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীরা শিক্ষক হন এটা সত্য। কিন্ত মেধাবী মানেই সবচেয়ে ভালো শিক্ষক এমনটা নয়। অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ন্যায় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে। এজন্য ইউজিসির মাধ্যমে সেই প্রশিক্ষণ খুব শীঘ্রই শুরু করতে যাচ্ছি। ইতোমধ্যে প্রায় সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে এসেছে।
অনুষ্ঠানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি প্রক্রিয়ার আওতায় আসার আহ্বান জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের হয়রানি ও ব্যয় সাশ্রয়ের জন্য আমরা চেয়েছি গুচ্ছ পদ্ধতি করতে এবং ৫ টি বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতিত অন্যরা সবাই এর আওতায় এসেছেন। যেকোনো নতুন পদ্ধতি হলে তার মধ্যে ছোট খাটো সমস্যা থাকতেই পারে, সেগুলো ঠিক হয়ে যাবে। আশা করি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পেছনে পরে থাকবে না, তারাও সবার সঙ্গে চলতে পারবে।
অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে রাবি উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, জ্ঞান, নীতি সত্য হলো আত্মার রক্ষাকবজ। শিক্ষার উদ্দেশ্যই হলো অন্তরকে আলোকিত করা। অন্তরের মধ্যে যদি কোন অন্ধকার থাকে সেটাকে দূরীভূত করে শিক্ষা। ১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশ স্বাধীন হয় তার এক দশক আগেই শিল্প বিপ্লব হয়ে গেছিলো। বঙ্গবন্ধু সে বিষয়টাকে মাথায় রেখে ড.কুদরতে খুদার মত মানুষকে শিক্ষা কমিশনের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। আজকে আমরা সেটার সুফল পাচ্ছি। ২০৪১ সালে যেয়েও আমরা সেটার সুফল পাবো। এগুলো সব বঙ্গবন্ধুর লালিত স্বপ্ন।
কৃতী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে উপাচার্য বলেন, আপনারা যারা কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন তাদের কাছে অনুরোধ থাকবে অবশ্যই বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং যে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। পিতা-কন্যার যে ধ্রুপদী অর্থনৈতিক উন্নয়ন সে উন্নয়নে আপনারা সবসময়ই পাশে থাকবেন। কারণ এরই মধ্যে বাঙালি জাতির শান্তি ও মুক্তি।
অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও এগ্রোনমী অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল এক্সটেনশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সুমনা সরকার ও ড. ফেরদৌস আক্তারের সঞ্চালনায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সিইও মুরশেদুল কবীর। আলোচনা সভার পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে প্রথম শ্রেণিসহ প্রথম স্থান অর্জনকারী কৃতী শিক্ষার্থীদের মধ্যে চারুকলা, প্রকৌশল, বিজনেস স্টাডিজ, বিজ্ঞান, সামাজিকবিজ্ঞান, আইন, জীব ও ভূ-বিজ্ঞান, কৃষি এবং কলা অনুষদের ৯৬ জনকে ‘বঙ্গবন্ধু স্বর্ণপদক, অগ্রণী ব্যংক’, দর্শন বিভাগের ৫ জন শিক্ষার্থীকে ‘ড. মমতাজ উদ্দিন আহমদ স্বর্ণপদক’, এবং চিকিৎসা অনুষদের ২ জন শিক্ষার্থীকে ‘ডা. এ কে খান স্বর্ণপদক’ প্রদান করা হয়।
এসময় রাবির দুই উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষসহ প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ, বিভিন্ন অনুষদের অধিকর্তা, বিভাগীয় সভাপতি এবং অন্যান্য শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা উপস্থিত ছিলেন।
শিক্ষার মানোন্নয়নে কর্মশালা : রাষ্ট্রবিরোধী অপশক্তি নতুন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যবই নিয়ে গুজব ছড়িয়ে দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করছে বলে মন্তব্য করেছেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। তিনি বলেছেন, পাঠ্যপুস্তকে ভুল থাকলে সব যৌক্তিক ভুল সংশোধন করা হবে; তবে এসব নিয়ে মিথ্যাচারে লিপ্ত হলে তা কখনোই মেনে নেওয়া হবে না।
সোমবার দুপুরে শিক্ষা ব্যবস্থাপনা ও শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন শীর্ষক কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে মন্ত্রী এসব কথা বলেন। রাজশাহী নগরের শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান মিলনায়তনে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ মনিটরিং অ্যান্ড ইভালুয়েশন দফতর এ কর্মশালার আয়োজন করে। এতে রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন কলেজের অধ্যক্ষরা অংশগ্রহণ করেন।
দীপু মনি বলেন, মানুষ বানর থেকে এসেছে- নতুন পাঠ্যবইয়ের কোথাও এমনটি লেখা নেই। বইয়ে মানুষ আদিযুগে দেখতে কেমন ছিল, এখন দেখতে কেমন; সে বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। কোনো ইস্যু না পেয়ে রাষ্ট্রবিরোধী শক্তি এখন পাঠ্যপুস্তকের ওপর ভর করার অপচেষ্টা করছে। তারা বলছে, নতুন বইয়ে ইসলাম নেই, যা আছে ওটা ইসলামবিরোধী। আমরা বলতে চাই, আওয়ামী লীগ সরকার কখনো ইসলামের বিরুদ্ধে কিছু করেনি, করবেও না।
মন্ত্রী আরো বলেন, পাঠ্যবইয়ে যেসব ভুল এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে, তা সংশোধন করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয়েছে। বাকি বইগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত আছে। সকলে পড়ুন, মতামত দিন। দায়িত্ব নিয়ে বলছি, যত গঠনমূলক সমালোচনা ও পরামর্শ রয়েছে- আমরা খোলা মনে সব পরামর্শ বিবেচনা করব। যেখানে যৌক্তিক হবে, সেখানে পরিমার্জন, পরিশোধন, পরিশীলন অবশ্যই করা হবে।
কোন কথায় কান দেওয়ার আগে সত্যতা যাচাইয়ের আহ্বান জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আপনারা গুজবে কান দেবেন না। কোন কথা শুনলে আগে তার সত্যতা যাচাই করবেন। চিলে কান নিয়েছে বলে চিলের পেছনে না দৌঁড়ে নিজের কানে হাত দিয়ে দেখুন; কান নিজের কাছে আছে কিনা। দেশের মানুষ সুখে–শান্তিতে বসবাস করছে। কিন্তু দেশের স্থিতিশীল পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করতে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি এসব ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে।
কর্মশালায় বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও রাজশাহী-২ (মহানগর) আসনের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলে হোসেন বাদশা। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষার পাশাপাশি আরো অনেক কিছুর প্রয়োজন রয়েছে। যেমন, খেলাধুলা, বিতর্ক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি। এসবের মধ্যে অনেক জ্ঞানভিত্তিক বিষয় থাকে, যা আমাদের শিক্ষার্থীদের অনেক ভুল ধারনা থেকে বেরিয়ে আসতে সহায়তা করবে। দেশের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিষয়টির ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করতে মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগী হওয়া আবশ্যক।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ডা. মশিউর রহমান। এসময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার, রবিন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শাহ আজম, শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডা. গোলাম রবিসহ রাজশাহী বিভাগীয় অঞ্চলের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানরা উপস্থিত ছিলেন।